কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪

অচিন্ত্য দাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


ভয়

চড়ুইভাতি, বনভোজন এসব আর কেউ বলে না, বলে পিকনিক। আর এই পিকনিকের হুজুগ দিন দিন বাড়ছে। ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাস পড়লেই হাজারে হাজারে লোক দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে। নদী বা জলাশয়ের ধার, বাগানবাড়ি, শহর ছাড়িয়ে জঙ্গলের কিনারায় মেঠো এলাকা – যেখানে জায়গা পায় সেখানেই পিকনিক করতে বসে যায়।

ঝাড়গ্রাম পেরিয়ে খড়গপুরের দিকে হাইওয়ে ধরে কিছুটা যাওয়ার পর ডানদিকে ঘুরতে হবে। তারপর বিশ-পঁচিশ মাইল গেলে জায়গাটা। একটা সাঁকো আছে, তার নিচে দিয়ে হালকা শব্দ করে ঝরনার জল বইছে। সাঁকো পেরিয়ে গেলে দেখা যায় পুরনো দু-তিনটে মন্দির। সিমেন্ট দিয়ে মেরামত করা হয়েছে বলে কোনক্রমে দাঁড়িয়ে আছে। একটা তো কাত হয়ে মাটিতে বসে গেছে। একটা কুয়ো – শাল কাঠের কাঠামো থেকে কপিকল আর দড়ি ঝুলছে। পাশে দোতলা বাড়ি – লেখা  আছে ‘বাল্মিকী আশ্রম’। বাল্মীকি বানানটা অবশ্য ভুল লিখেছে। এ জায়গাটা ঝাড়খণ্ডের কাছে তবে পশ্চিমবঙ্গের ভেতর পড়ে। তাই বাংলায় লেখা। একটু তফাতে একটা চাতাল, তাতে রয়েছে পাথরের বেদি। সেখানে লব, কুশ, আর সীতার মূর্তি –  নিচে নাম লেখা আছে। তাদের পাশে একটা সাদা পাথরের ঘোড়া, ফুট তিনেক উঁচু হবে। কিছ্ লেখা নেই – অশ্বমেধের ঘোড়া হতে পারে!  

চারিদিকে বন-জঙ্গল, শালগাছই বেশি, তবে আকাশমণি, মহুল, ছাতিম, নিম এসবও ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু মেঠো খালি জায়গা এদিক ওদিকে। বনদেবী যেন মানুষদের পিকনিক করার জন্য ছেড়ে রেখেছেন। অনেকগুলো পিকনিক পার্টি এসেছে – স্থানীয় মানুষজন সবাই, কাছাকাছি মানে এই বিশ-ত্রিশ কিলোমিটারের ভেতর থেকেই এসেছে মনে হয়। আজকাল মাটির উনুন উঠে গেছে – সে ছিল এক মহাঝামেলার ব্যাপার। তার জায়গা নিয়েছে এলপিজি সিলিণ্ডার আর লোহার ফ্রেমে বড় বড় বারনার লাগানো উনুন। অনেক সুবিধে।

হারুদা অনেক দিনের রাঁধুনি। পিকনিক সিজনে খুব কাজ পায়। মাংস মাখা হয়ে গেছে, ভাতটা চড়িয়ে দিল। বড় পার্টি, সারা পাড়া এসেছে মনে হচ্ছে। পকোড়া ভাজতে ভাজতে হাত ব্যথা হয়ে গেল! মুড়ি, পকোড়া আর চা দেওয়া হয়ে গেছে – একটা পর্ব শেষ। তবে এই বনানী বলে কলেজে পড়া মেয়েটা বড় চঞ্চল – সে আরও পকোড়া চায়। হারুদার গামছা ধরে টানাটানি শুরু করেছে।

একটু দূরেই গোটা ছয়েক কারখানায় কাজ করা ছেলে পিকনিক করতে এসেছে। তার মধ্যে আছে সুহাস নামের ছেলেটা। সে রাস্তায় বা বাসে যেতে বনানীকে দেখেছে। মেয়েটা কেমন যেন টানে সুহাসকে। তবে চেনা-পরিচয় হয়নি, কথাবার্তা তো দূরের কথা। সে ঠিক লক্ষ করেছে বনানীকে। আজ ভালো সুযোগ, কিন্তু ব্যাপারটা হবে কী করে? সোজা চলে যাবে? না না তা হয় না। আর সোজা গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে ওর পাড়ার লোকজনেরা খেপে যেতে পারে। তবে আজকাল তো মেয়েদের সঙ্গে মিশতে তেমন কেউ বাধা দেয় না। কিন্তু যদি দেয় তাহলে। মেলা ঝামেলায় পড়ে যাবে। বনানীকে আলাদা পেলে ভালো হতো, কিন্তু সে যদি জোরে হেসে ওঠে বা তাকে অপমান টপমান করে বসে? করবে না হয়তো কিন্তু যদি করে। সুহাস বসেই রইল।

মুড়ি আর পকোড়া চিবোতে চিবোতে শঙ্কু মোবাইলে ভিডিও দেখছে। ক্রিকেটের। সে ভালো খেলে, কিন্তু বাড়ির চাপাচাপিতে প্র্যাকটিস কমিয়ে পড়াশুনোতে বেশি সময় দিতে হচ্ছে। সেও ব্যাপারটা বোঝে – পড়া ছাড়লে মুশকিল। খেলায় যদি ভালো সুযোগ না পায়। এই তো ঝাড়খণ্ড থেকে এবার তিন-তিনজন নতুন প্লেয়ার আইপিএল খেলবে। ধোনি আর ইশান কিষনও তো এই ঝাড়খণ্ড থেকেই। তা হলেও – পড়া ছেড়ে খেলা আঁকড়ে ধরতে ভয় লাগে। যদি নিজের জায়গা করে নিতে না পারে। এ কূল ও কূল দুকূলই যাবে।

মহানিম গাছের নিচে ফোল্ডিং চেয়ার পেতে জনা সাতেকের একটা ছোট দল রদ্দুর পোহাচ্ছে। এনারা একই পরিবার থেকে হলেও সঙ্গে দু-একজন বন্ধুবান্ধব আছে। বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসা হয়েছে, তাই ব্যস্ততা কম। দুতিনটে ছেলেমেয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে আর হারজিৎ নিয়ে লাফালাফি করছে। পাশের পিকনিক পার্টি গান চালিয়েছে – এতক্ষণ ফুল ভল্যুমে ঝপর ঝপর গান হচ্ছিল। কী করে যেন তার মধ্যে লতা মঙ্গেশকরের পুরোনো গান “বেদরদী বালমা তুঝকো” বেজে উঠেছিল। একটা ছেলে তাড়াতাড়ি গিয়ে ওটা বন্ধ করে আবার একটা র‌্যাপ গান চালিয়ে দিল।

ফোল্ডিং চেয়ারে বসা বয়স্ক লোকটি বলে উঠলেন, “ভালো গান এরা শুনতে শেখেনি, উফ কান ঝালাপালা হয়ে যায় আজকালকার গান শুনে।” এনার বন্ধু পাঞ্জাবীর পকেট থেকে চ্যাপটা হুইস্কির বোতলটা বার করে গাছের আড়ালটুকু নিয়ে দুটো গেলাশে ঢেলে জল মেশালেন। দুজনে একসঙ্গে বললেন “চিয়ার্স!”

 “এই জেনেরেশন নিয়ে অত ভাবিস নে, যা করছে করুক। নিজে ভালো থাক”

“পেনসনের এই কটা টাকায় ভালো থাকা যায় না রে!...”

“তোর বাড়ির পেছনে যে ঘরটা আছে সেটা তো খালিই পড়ে আছে। ভাড়া দিয়ে দিতে পারিস তো। আরে এই কানাই পাল, ওই যে বাড়ি তৈরির জিনিসপত্রের দোকান আছে, ও তো রংএর টিন রাখার জন্য একটা গুদাম ঘর খুঁজছে।”

“জানি। এসেছিল আমার কাছে। চার হাজার ভাড়া দেবে কিন্তু লোকটার বড় প্রতিপত্তি হয়েছে আজকাল – কাউসিলর, এমএলএ সব ওর এক বোতলের বন্ধু …”

“তাতে কি হলো?”

“ঘরটা একবার নিলে যদি ও আর না ছাড়ে, জবরদখল করে নেয়?”

দুই বন্ধু চুপ করে চুমুক দিতে লাগল। কথাটা তো ভুল নয়। হয়তো দখল করবে না, কিন্তু যদি করে নেয়, তাহলে?

শীতের সকাল গড়িয়ে গড়িয়ে দুপুর হয়। রোদ্দুর আর অতটা ভালো লাগে না। সোয়েটার টুপি সকলেই খুলে ফেলেছে। খিদে পাচ্ছে। হারুদা কাঠের হাতা নেড়ে নেড়ে মাংস কষছে। দু-একজন মুখের ওপর টুপির আড়াল দিয়ে সটান শুয়ে পড়েছে। এই ঈষৎ উষ্ণ রোদ্দুর, এই শাল গাছের পাতা ছোঁয়া মৃদু বাতাস, এই পিকনিক করতে আসা মানুষের সুখের কোলাহল – সব মিলেমিশে এদের শরীর আর মন ভিজিয়ে দিচ্ছে। পিকনিকের মধুর আলস্যে নেশা লেগে যায়।

এমন সময় রাস্তার দিক থেকে একটা লোকের আগমন। তার পরনে খাকি প্যান্ট আর গাঢ় খয়েরী সোয়েটার। সে এসেই প্রবল ভাবে হাত নেড়ে কী যেন বোঝাতে লাগল সবাইকে – “হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে”

পশ্চিমবঙ্গ পুলিস। সঙ্গে দুজন রিআরপিএফকেও দেখা গেল। জিগ্যেস করে জানা গেল – দশ কিলোমিটার দূরে একটা হাতির পাল দেখা গেছে। ত্রিশ-চল্লিশটা মদ্দা, মাদী, খোকা হাতির দল। তারা নাকি এদিকে আসছে। দশ কিলোমিটার আসতে আধঘণ্টার বেশি লাগে না তাদের।

এখানকার স্থানীয় মানুষেরা হাতির দৌরাত্ম কতটা হতে পারে তা জানে। কেউ প্রশ্ন করল না, হাসিঠাট্টাও না। সোজা পাত্তারি গোটাতে শুরু করে দিল। “এইইই, বাচ্চাগুলোকে আগে গাড়িতে তোল”, “আরে শতরঞ্জিটা ধর দেখি, গুটিয়ে ফেলি”, “জুতো পড়ে নে” – এই ধরনের কথা শোনা যাচ্ছিল। হারুদা আধ-কষা মাংসর ডেকচি তুলে দিল টেম্পোর ডালাতে। তাড়াতাড়িতে লোহার উনুন তুলতে গিয়ে হারুদার জোগাড়ে মানে সহকারী হাতে রাম-ছেঁকা খেল একখানা। কাটা আলুর টুকরো বোলাতে বোলাতে অন্য বাসনগুলো তুলে ফেলল। একটা ফোল্ডিংচেয়ার ভাঁজ হচ্ছিল না। এর মধ্যেও একজন রসিকতা করে গেল – চেয়ারটার আর্থারাইটিস হয়েছে, আর সোজা হবে না। কটা গাড়ি ছেড়ে দিল, ট্রাক একটা ভড়ড় ভড়ড় করে ধোঁয়া ছেড়ে ইঞ্জিন চালু করল।

এরা সকলে এখন একটু দূরে কোনো মাঠেঘাট খুঁজে নিয়ে পিকনিকের খাওয়া সারবে। তা জায়গা পেয়ে যাবে। কিন্তু এখানে আর নয়। মিনিট পনেরো কুড়ির ভেতর সব ফাঁকা হয়ে গেল।

হাতির পাল দেখা গেছে দশ কিলোমিটার দূরে। তারা কি এই দিকেই আসবে? এখন এই দিনের আলোতে না এসে রাত্তিরেও তো আসতে পারে। কিংবা অন্য দিকে চলে যেতে পারে। কিন্তু যদি আসে? বলা তো যায় না…

 

 

 


3 কমেন্টস্:

  1. প্রবাদ আছে ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায় সেই রকম বুনো হাতির দল যে কত সাংঘাতিক যারা জানেন তারা ভয় তো পাবেন-ই। পিকনিক বা চড়ুইভাতীতে মজা করতে আসা মানুষগুলো অন্য কোন জায়গা খুঁজে পেল কিনা জানাই গেল না। ভয়-এ লোকে বলে হাত পা গুটিয়ে যায় এখানে দেখলাম পিকনিক পার্টি কে পাত্তারি গোটাতে হল। গল্পের নামকরণ সার্থক।

    উত্তরমুছুন
  2. সুন্দর লোকেশনে চড়ুইভাতি। চড়ুই এর ঔজ্জ্বল্য -উপস্থিত সকলেই নিজের মতো করে আনন্দ পাচ্ছে। হঠাৎ করে খবর 'ভয় এসে গেছে ' । অপরূপ চিত্র।

    উত্তরমুছুন
  3. হ্যাঁ, যদি নির্ভর কেমন একটা ভয় পুরো গল্পটাকে ছেয়ে আছে। এই যদি ই পাঠককে টেনে নিয়ে যায় গল্পের শেষ যদিটি পর্যন্ত।

    উত্তরমুছুন