কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪

পি. শাশ্বতী

 

ইছাই ঘোষের দেউল




বর্ধমান জেলার কাঁকসা থানার বনকাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের অজয় নদীর ধারে পদ্মদিঘীর পাড়ে ধর্মমঙ্গলের 'ইছাই ঘোষের দেউল'! অধিকাংশ গবেষকের ধারণা, বাংলায় সেন বংশের রাজত্বকালে এই এলাকার সামন্ত রাজা ছিলেন কর্ণ সেন ৷ তাঁকে হারিয়ে পাশের গোপভূমের  সামন্ত রাজা ইছাই ঘোষ এই এলাকার দখল নেন ৷ বিজয়ের স্মারকরূপে গড়ে তোলেন একটি দেউল। অজয়ের তীরে তিনি সুরক্ষিত গড় বা দুর্গ 'ধরম গড়' তৈরি করেছিলেন। ভগ্নপ্রায় উঁচু বাঁধ দেখে এখনো সেটা বোঝা যায়। আবার অনেকে বলেছেন গৌড়েশ্বর দেবপালের মন্ত্রী মহামদকে হারিয়ে ইছাই বা ঈশ্বর ঘোষ এটি তৈরি করেছিলেন। আবার অনেকের মত, ইছাইকে হত্যা করে লাউসেন দেউলটি নির্মাণ করেন। আর একটি মতে দেখা যাচ্ছে বিষয়টি অবর্জাভেটরি।

৮০ ফুট উঁচু বাংলার সর্বোচ্চ দেউল এটি। ডেভিড জে ম্যাকচিয়নের মতে গৌড়ঙ্গপুরের ইছাই ঘোষের দেউলটি বৃহৎ মসৃণ বক্ররেখার রেখা-দেউল। এটি সাধারণ ইটের কাঠামো, টাওয়ারের কুলুঙ্গি এবং চিত্রগুলির জন্য বিখ্যাত একটি স্থাপত্য। যা জাতীয় গুরুত্বের স্মৃতিস্তম্ভ ও নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল৷ তাই, ঘুরে  আসুন শিল্পনগরী দুর্গাপুর থেকে মাত্র ২০ কিমি দূরে  পানাগড়-মোড়গ্রাম রাজ্য সড়কের 'এগারো মাইল' স্টপেজে নেমে ঘন জঙ্গলের মধ্যে বাংলার অহংকার এই দেউল থেকে। কাছেই 'শ্যামরূপা মন্দির' ও 'মেধস মুনির আশ্রম' বলে কথিত স্থান। যেখানে পুরাণ আমলে প্রথম দুর্গাপুজো হয়েছিল, এটি সেই জায়গা। নিজেকে টাইম মেশিনে নিয়ে যান পুরাণ, ইতিহাস ও মঙ্গলকাব্যের সময়ে। লোকবিশ্বাস, গড়জঙ্গলের এই স্থানে  মেধস মুনির আশ্রমে সর্বস্ব হারিয়ে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য দুর্গার মাটির পট এঁকে বসন্তকালে প্রথম দুর্গাপুজো করেছিলেন৷ এই পুজোর পর সুরথ বলিপুরে (এখনকার বোলপুর) নিজের রাজত্ব ফিরে লক্ষাধিক প্রাণী বলি দেন ৷ তাই সুরথের রাজধানীর নাম হয় বলিপুর।

ইছাই দেউলের কাছে অজয় নদীর অন্য পাড়ে বীরভূমে রয়েছে লাউসেনতলা ও কালু ডোমের মন্দির। লাউসেন ছিলেন কর্ণসেন ও রঞ্জাবতীর সন্তান। ধর্মমঙ্গল মতে রঞ্জাবতী ছিলেন শাপভ্রষ্টা স্বর্গের দেবী ৷  ধর্মঠাকুরের কৃপায় পরজন্মে মর্ত্যে তাঁর লাউসেন নামে পুত্র হয়। এই রাজ্যচ্যুত কর্ণসেনের ছেলে  লাউসেন স্থানীয় ডোম সম্প্রদায়ের সহায়তায় ইছাইকে হত্যা করে। তাই এই জায়গাটিকে বলে লাউসেনতলা ৷ ওখানে ১১ই বৈশাখ কালু ডোমের মেলা হয়। এখনো রাঢ় বাংলার ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ লাউসেন-সহ তাঁর সঙ্গী বীরদের স্মরণে একত্র হন। ইছাই দেবী পার্বতীর আরাধনা করে বর পেলেও দেবীর সম্পর্কে সন্দেহ জাগায় তার পতন হয় ৷ ইছাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর  পালিতা কন্যা সাধনা তাঁর শ্বশুরবাড়ি পুরুলিয়ার কাশীপুরের রাজবাড়িতে  মা শ্যামারূপার মূর্তিটি নিয়ে যাওয়ার সময় বরাকর নদীর জলে পড়ে যায় ৷ পরে সাধনার স্বামী কল্যাণশেখর স্বপ্নাদেশে মূর্তিটি পেয়ে মাইকা থান বা মাইথনে কল্যাণেশ্বরী নামে প্রতিষ্ঠা করেন। তবে শাল-সেগুন-অর্জুন গাছে ঘেরা গড়ের জঙ্গলে উঁচু ঢিবির মতো এক জায়গায় আজও মা শ্যামারূপার পুজোও হয়। শারদীয়া মহানবমী তিথিতে আদিবাসীরা ধামসা- মাদল সহকারে এখানে মহাধূমধামে পুজো দেন।

বাংলা মঙ্গলকাব্যের মধ্যে 'ধর্মমঙ্গল' রাঢ় বাংলায় সীমাবদ্ধ ৷ খেলারাম, ঘনরাম, রূপরাম, মানিকরাম ও ময়ূরভট্ট সব কবিই ভাগিরথী, দামোদর, ময়ূরাক্ষী ঘেরা বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, হুগলি ও মেদিনীপুরের মানুষ৷ এই কাব্যটি  পড়লে এই  বিশ্বাস দৃঢ় হতে কোনো অসুবিধা হবে না যে, ধর্মমঙ্গল ইতিহাসের আলোকে লেখা বাস্তবমুখী এক বীররসের কাব্য ৷ রামগঞ্জ লিপিতে, কেশবসেনের ইদিলপুর লিপিতে দেখা যায় ইছাই ছিলেন ঢেক্করী বা ঢেকুরগড়ের মহামাণ্ডলিক৷ ধর্মঠাকুরের পুজো ডোম, বাগদি , জেলে , নাপিত প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মাঝে বিশেষ ভাবে আদৃত৷ বৌদ্ধ শূন্যমূর্তিরই হিন্দু আয়ন 'ধর্ম ঠাকুর'৷ আবার সূর্য দেবতা ধর্মঠাকুর, কালু রায়, বাঁকুড়া রায় নামে পরিচিতি পেয়েছেন বলে অনেকের অনুমান৷ তবে, ধর্মমঙ্গলে তাঁকে জগতের স্রষ্টা ও পরিচালক বলা হয়েছে৷ ২৪টি পালায় যা আজও নানা জায়গায় গাওয়া হয় ৷

"তুমি কাব্য তুমি কবি তোমার চরণ ভাবি

 দ্বিজ ঘনরাম রস গায়।"

সেরা কবি ঘনরামের লেখায় আরও জানা যায়, গৌড়েশ্বরের শালির ছেলে লাউসেনের জন্ম ধর্ম ঠাকুরের কৃপায়, তাঁর পুজো সমাজে প্রচারের জন্য। যিনি ইছাইকে পরাস্ত করেন। আর তাঁর বিরোধী গৌড়েশ্বরের মন্ত্রী মহামদের কুষ্ঠ রোগ হয়। বাংলার এই কাব্য বর্ণনায় ও সাহিত্য গুণে যথেষ্ঠ সমৃদ্ধ।

এবার আসা যাক রাঢ় বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অন্য দিকগুলির আলোচনায়। রাঢ় অঞ্চলের সংগীত সংস্কৃতিকে জানার জন্য এই এলাকার মানুষকে ও তাদের কর্মধারা, জীবিকা ইত্যাদি সম্বন্ধে জানা  প্রয়োজন। এই এলাকার প্রাকৃতিক গঠন, রুক্ষতা, নদী, বৃক্ষলতা ইত্যাদি সম্বন্ধেও জানা দরকার। এই অঞ্চলের মানুষের জীবিকা নির্ভর করে ভূপ্রকৃতি ও ভৌগোলিক গঠনের উপর। এখানকার কাকুরে মাটি, খনি, বনাঞ্চলের সম্পদকে নিয়েই এদের সুখ-দুঃখ। বিহার, ঝাড়খণ্ড থেকে বহু মানুষ এখানে এসেছে। আবার দীর্ঘকাল ধরে আদিবাসীরাও এখানে বসবাস করে চলেছে। সব কিছুর মধ্যেই এক মিশ্র সংস্কৃতির নানা প্রভাব পড়েছে এখানকার লােকগানে। এখানকার গানে এই রুক্ষ্মতার কথা, খনি অঞ্চলের কথা নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রাচীন বঙ্গের অন্যতম অংশ হল রাঢ়। এর ভৌগলিক অবস্থান নির্ণয় করতে হলে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থ ও  কিছুটা অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে বিষয়টি বেশ বিতর্কিত ও জটিল। নানা পণ্ডিতের নানা মত রয়েছে এই বিষয়ে। রমেশচন্দ্র মজুমদার সাধারণভাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রবাহিত গঙ্গায় পশ্চিম ও দক্ষিণাংশ  রাঢ়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে করেন। তাঁর মতে দক্ষিণে দামোদর এবং সম্ভবত রূপনারায়ণ নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রাচীন রাঢ়ের চতুঃসীমা বলেছেন উত্তরে মুর্শিদাবাদ থেকে দক্ষিণে মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগনা, পূর্বে হাওড়া কলকাতা থেকে পশ্চিমে পুরুলিয়া, সাঁওতাল পরগনা।

জৈন ধর্মগ্রন্থ আচারঙ্গ সূত্র অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে রাঢ়ের ছিল দুটি অংশ— পশ্চিমাংশ বজ্জভূমি (বজ্রভূমি) আর পূর্বাংশ সূক্ষ্মভূমি। ঝাড়খণ্ডের বিস্তৃত নিবিড় অরণ্য-সহ প্রাচীন বীরভূমের রুক্ষ্মভূমি, পাহাড়-টিলা, বন এবং   আদিবাসী অধ্যুষিত পশ্চিমাঞ্চল ছিল ‘বজ্জভূমি’র অন্তর্গত এবং বীরভূম জেলার পলিসমৃদ্ধ নদীবেষ্টিত বর্তমান বর্ধমানের পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে 'সূক্ষ্মভূমি'র অবস্থান ছিল। অনুমান হয়, বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশ অর্থাৎ কান্দি মহকুমা, সমগ্র বীরভূম জেলা এবং বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার উত্তরাংশ এই লইয়া উত্তর রাঢ়। মােটামুটি অজয় নদী এই উত্তর রাঢ়ের দক্ষিণ সীমা এবং দক্ষিণ রাঢ়ের উত্তর সীমা দক্ষিণ রাঢ়ের অন্তর্গত ছিল বর্তমান হাওড়া ও হুগলি জেলা এবং বর্ধমান জেলার অধিকাংশ। আশুতােষ ভট্টাচার্য বলেছেন, প্রাচীনকালে পূর্বে ভাগীরথী, উত্তরে ময়ূরাক্ষী, দক্ষিণে দামােদর ও পশ্চিমে ছােটনাগপুরের পার্বত্যভূমি, এই সীমানাবেষ্টিত বিস্তৃত ভূভাগ রাঢ় নামে পরিচিত ছিল।

জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নদী ও প্রাচীনকালে এসব নদীগুলি নাব্য ছিল। সারা বছরই নদীগুলিতে জল থাকতো। নৌকা যোগে রীতিমত ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো। বর্তমানে সেসব নদী তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। রাঢ় অঞ্চলের নদীগুলি সাধারণভাবে বর্ষাকালে ফুলে ফেঁপে ওঠে। গ্রীষ্মে শুকিয়ে যায় বা ক্ষীণ প্রবাহ থাকে। নদীর জলকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবন জীবিকার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ফলে এখানকার গানে, গল্পে, লােকজীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে নদী ও প্রবাহিত জীবনের কথা।

                         

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন