ধর্ষণ-সংস্কৃতি ও ধর্ষকের
মনস্তত্ব
সামাজিক মনোবিজ্ঞানী আন্তোনিয়া অ্যাবে বিভিন্ন ধর্ষকদের বক্তব্য
উদ্ধৃত করেছেন এইরকম, ‘একাধিক যৌন হেনস্থাকারী
পুরুষদের বিশ্বাস হল – বেশির ভাগ মহিলারা প্রথমে ‘না’ বলেন। কিন্তু সত্যিকারের
অর্থেই তিনি ‘না’ বলছেন কিনা পুরুষদের সেটা
বুঝে নিতে হয়।‘ অন্য একজন অপরাধীর ( অ্যাবের সমীক্ষায়) মন্তব্য, ‘আমি মনে করি, আমি
যা পেয়েছি (যৌন উত্তেজনা) তা আমার প্রাপ্য ছিল। আমাকে যৌন উত্তেজনা প্রদানের জন্য তার
ওপর প্রতিশোধ নিয়েছি’। এই ধর্ষকই তার ধর্ষণের অভিজ্ঞতা কে শক্তিশালী ও খুব উত্তেজনাপূর্ণ’
বলে বর্ণনা করেছে। বলা বাহুল্য অ্যাবে যে ধর্ষকের কথা এখানে উদ্ধৃত করেছেন, তা কোনো
এক বিছিন্ন ধর্ষকের কথা নয়। পিতৃতন্ত্রের চৌহদ্দির মধ্যে থাকা বরং একাধিক ধর্ষকের তথা
ধর্ষক গোষ্ঠীর মনস্তত্বের কথাই এখানে উঠে এসেছে যা প্রমাণ করে এক ধর্ষণ সংস্কৃতির বাস্তব
অস্তিত্বের, কোনো রকম পুরুষ বিদ্বেষ ছাড়াই। এই ধর্ষণ সংস্কৃতিই প্রজন্মের পর প্রজন্ম
বাহিত হয়ে চলে পিতৃতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট ছাতার তলায়।
হামবির মতে, এই ধরণের পুরুষদের জন্য,’তাদের সংস্কৃতি প্রশিক্ষণের
একটা অংশ যা তাদের কে তাদের আবেগের সংস্পর্শ থেকে দূরে ঠেলে দেয়। তারা নিজের অনুভূতিগুলো
কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে তা জানে না। এবং আরো ভয়ানক ব্যাপার হলতারা অন্যের অনুভূতি
সম্পর্কে সচেতন নয় বা সেটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনেই করে না’।
ধর্ষণ সংস্কৃতি হচ্ছে এমন এক পরিবেশ যেখানে ধর্ষণ প্রচলিত এবং
যেখানে নারীর ওপর যৌন সহিংসতার বিষয়টা মিডিয়া এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে খুব স্বাভাবিক
একটা ব্যাপার। স্ত্রী বিদ্বেষী ভাষা, নারীদের শরীরের প্রতিমূর্তীকরণ এবং যৌন সহিংসতাকে
চটকদারি করে ধর্ষণ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা যার মধ্যে দিয়ে এমন একটা সমাজ তৈরী করা
হয় যে সমাজ নারীর অধিকার ও নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করে। ধর্ষণ সংস্কৃতি প্রত্যেক নারীকেই
আক্রমণ করে। একজন নারীর ধর্ষণ প্রকৃত প্রস্তাবে সমস্ত নারীরই অসম্মান, আতঙ্ক ও সীমাবদ্ধতাকে
আঙুল উঁচিয়ে দেখায়। বেশির ভাগ নারীরা তাদের নিজেদের আচরণকে সংযত করতে বাধ্য হয় ধর্ষিত
হওয়ার ভয়ে। কিন্তু সাধারণ ভাবে ছেলেদের সেরকম কোনো ভয় থাকে না। এই ভাবেই ধর্ষণ একটা
ক্ষমতাশালী অস্ত্র হিসেবে কাজ করে গোটা নারী জনসংখ্যাই গোটা পুরুষ জনসংখ্যার একটা অধস্তন
হিসেবে সমাজে বাস করে বা করতে বাধ্য হয়, এমনকি যদিও বেশির ভাগ পুরুষ সমাজে ধর্ষণ করে
না এবং বেশির ভাগ নারীই সমাজে ধর্ষিত হয় না। এই আতঙ্কের চক্রই আসলে ধর্ষণ সংস্কৃতির
পুরুষানুক্রমিক সম্পত্তি।
ধর্ষণ সংস্কৃতি মনে করে যে এটা নারীদেরই দায়িত্ব যাতে কোনো যৌন
হয়রানির শিকার তাদের হতে না হয় এবং তার জন্য তারাই তাদের নিজেদের আচার আচরণ সংযত করবে।
ধর্ষণ সংস্কৃতিই জোর করে মানুষের মনে চাপিয়ে দেয় এই বিশ্বাস যে কোনো পুরুষ যৌন সহিংসতার শিকার হয় না বা হতে পারে না।
কেননা তাহলে পুরুষের পৌরুষের ধারণা পদদলিত হবে। মিডিয়া (সংবাদপত্র, টিভি, সিনেমা, সামাজিক
মাধ্যম ইত্যাদি) একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে, যৌনতার বাতাবরণে মুড়ে নারীদেহকে
সকলের চোখের সামনে উপস্থিত করে এবং প্রায়শই জীবিত ধর্ষিতাদের বদলে অপরাধীদেরই সমবেদনার
যোগ্য করে সকলের সামনে উপস্থিত করে। নীলছবিও একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
এই ধর্ষণ সংস্কৃতিতে। এর মধ্যেকার যৌনতা এবং সহিংসতার মধ্যে একটা আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান
যা এর দর্শকদের এক ধরণের প্রশিক্ষণ দেয় যৌন সহিংসতার (ফিল্ড ২০০৪)। দর্শকদের কাছে এমন
একটা ভুল বার্তা প্রেরণ করে যাতে মানুষ ভাবে ধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতা বিষয়গুলো যেন খুবই
স্বাভাবিক।
খুব সংক্ষেপিত আকারে ধর্ষণ সংস্কৃতির কিছু কিছু উদাহরণ নিচে
উল্লেখ করা গেল।
১। ধর্ষকের বদলে ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাকে দোষারোপ করা।
২। যৌন নিপীড়নকে তুচ্ছ বা উপেক্ষা করা।
৩। যৌন হয়রানি সহ্য করা।
৪। পুরুষদের পৌরুষকে কর্তৃত্বপূর্ণ, প্রভাবশালী, এবং যৌন আক্রমণাত্বক
হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা।
৫। নারীদের নারীত্বকে অনুগত এবং যৌন নিষ্ক্রিয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত
করা।
৬। পুরুষদের ওপর স্কোর করবার চাপ দেওয়া।
৭। মেয়েদের ওপর চাপ দেওয়া যাতে তাদের ঠান্ডা দেখতে না লাগে।
৮। যৌনতাপূর্ণ কৌতুককে মেনে না নেওয়া।
৯। ধর্ষণের অভিযোগগুলোকে গুরুত্ব সহকারে বিচার করার ক্ষেত্রে
প্রত্যাখ্যান বা অস্বীকার না করা।
১০। ছেলেরা ধর্ষিত হয় না বা হলেও তারা যথেষ্ট দূর্বল তাই হয়,
এমনটা ভেবে নেওয়া।
১১। শুধুমাত্র অশ্লীল মেয়েরাই ধর্ষিত হয়, এমনটা ভাবা।
১২। ধর্ষিতার পোশাক, মানসিক অবস্থা, উদ্দেশ্য এবং তার ইতিহাস
নিয়ে জনসমক্ষে কাটাছেঁড়া করা।
১৩। মিথ্যে ধর্ষণের খবর এবং পরিসংখ্যান ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলা।
১৪। অকারণ লিঙ্গজনিত হিংসা সিনেমা বা টিভি, বা অন্যান্য মাধ্যমে
দেখানো।
ওপরে উল্লেখিত সমস্ত বক্তব্যই ধর্ষণ সংস্কৃতি সংক্রান্ত আলোচনায় বহুজনবিদিত কতগুলো মাপকাঠি এবং প্রায় সব আলোচকরাই কমবেশি এগুলো উল্লেখ করে থাকেন। এগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে সত্যি বলতে আলোচনা সম্ভবও নয়। তাই এই ধর্ষণ সংস্কৃতি বিষয়ক আলোচনায়ও আমি সেগুলোর পূনরাবৃত্তি এড়িয়ে গেলাম না ইচ্ছে করেই। কিন্তু ধর্ষণ সংস্কৃতির স্বরূপ ও কার্যকারণ আলোচনায় এইই সব নয়।
আমাদের সমাজে ছেলে জন্মানোর পর তাকে যে সব পদ্ধতিতন্ত্রের মধ্যে
দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তাতে আরো অনেক ঘটনার পাশাপাশি একটা খুব ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে, যেটা
খুব সাংঘাতিক বললেও কম বলা হয়, সেটা হল তারা অর্থাৎ ছেলেরা এমনভাবে প্রশিক্ষিত হয় যাতে
করে তাদের মধ্যে জীবনের ঘাত প্রতিঘাত গুলো থেকে উঠে আসা নানা অনুভূতিগুলোর কীভাবে মোকবিলা
করবে তারা জানে না। আর এই ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি হয় তাদের বয়ঃসন্ধিকালে। কেননা এই সময়কার
শারীরিক মানসিক পরিবর্তনের সময় তাদের অচেনা আবেগ অনুভূতিগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য
আমাদের সমাজপারিবারিক কাঠামোয় কোনো প্রশিক্ষন তো দূরের কথা, সে সম্পর্কিত কোনো ধারণাও
আমাদের সমাজবদ্ধ জীব মানুষের নেই – না তার বাবা বা বাবাস্থানীয় অন্যান্য পুরুষদের আছে
বা থাকে, না থাকে তার মা বা মাতৃস্থানীয়া মহিলাদের। অথচ এই ক্ষেত্রে একটা প্রশিক্ষনের
চল হওয়া সমাজে, মানবসভ্যতার প্রকৃত বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য খুব বেশি দরকার। কেননা এভাবে
সমাজের প্রায় গোটা পুরুষজাতিই যদি তাদের আবেগ অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে না জানে,
তাহলে ভয়ঙ্করভাবে গোটা সমাজটাই তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হচ্ছেও তাই। হামবির বক্তব্যেও
পাওয়া যায় এমন সর্বনাশেরই ইঙ্গিত যেখানে তিনি বলছেন যে ছেলেরা তাদের নিজেদের আবেগ অনুভূতিগুলোকে
নিয়ে কীভাবে নাড়াচাড়া করতে হয় সেটাই বুঝতে পারে না, শুধু তাইই নয়, সেই সঙ্গে, তাঁর
মতে, ছেলেরা অন্যের আবেগ অনুভূতির ব্যাপারেও সচেতন নয় এবং এই ব্যাপারটাকে তারা আদৌ
গূরুত্বপূর্ণ বলে মনেই করে না।
আমরা একটু নজর করে দেখলে দেখব, ছেলে সন্তান জন্মাবার পর বাবা
মা পরিবার এমন একটা অনুভূতি দ্বারা চালিত হয় যেন তারা হাতে স্বর্গ পেয়ে গেছে। কেননা
যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হোত তাহলে তাকে নিয়ে হাজারটা চিন্তাভাবনার সামাজিক অভিভাবনকে
মেনে নিতে হয়। সর্বোপরি একটা চিন্তাভাবনা বাবা মায়েদের মনে কাজ করে কমবেশি প্রবলভাবে
– আমি যে মেয়েকে খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করব, যৌবনে পা রাখা মাত্রই সে তো অন্যের বাড়ির বা
পরিবারের গৃহিণী হবে যেখানে বাবা মা হিসেবে তাদের বুড়ো আঙুল চোষা ছাড়া অন্য উপায় অনুপস্থিত
এরকম একটা অভিভাবন। কিন্তু ছেলে হলে সে সম্ভাবনা না থাকার কারণে বাবা মা আত্মীয় পরিজন
উদ্বাহু হয়ে ঘুরে বেড়ায শুধু নয়, ছেলেকে বা ছেলেদের সুপ্রচুর আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে এমনভাবে
লালনপালন করে থাকে যাতে ভবিষ্যতে সেই ছেলেই হয়ে ওঠে পরিবারের সর্বময় কর্তৃত্ব। এই রকম
একটা সাংস্কৃতিক আবহাওয়া গোটা সমাজেই অল্পবিস্তর চলে আসছে পিতৃতান্ত্রিক মৌলবাদের কারণে।
তাছাড়া পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিই একটা ছেলেকে পুরুষ হবার কারণে যা খুশি তাই করবার ছাড়পত্র
যুগিয়ে এসেছে। এই সংস্কৃতিই একজন পুরুষকে শৈশব থেকে বল্গাহীন চলার সামাজিক অভিভাবন
যোগায়। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের লেন্সের তলায় একবিংশের এক চতূর্থাংশ চলাকালীন এখন ইদানিং
নানা গবেষণা ও সমীক্ষার কল্যানে এ কথা, এ জ্ঞান উন্মোচিত হচ্ছে যে ছেলেরা তাদের নিজেদের
আবেগ অনুভূতিকে ঠিকঠাক নাড়াচাড়া না করতে পারার পাশাপাশি অন্যদের আবেগ অনুভূতিকেও মর্যাদা
দিতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা এ ব্যাপারে মুড়ি মিছরির এক দর।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন