কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৩৬



নতুন বছর শুরু হল। এই পর্বে আমাদের লেন্সে তুলে আনব হলিউডে স্বর্ণযুগ পরবর্তীকালে খ্যাতিলাভ করা পাঁচজন পরিচালককে, যাদের নিয়ে আলোচনা বাকি রয়ে গেছে - ১) ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপালা, ২) মার্টিন স্করসেসি, ৩) স্টিভেন স্পিলবার্গ, ৪) কোয়েন্টিন টারান্টিনো ও ৫) ক্রিস্টোফার নোলান।

তবে শুরুতেই আগের পর্বে যে পাঁচজনকে নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, তাদের নিয়ে এক সংক্ষিপ্ত রি-ক্যাপ করে নেব। তাহলে খেই ধরে রাখতে সুবিধে হবে। ভিক্টর ফ্লেমিং-এর ছবি মানে আলোর খেলা, রঙের সাবলীল ব্যবহার, আউটডোর সিন, অনবদ্য অভিনয় ও লং শট। আরো বৈশিষ্ট্য, তার শুরুর ছবিগুলো সিনেমার ইতিহাসে সাদা কালো ছবির ভীড়ে প্রথমদিকের কয়েকটা রঙিন ছবি। বাস্টার কিটোন ছিলেন মূর্তিমান স্ল্যাপস্টিক কমেডি। ফ্রাঙ্ক কাপরা-র ক্যামেরা ছিল হলিউডের শুরুর দিকের ক্যামেরা যেখানে একদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং আরেকদিকে গ্রাম্য আমেরিকা ফুটে উঠেছিল। ক্লোজ শটে স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স উনি প্রথম শিখিয়েছিলেন। আলফ্রেড হিচকক এত বহু বছর পরেও মাস্টার অব সাসপেন্স। এবং অরসন ওয়েলেস মানেই নন লিনিয়ার বর্ণনা, অদ্ভুত লাইট, বেয়াড়া রকমের ক্যামেরা অ্যাঙ্গল, অফবিট ক্যামেরার জায়গা, লং শট, মন্তাজ এবং অবশ্যই ডিপ ফোকাস। এবার এই পাঁচজন মৃত পূর্বসূরীর রাস্তা ধরে তাদের জীবিত উত্তরসূরীরা কোথায় কোথায় স্বতন্ত্র, সেটাই দেখার বিষয়।

ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপালা (১৯৩৯- ) শুরু করেছিলেন স্বর্ণযুগ পরবর্তী সাড়া জাগানো প্যাটন (১৯৭০) লিখে, কিন্তু যে ছবি ওনাকে সঠিক অর্থে লাইমলাইটে আনে, তা হল দ্য গডফাদার (১৯৭২) এবং দ্য গডফাদার 2 (১৯৭৪)। এছাড়াও দ্য কনভার্সেশন (১৯৭৪), অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ (১৯৭৯), কটন ক্লাব (১৯৮৪), ড্রাকুলা (১৯৯২), দ্য রেইনমেকার (১৯৯৭) ইত্যাদি সিনেমার জন্যও উনি বিখ্যাত। তবে দেখুন, কোপালা বললে, অস্বীকার করে লাভ নেই, প্রথমেই ‘দ্য গডফাদার। উনি এই ছবির মাধ্যমে গ্যাং-ওয়ার ছবির সংজ্ঞা বদলে দিয়েছিলেন। সাধে কি ‘AFI’s 100 years…100 movies’ এই ছবিকে ‘সিটিজেন কেন আর ‘কাসাব্লাঙ্কা ছবির পরেই রেখেছিল! পাঠক, কোপালা-কে বাছাই করার পেছনে আমার প্রাথমিক যে উদ্দেশ্য রয়েছে, তা হল হলিউডের স্বর্ণযুগ পরবর্তীকালে উনি প্রথম পরিচালক যাকে সমালোচক এবং বক্স অফিস দুজায়গা থেকেই ভরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং ওনার পূর্বসূরীদের থেকে এক স্বতন্ত্র ধারায় ওনার ছবি, যা ষাট ও সত্তরের দশকের আমেরিকার অপরাধ জগতকে, যুদ্ধবাজ মানসিকতাকে দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওনার যে ছবিকে সবার আগে এগিয়ে রাখব, তা হল অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় গায়ে কাঁটা দেওয়া এক মিশন, অফিশিয়ালি যার কোন অস্তিত্ব নেই। এবং গোটা সিনেমা ধবংস ক্ষয় ক্ষতি যুদ্ধের পর দর্শক বুঝতে পারে, কি দরকার এত যুদ্ধের? কোপালা এই ছবি নিয়ে গর্ব করে বলেছিলেন ‘my movie is not about Vietnam…my movie is Vietnam’। একজন সাধারন দর্শক হিসেবে যে ব্যাপারটা কোপালার মধ্যে ভাল লাগে, তা হল উনি রিস্ক নিয়ে ছবি করতে ভালবাসেন, বাছাই করেন সেইসব বিষয় যা বিতর্কমূলক। এবং ওনার হাতে তা সঠিক অর্থে ফুটে ওঠে।

মার্টিন স্করসেসি (১৯৪২- ) যে যে সিনেমার জন্য বিখ্যাত, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ট্যাক্সি ড্রাইভার (১৯৭৬), নিউ ইয়র্ক, নিউ ইয়র্ক (১৯৭৭), রেজিং বুল (১৯৮০), দ্য কিং অব কমেডি (১৯৮২), গুডফেলাজ (১৯৯০), কেপ ফিয়ার (১৯৯১), ক্যাসিনো (১৯৯৫), গ্যাঙ্গস অব নিউ ইয়র্ক (২০০২), দ্য অ্যাভিয়েটর (২০০৪), দ্য ডিপার্টেড (২০০৬), শাটার আইল্যান্ড (২০১০), হুগো (২০১১), উলফ অব ওয়াল স্ট্রীট (২০১৩)। কোপালার মত আমেরিকান সমাজব্যবস্থায় সন্ত্রাস ও তার প্রভাব নিয়ে স্করসেসি-ও কাজ করেছেন এবং সমান্তরাল সিনেমা নয়, মেনস্ট্রিমেই কাজ করেছেন, কিন্তু যে কারনে উনি আলাদা, তা হল ওনার ছবির ভেতর অস্তিত্ববোধ, পাপবোধ, নিহিলিজম আর মুক্তির ধারনা। এই যে হিন্দি সিনেমায় আজকাল একটা ব্যাপার দেখা যায় – কোন এক বিখ্যাত অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে ক্যামিও অ্যাপিয়ারেন্সে দেখা (খুব ছোট্ট একটা রোল, মাত্র এক সিনে), এটা কিন্তু প্রথম শুরু করেছিলেন স্করসেসি। এবং এটাও সঠিক যে উনি দুজন অভিনেতাকে স্টার বানিয়েছেন – রবার্ট ডি-নিরো ও লিওনার্দো দিকাপ্রিও। যাইহোক, স্করসেসির ক্যামেরার কথা উঠলে প্রথমেই স্লো মোশনের কথা আসবে। এবং তারপরেই হঠাৎ হঠাৎ ফ্রেম ফ্রিজ করে দেওয়া। এই দুটো টেকনিক ছাড়াও এক পুরুষ হিসেবে আমার আরেকটা ব্যাপারও বেশ লেগেছে। ওনার বিভিন্ন সিনেমায় প্রধান ভূমিকায় থাকা অভিনেত্রীরা প্রথমবার ফ্রেমে আসার সময় সাদা আঁটোসাঁটো পোষাকে স্লো মোশনে আসেন। নয়নাভিরাম। সিবিল শেফার্ড, ক্যাথি মরিয়র্টি, শ্যারন স্টোন...এই লিস্টে একে একে নাম। পাঠিকা, ক্ষমা চাইছি, কিন্তু বলুন, চোখে পড়ার মত ভাল কিছু থাকলে পুরুষ হিসেবে চোখ তো আটকাবেই, তাই না! যেমন ধরুন, স্করসেসি আমার প্রিয় ব্যান্ড রোলিং স্টোন-কে বিভিন্ন ছবিতে নেপথ্যে ব্যবহার করেছেন। একটা গান ‘গিম্মি শেলটার...’ গুডফেলাজ ছবিতে কিভাবে, মনে আছে? আবার দেখুন, উনি ধর্মকেও বারবার টেনে এনেছেন। ধর্মীয় পাপবোধ। ভেতর থেকে অনুতপ্ত হওয়া। নির্বাক। যদিও আমি এই অংশ নিয়ে কিছু বলতে চাই না, কিন্তু এটা ওনার বিভিন্ন ছবির একটা দিক। তেমনি রাজনৈতিক দুর্নীতি। তবে আমার ব্যক্তিগত সেরা হল গুডফেলাজ, যদিও বেশিরভাগ সমালোচক বলবেন যে ট্যাক্সি ড্রাইভার ওনার সেরা। আসলে গুডফেলাজ দেখলে আমার মনে হয় স্করসেসি যেন নিজের বন্ধুদের নিয়ে তামাসা করতে করতে এগিয়ে চলেছেন, মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন, হাজারো দ্বিধা। কোপাকাবানা নাইটক্লাবে বান্ধবীকে নিয়ে ঢোকার মুখে হ্যান্ডিক্যাম নিয়ে একটা লং শট, প্রায় তিন মিনিট, এবং পুরো সেটটা যেন ঐ শটের জন্যই বানিয়ে রাখা। ব্যক্তিগত ঘটনা দিয়ে, হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে, কিভাবে সৃষ্টি উঠে আসে, তা হয়ত স্করসেসির মত আর কেউ পারেননি।       

এই ধারাবাহিকের ৩ নম্বর পর্বে স্টিভেন স্পিলবার্গ-এর (১৯৪৬- ) দুটো ছবি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। ওনার কেরিয়ারে সফল ছবির মধ্যে সেই দুটো অবশ্যই একদম ওপরে থাকবে - জস (১৯৭৫), ক্লোজ এনকাউন্টার্স অব দ্য থার্ড কাইন্ড (১৯৭৭), ই-টি (১৯৮২), ইন্ডিয়ানা জোনস ট্রিলজি (১৯৮১-৮৯), দ্য কালার পার্পল (১৯৮৫), জুরাসিক পার্ক (১৯৯৩), সিন্ডলার্স লিস্ট (১৯৯৩), অ্যামিস্টাড (১৯৯৭), সেভিং প্রাইভেট রায়ান (১৯৯৮), এ-আই (২০০১), মাইনরিটি রিপোর্ট (২০০২), মিউনিখ (২০০৫), লিঙ্কন (২০১২), দ্য পোস্ট (২০১৭) ইত্যাদি। এর বেশ কয়েকটা সিনেমাকে ক্লাসিক বললে ভুল বলা হবে না। যেমন ‘দ্য কালার পার্পল, ‘সিন্ডলার্স লিস্ট, ‘অ্যামিস্টাড, ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান ইত্যাদি। কালার পার্পল-কে যদি গল্পের বই থেকে তুলে বসানো পর্দার ছবি বলি, আর সিন্ডলার্স লিস্ট-কে যদি মন্দের ওপর ভালোর কাব্যময় জয়ের ছবি হিসেবে দেখি, তাহলে, অ্যামিস্টাড এদের দুয়ের মাঝে – খানিক মিস্ট্রি, খানিক থ্রিলার, আইনি জটিলতা, একাধিক সংস্কৃতির সংঘর্ষ। তবে স্পিলবার্গকে সবথেকে ভাল বোধহয় রজার এবার্ট বুঝেছেন। ওনার সমালোচনায় লিখেছেন – ‘Spielberg knows how to make audiences weep better than any director since Chaplin in ‘City Lights’, but weeping is an incomplete response, letting the audience off the hook’। তাহলে একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে কোন এক জায়গায় উনি কোপালা আর স্করসেসি-র থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে কারন উনি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্ধকারের তুলনায় আলোর জয় দেখিয়েছেন, খারাপকে ঢেকে ভালোর মহত্ব দেখিয়েছেন। যে থিমটা ওনার বিভিন্ন সিনেমায় মাঝে মাঝেই ঘুরে ফিরে এসেছে – ‘ordinary people in extraordinary circumstances’। তার ফলে সামান্য হলেও জীবনের এদিক ওদিক কিভাবে তফাৎ তৈরি হয়। এবং ওনার বেশিরভাগ ছবিতে ইমোশন যে দর্শকদের কাছে সূক্ষ্মভাবে ধরা দেয় তার প্রধান কারন স্পিলবার্গের ক্যামেরা। আরেক কারন জন উইলিয়ামসের সঙ্গীত। এবং তৃতীয় কারন অবশ্যই অভিনেতাদের থেকে সেরাটা আদায় করে নেওয়া। অবশ্য এটাও আপনারা জানেন যে একটা বিতর্ক আছে। ই-টি ছবির জন্য সত্যজিৎ রায় ওনার দিকে আঙুল তুলেছিলেন, ছবির থিম চুরির অভিযোগে। ব্যাপারটা এরকম, ১৯৬২ সালে লেখা ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু অনুসরন করে ১৯৬৭ সালে সত্যজিৎ ও কলাম্বিয়া পিকচার্সের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল ‘The Alien’ নামক একটি ছবি তৈরি করা হবে। পরে যদিও নানা কারনে তা বাতিল হয়ে যায়। সেই প্রস্তাবিত ছবির পান্ডুলিপি সত্যজিৎ লিখেও রেখেছিলেন। অনুমান, সেই পান্ডুলিপি কোনভাবে আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে, ই-টি ছবির প্রস্তাব সেই পান্ডুলিপি থেকেই হয়, ছবির স্ক্রিপ্ট শুনে স্পিলবার্গের ভাল লাগে এবং ব্যাকগ্রাউন্ড চেক না করেই উনি ছবিটি করতে রাজি হন। যাইহোক, ই-টি বাদ দিলেও ওনার বাকি ছবিগুলো ওনাকে সিনেমার ইতিহাসে অমর করার জন্য যথেষ্ট। 

ওপরের তিনজনকে যদি হলিউডের নিউ ওয়েভ ছবির তিন ঘরানার দিকপাল হিসেবে ধরা যায়, তাহলে তাদের পরবর্তীকালের শক্তিশালী পরিচালক হলেন কোয়েন্টিন টারান্টিনো (১৯৬৩- )। নয়ের দশক থেকে ওনার যাত্রা শুরু। রিজার্ভায়ার ডগস্ (১৯৯২), পাল্প ফিকশন (১৯৯৪), ফ্রম ডাস্ক টিল ডন (১৯৯৬), জ্যাকি ব্রাউন (১৯৯৭), কিল বিল (২০০৩-০৪), ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস (২০০৯), জ্যাঙ্গো আনচেইনড (২০১২), ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন হলিউড (২০১৯) অব্দি। টারান্টিনো মনে করেন তার ছবি আদপে ড্রামা, কিন্তু কেউ কেউ বলেন ব্ল্যাক কমেডি, আবার কোন সমালোচক বলেন মারামারির থ্রিলার। এটা ঠিক যে তার ছবি ফোকাস্ড এবং শক্তিভরা। কিন্তু যেটা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই, তা হল তার ছবি হিংসা আর গালাগালে ভরা, যা এখন আমেরিকার জনপ্রিয় সংস্কৃতি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন, আমি তার নাম এই লিস্টে রাখলাম কেন? এর উত্তর আপনারা পাল্প ফিকশন আর ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস পাশাপাশি দেখলে পেয়ে যাবেন। সিনেমা বললে যদি নন-লিনিয়ার গল্প বোঝায়, যদি সাংঘাতিক বুদ্ধি আর বিনোদন বোঝায়, তাহলে এই দুটো ছবি না দেখলে আপনি বুঝবেন না, টারান্টিনো সিনেমা ব্যাপারটাকে সেই স্বর্ণযুগ থেকে ভাঙতে ভাঙতে কোথায় নিয়ে এসেছেন। এমনকি ওনার নন-লিনিয়ার গল্প বলার টেকনিককে আজকাল টারান্টিনো এফেক্ট বলা হয়ে থাকে। এ পর্যন্ত মাত্র নটা ছবি বানিয়েছেন। বলেছেন দশম এবং শেষ ছবি বানাবেন ‘দ্য মুভি ক্রিটিক, তারপর আর নয়। আমরা, যারা চুনোপুঁটি সমালোচক, আধীর আগ্রহে সেই ছবির জন্য অপেক্ষা করছি। যেমন ড্যানিয়েল ডে-লুইস খুব বেশি ছবিতে অভিনয় করেন নি, এবং এক সময় অভিনয় থেকে অবসর নিয়ে জুতো সারাই শিখতে ইতালি চলে গেছিলেন, যেমন বয়হুড ছবির পরিচালক রিচার্ড লিঙ্কলেটার ১২ বছর ধরে ছবিটা বানিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি টারান্টিনোর এই সংযম দেখে ভাল লাগে। আরো ভাল লাগে, কারন উনি শুধু একজন পরিচালক নন, একজন লেখক, এবং নিজের আত্মতৃপ্তি থাকা কালীন অবসরে যাবার সিদ্ধান্ত, আমার মতে, সঠিক। যাইহোক, যেহেতু আমি নিজেও একজন লেখক, টারান্টিনোকে প্রধানত ভাল লাগে লেখক হিসেবে। গল্পটা উনি এমনভাবে সাজিয়ে নিয়ে বসেন যেখানে বলার স্টাইল থেকে বেশ কিছু সম্ভাবনা উঠে আসে। ধরুন ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস। যুদ্ধের ছবি, কিন্তু ডায়লগে ভর্তি, এমনভাবে, মনে হবে যুদ্ধে কি কি হতে চলেছে পুরোটাই বলা হয়ে যাচ্ছে, তারপর বাকিটা দর্শকের হাতে। ইউনিক। ফলে ক্লাসিক ছবির উত্তরাধিকার টারান্টিনোর হাতেই।     

ক্রিস্টোফার নোলান (১৯৭০- ) যে যে ছবির জন্য দর্শকদের কাছে বিখ্যাত, সেগুলো - ফলোয়িং (১৯৯৮), মেমেন্টো (২০০০), দ্য ডার্ক নাইট ট্রিলজি (২০০৫-১২), দ্য প্রেস্টিজ (২০০৬), ইনসেপশন (২০১০), ইন্টারস্টেলার (২০১৪), ডানকার্ক (২০১৭), টেনেট (২০২০), ওপেনহাইমার (২০২৩)। স্বীকার করে নেওয়া ভাল, আমি গুয়াহাটিতে নোলানের মাত্র দুটো ছবি দেখেছিলাম – প্রেস্টিজ আর ইনসেপশন। ইনসেপশন দেখার পর আমার বেশ ভাল লেগেছিল, মনে হয়েছিল এই ছবির পরিচালক নিশ্চয় একজন বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক, নইলে এই থিম আর থিমের ডিডাকশন এভাবে সম্ভব নয়। পরবর্তীতে ওনার একে একে সব সিনেমাগুলোই দেখেছিলাম। নোলানের ছবিতে আমার যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো অন্যরকম মনে হয়, তার মধ্যে মেটাফিজিক্স যা দর্শনশাস্ত্রের এক অংশ, এপিস্টেমোলজি, অস্তিত্ববাদ (দেকার্তের সেই বিখ্যাত উক্তিঃ আই থিঙ্ক, দেয়ারফোর আই একজিস্ট), স্ট্রিম অব কনসাসনেস, ন্যায়শাস্ত্র, টাইম-স্পেস ডুয়ালিটি, ব্যক্তি পরিচয়, স্মৃতি এবং চেতনা ও যুক্তির দোটানা...এইসব খুঁজে পাই। আরেকটু গুছিয়ে বললে, ওনার ছবিতে একদিকে কল্পবিজ্ঞান অন্যদিকে অস্তিত্ববাদ-পরিচয়ের দোটানা আমায় টানে, ভীষণভাবে টানে। আর এই কারনেই, আজ যতজন পরিচালকের কথা বললাম, নোলান সবার থেকে আলাদা। নোলানের শেষ ছবি, ৩ ঘন্টার ওপেনহাইমার, যারা নারায়ণ সান্যালের ‘বিশ্বাসঘাতক পড়েছেন, গুরুত্ব ও টান বুঝবেন। এবং আরো বড় কথা, এই AI-VFX এর যুগে, নোলান আজো বেশিরভাগ কল্পবিজ্ঞান ছবির সেট নিজে হাতে তৈরি করেন। ছবির প্রতি পা মাটিতে রেখে চলেন। বুঝতে দেন না, এই ছবি আকাশে কবে উড়বে। ফলে এক সূক্ষ্ম স্ফূলিঙ্গ থেকে কি করে হলিউডের ব্লকবাস্টার তৈরি হয়ে যায়, সেই উড়ন তুবড়ি, একমাত্র নোলানের হাতেই। কিছুদিন আগে দেখলাম, ডেল-টোরো নোলানকে বলেছেন ‘an emotional mathematician’। বুঝলাম, আমি গুয়াহাটিতে খুব একটা ভুল কিছু ভাবিনি।    

পাঠক, সামনের পর্বে আমাদের এক শক্ত কাজ শুরু হবে, বেশ শক্ত। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের নিয়ে কাটাছেঁড়া। তৈরি থাকুন। দেখুন, নিজের লিস্টের সঙ্গে আমারটা কতটা মেলে।  

(ক্রমশ)

 


2 কমেন্টস্:

  1. খুব ভালো লাগলো লেখাটি। খুবই দরকারি লেখা। বিশেষ করে যারা ফিল্ম সম্পর্কে আগ্রহী তাদের জন্য।

    উত্তরমুছুন