কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

                        

লাল-নীল-পেন্সিল

 


(৪২)    

 

কাউন্সেলিং-এর কয়েকটা সিটিং-এর পর শোভন ‘আর ভালো লাগছে না বলে খাতা বন্ধ করে শুয়ে পড়ার বিপরীত অবস্থানে। অনলাইন পেমেন্টের জন্য কাউন্সেলারকে ফোন করেছিল লিপিকা। ভদ্রলোকের ডিগ্রি ইত্যাদি যথেষ্ট, কথাবার্তা খারাপ নয়। কিন্তু আন্তরিকতার অভাব। বলেছেন,

এখন উনি ঠিকই আছেন, তাই আপাতত কিছুদিন বন্ধ থাক। বাড়িতে সব কাজে উৎসাহ দিতে থাকুন।

আলগা গা-এড়ানো প্রফেশন্যাল উপদেশ লিপিকার ভালো লাগেনি। দু-চারটে ডিগ্রি পেয়েই লোকে উপদেশ দেওয়ার দোকান খুলে বসে। তিন-চার সপ্তাহ অনলাইনে কথা বলেই যদি একজন পরিণতবয়স্ক মানুষের সমস্যার সমাধান হয়ে যেত! নিঃশ্বাস পড়ে লিপিকার, লাভ হল কী কে জানে। তবু কাউন্সেলারের উপদেশমতো চলার চেষ্টা করে। শোভন অনেকটা আগের মতো। সেই অন্যমনস্কতা, শূন্যদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকা, খাতায় আঁচড়ের পর আঁচড় আর রঙ ঘষে চলাখসখস আওয়াজ প্রায় সারাদিন। ইদানিং আঁকার পর পছন্দ না হলে খাতার পাতা ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে ঘরের মেঝেতে ফেলে দেয়। আগে এমন করত না। লিপিকা অসন্তুষ্ট হয়, চোখে বিরক্তি ফোটে। শোভন অন্যদিকে তাকিয়ে অমনোযোগীভাবে ‘স্যরি আর করব না বলে বটে, কিন্তু অভ্যাসটা বেড়ে চলেছে।

দুপুরে খাওয়ার পর জোর করে শুতে পাঠায় শোভনকে। নিজেও যেমন-তেমন করে বাকি কাজ সেরে পাশে গিয়ে শোয়। মিনিট দশ-পনেরো ঘুমিয়ে উসখুস করার পর শোভন উঠে পড়ে। রাতেও তাই। ‘উঠলে কেন? কী হল?’ জিজ্ঞেস করলে রাগপ্রকাশ করে,

জেরা করছ নাকি?” 

জেরা আবার কী?”

লিপিকা অবাক হয়, উঠে-আসা চোখের জল সামলায়। শোভনের প্রশ্ন নয়, শোভনের পরিবর্তন কষ্ট দেয়। এবিষয়ে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকে দু-একদিন ফোন করেছিল। উনিও চিন্তিত। ‘রেস্টিল নামে একটি ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছেন। সাময়িকভাবে নার্ভ শান্ত থাকবে, উত্তেজনা প্রশমন করবে, ঘুম আসতে সুবিধা হবে। উনি বলেছেন, “ডিপ্রেশন আছে মনে হচ্ছে, ডেমেনশিয়ার সূত্রপাত হতে পারে। এবার একজন সায়কায়্যাট্রিস্টের পরামর্শ নিতে পারেন।

অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও যথেষ্ট রয়েছে। নার্ভের ওষুধ খাওয়াতে ইচ্ছে করে না লিপিকার। আগের মতো ঝিমুনি, ঘুমিয়ে থাকা। কী করা উচিৎ ভেবে পায় না লিপিকা। চিন্তার পাহাড় মাথায় নিয়ে একলা কাটছে দিন। একএক সময়ে মনে হয় নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। মোবাইলে বাবুলের পাঠানো তিনমিনিটের ভিডিও চোখের সামনে মেলে বসে থাকে লিপিকা। ঊর্বীর ভিডিও। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসছে, হাত নাড়ছে। বলছে,

আন্টি, আঙ্কল, তোমাদের বাবুল না বড্ড গোমড়ামুখো আর ড্যাম সিরিয়াস। ওকে হাসতে শেখাও তো! আমি এবার কলকাতায় গেলে আগে তোমাদের কাছে যাবো, থাকতে দেবে তো? তোমাদের একটা বড়ো অ্যাকোয়ারিয়াম আছে, তাই না? আমারও ছিল, মেইনটেইন করতে পারতাম না। গিয়ে অনেক কথা বলবো। বাইই আন্টি।”

ফোলা-ফোলা মিষ্টি আদুরে মুখ। লিপিকা একটু হাসে। মোবাইল হাতে করে শোভনের কাছে যায়। খাতা নিয়ে মগ্ন হয়ে আছে। লিপিকা হাসিমুখে মোবাইল এগিয়ে দেয়,  

দেখছ? বাবুল পাঠিয়েছে।

কী?”

শোভন মুখ তোলে, হারিয়ে যাওয়া ঘোলাটে চোখ। এলোমেলো চুল, খোঁচাখোঁচা দাড়ি। লিপিকা বিরক্তভাবে বলে,

শেভ করোনি কেন?”

কী দেখাবে বললে দেখাও।

লিপিকা মোবাইল এগিয়ে দেয়। শোভন অধৈর্যভাবে পুরো না দেখে ফিরিয়ে দেয়,

বেশ বেশ।

কে বলো তো?”

ওই যে দেবীর মেয়ে – মামপি।

লিপিকার আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে।

সায়কায়্যাট্রিস্টের ডেট নিয়েছিল লিপিকা। বেশী নামডাক নেই, শান্ত সৌম্য মধ্যবয়সী ডাক্তার। কিছুক্ষণ একা কথা বলার পর শোভনকে সুগন্ধিত চকোলেট দিয়ে ওয়েটিং রুমে পাঠিয়ে লিপিকাকে ডাকলেন। লিপিকা প্রসাধন করে নি। সাধারণ সালওয়ার স্যুট, চুল টেনে বাঁধা, শুকনো ঠোঁট। ডাক্তার বোস একদৃষ্টে তাকিয়ে মিনিটদুই পর নরম গলায় বললেন,

মিসেস সরকার। ঘুম হয়না, তাই তো?”

লিপিকা বিস্ময়ে মাথা নাড়ে। ক্লান্তস্বরে বলে,

কার? আমার? হ্যাঁমানে, আসলে উনি,”

আপনার চেহারায় কী ভয়ানক ক্লান্তির ছাপ, যে কেউ এমনি দেখলেই বুঝবে। ডাক্তার হতে হবে না। কেউ বলেনি আপনাকে?”

না। আজ ওনাকে কত কষ্টে যে এখানে এনেছি

সে তো বুঝেছি। আর আপনার পরিশ্রম আর উদ্বেগ দু-একমাসের নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ঠিক?”

নিঃশ্বাস ফেলে লিপিকা, মাথা নাড়ে।

শেয়ার করার মানুষ নেই, তাই একা বয়ে বেড়াচ্ছেন সমস্তটা,”

আসলে সত্যি বলতে কী,”

সত্যি বলতে এটাইনিজে বুঝতে পারছেন না আপনিও ডিপ্রেশনের মাইল্ড স্টেজে আছেন। রেস্ট দরকার, ঘুম দরকার।

কৃতজ্ঞতা ছেয়ে যায় বুকের ভেতরটায়, গলা ধরে আসে। এমন বন্ধুর মতো করে কেউ কথা বলেনি। অনেক খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করেন ডাক্তার বোস, সে যতটা সম্ভব নিঃসঙ্কোচে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। কথা শেষ হলে জিজ্ঞেস করে,

ডাক্তারবাবু, ওঁর কি সত্যিই সিরিয়াস মানসিক সমস্যা?”

সিরিয়াস এখনও নয়, তবে টার্নিং টু বী। ডেমেনশিয়া অনসেটিং, আরও কমপ্লিকেটেড কিছু কিছুকঠিন কঠিন ডাক্তারি নাম শুনে লাভ নেই। মুড স্যুয়িং হয় খুব?”

আজকাল খুবই বেশী! কিছুদিন আগে এরকম করত না। অনলাইন কাউন্সেলিং কিছুদিন করিয়েছি।

ডাক্তার বোস প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে প্রশ্ন করেন,

মেডিক্লেম করা আছে? ব্যয়সাধ্য চিকিৎসা। ডেমেনশিয়া আটকানোর রাস্তা এখনও আবিষ্কার করা যায় নি। বরং গ্র্যাজুয়েলিযাক গে। ডোন্ট মাইন্ড, আপনার বয়স কত?”

ফিফটি সেভেন প্লাস। উনি প্রায় ন-বছরের বড়ো।

ডাক্তার মুখ তুলে দেখেন,

মাত্র? ও-কে। নিজের কেয়ার নিন ম্যাডাম। জীবন এখনও অনেক বাকি। ফিটফাট থাকুন, সাজগোজ করুন, মন তাজা রাখুন। না হলে লড়তে পারবেন না। সম্ভব হলে সারাদিনের জন্য একজন লোক রেখে নিন। বাজার দোকান?”

ওই অনলাইনই করি।

না, বাড়ি থেকে রোজ বেরোবেন অন্তত দিনে একবার কিছুক্ষণের জন্য। আসুন। অবশ্যই কন্ট্যাক্টে থাকবেন।

ফেরার পথ গাড়িতে বসে নিঃশব্দে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফেরে লিপিকা। শোভন পাশে বসে টের পায় না। খানিকটা পথ সে ঘুমোয়, বাকিটা অন্ধকারে তাকিয়ে বিড়বিড় করে। 

ওষুধে কাজ হয়েছে কিছুটা। শোভনের ঘুমের সমস্যা এবং অস্থিরতা খানিক কম। তবে কথা বিশেষ বলতে চায়না। আঁকার খাতা, রঙের বাক্স বন্ধ। দু-একবার সাবধানে জানতে চেয়েছে লিপিকা। ছোটো করে ‘ভালো লাগছে না বলেছে শোভন। খুব একটা ইচ্ছে না থাকলেও সেন্টার থেকে ময়না নামে একজনকে সারাদিনের জন্য রেখেছে লিপিকা। সকাল দশটা থেকে রাত আটটা। মেয়েটি শান্ত, সেন্টারেও সুনাম আছে। লিপিকা জোর করে আধঘন্টা সকালে, আধঘন্টা বিকেলে রাস্তায় বের হয়। হেঁটে বেড়ায়, দোকান থেকে টুকিটাকি জিনিস কেনে। আশেপাশের মুখচেনা অনেকে হেসে কুশল জানতে চায়, সেও প্রত্যভিবাদন করে। এতেই অনেকটা ফ্রেশ লাগে। ডাক্তার বোসের কথা মনে পড়ে। বয়স হলেও সুগঠিত সুপুরুষ, মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। ক্লিন শেভড, চোখা চেহারা। চশনার ভেতরে করুণার্দ্র চোখ। লিপিকা কেমন একরকমের ঘোরের মধ্যে ছিল সেদিন। তা সত্বেও এত খুঁটিয়ে দেখেছে! ডাক্তার বলেছিলেন,

মুশকিল কী জানেন ম্যাডাম, আপনি সব দায়িত্ব একার কাঁধে নিয়েছেন। মনে ভাবছেন আপনার সাহায্য দরকার হয় না, আপনি একাই একশ। দিনের যে কোনও সময়ে একবার আয়নায় নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবেন তো! আর, কান্না পেলে ভালো করে প্রাণ খুলে কাঁদবেন।    

রাতের দিকে শোভন ঘুমোলে খাতাটা নিয়ে ড্রইংরুমে বসল লিপিকা। পাতা উলটে উলটে দেখছিল। পরপর অনেক ছবি। কয়েকটি শুধুই স্কেচরঙ নেই। কয়েকটি অসমাপ্ত পেন্সিলের আঁকিবুকি। শেষ ছবিদুটি সম্পূর্ণ, কোণায় লেখা ‘শোভুর শেষ স্মৃতি। রঙে রেখায় অনবদ্য ছবিলিপিকা সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকে।

প্রথম ছবিতে কালো লোহার ভারী গেট। ভেতরে সবুজ লন, দুপাশে বড়বড় গাছের সারি। নীল আকাশ, মাঝখানে সুড়কির লাল পথ। পথের শেষে বাংলোর মতো দেখতে একতলা বাড়িটির রঙ সাদাটে হলুদ। সিঁড়ির ধাপ উঠে গেছে খোলা বারান্দায়। সে জায়গায় একটা গাছ থেকে সাদাসাদা কী ফল ঝুলছে, জামরুল হতে পারে। বারান্দার সিমেন্টে বাঁধানো বেঞ্চে পেছন ফিরে বসে আছেন কে যেন। একদিকে লম্বা হলুদ জানালা, লম্বা লম্বা শিক। ভেতরে দু-একজন দাঁড়িয়ে।  

কী আশ্চর্য ডিটেলিং, যেন দেওয়ালে প্রজেক্টারে দেখা যাচ্ছে। লিপিকা আনমনে পাতা উলটে পরের ছবি দেখে।

আড়াআড়ি আঁকা ছবিতে লাল ইটের ছোট্ট বাড়ি, মাথায় ঢালু অ্যাসবেস্টসের কালচে ছাদ। বাঁদিকে থামের গায়ে ইংরেজিতে ছোটো করে ‘মন্টেসরি লেখা। স্কুলের নামটা দেখা যাচ্ছে না। বিল্ডিং-এর গায়ে ছোটো-ছোটো দরজা। তার মাথায় নার্সারি, কে-জি ওয়ান, কে-জি টু লেখা। সারিবদ্ধ কিছু লাল-নীল পোশাকে ছোট ছোট মানুষের আকৃতি, স্কুলের বাচ্চারা হয়ত। সামনে দাঁড়িয়ে একজন মহিলা শাড়ি-পরা। ভীষণ মনোযোগ দিয়ে সে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। ছবিটা অমোঘ টানে টানতে থাকে। এছবি কবেকার ছবিশোভনের কোন্‌ শৈশবের? বলেনি কখনো।

ক্লান্তিতে চোখ ব্যথা করে। নিঃশ্বাস ফেলে ওঠে, ঘড়ির দিকে তাকায়, সওয়া এগারোটা। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়বে এবার। অ্যাকোয়ারিয়ামের দিকে চোখ যায়, আবছা আলোয় সব মাছ স্থির দেখাচ্ছে। সলমন? চমকে উঠে কাছে যায়, সলমন উলটে আছে জলের উপরিভাগে। পেট ফোলা। উলটানো খোলা চোখজোড়া লিপিকার মুখের ওপর ন্যস্ত।

গলা দিয়ে তীব্র আর্তনাদ উঠে আসার মুহূর্তে নিজের মুখ দু-হাতে চেপে ধরে সে, পাছে শোভনের ঘুম ভাঙে। সারা শরীর জুড়ে ঠাণ্ডা ঘাম। কোনওরকমে সোফায় বসতে গিয়ে কপালের কাছে সজোরে ঠুকে যায়। লিপিকা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

(ক্রমশঃ)

 

 

 


3 কমেন্টস্: