কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


ভোরের ভ্রম

সেবারেও পাহাড়ে বেড়াতে গেছি আমরা। মানে আমি আর আমার বউ। আমাদের বিয়ে হয়েছে বছর খানেক হলো। তখনো আমাদের প্রথম সন্তান আসেনি। NGP থেকে একটা জিপ ভাড়া করা হয়েছে। ছোকড়া ড্রাইভারটি বেশ চটপটে। বয়স কম হলেও দেখলাম পাহাড়ি পথে ভালই জিপ চালাচ্ছে। আমাদের এবারের যাত্রা পশ্চিম সিকিম। বউ নানা বইপত্র ঘেঁটে জায়গাটা খুঁজে বের করেছে। ঘিসাং না ঐ জাতীয় কি একটা নাম। জায়গাটার বৈশিষ্ট হলো, খুব বেশি লোক তার সন্ধান জানে না, অথচ সেখান থেকে বরফে ঢাকা হিমালয়ের বেশ কটা চুড়া দেখা যায়। তবে একটা অসুবিধেও আছে। সেখানে কোনো হোটেল নেই। তবে বউ বলেছে, সেটা কোনো সমস্যা নয়। জিপওলাকে বললেই সে নাকি কোনো পাহাড়ি মানুষের বাড়িতে থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা করে দেবে।

শুনে আমি বললুম,

- হাম ঔসা জায়গা মে কভি নেহি যায়গা।

বউ বললো,

- আলবাত যায়গা। আমি তো যায়গাই। তুম কো ভি টেনে হিঁচড়ে লে যায়গা।

সুতরাং যেতে হচ্ছে এবং যাচ্ছি।

ছোকড়া জিপ ড্রাইভারের উচ্চারনের দোষ আছে। ওর নিজের নাম বললো তুরুং। তুরুং কি নাম হয়? তার মানে আমি ধরে নিলাম ওটা গুরুং। NGPর স্ট্যান্ডে অনেক কষ্টে বউ তাকে পটিয়ে পাটিয়ে রাজি করিয়েছে ঐ পান্ডব‌বর্জিত জায়গায় যাওয়ার জন্য। সে রাজি হয়েছে পয়সার লোভে। আর বউয়ের তাকে ভরসা কারণ  সে নাকি একবার ঐ জায়গায় গেছিল।

তিন ঘন্টার পাহাড়ি পথের কিছুদূর সাথে অন্য গাড়ির চলাচল দেখেছি। তারপর তারা আর কেউ নেই। রাস্তায় শুধু আমাদের গাড়িটা। রাস্তাও খুব সুবিধের নয়। এই আছে এই নেই। চারদিকে উঁচু উঁচু গাছ। পাইন ছাড়া বাকি সব গাছই আমার অচেনা। বউ বকবক করছে তুরুং এর সাথে। রাজ্যের কথা। এমন সময় ধরাম করে একটা পাথর পাশের পাহাড় থেকে গড়িয়ে নেমে এসে পড়লো আমাদের জিপের ওপর। জিপের ওপর মানে জিপের বনেটের উপর।

পাথরটার যা সাইজ। আমাদের ওপর পড়লে সবাই চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যেতাম। সেই আঘাতে জিপটাও হড়কে গেলো অনেকটা। আমরা ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলাম। ওস্তাদ ড্রাইভার ছোকরাও ভয়ানক চমকে গেল। তবে নিজে চমকে উঠলেও পাথরের ঘায়ে চমকে যাওয়া গাড়িটাকে ব্রেক কসে থামিয়ে দিতে পারলো। আমরা সিটে বসে কাঁপতে থাকলাম। অতঃপর জানা গেলো পাথরের আঘাতে গাড়িটা ভালো রকম জখম হয়েছে।

তাই গাড়ি ঔর নেই যায়গা।

নেই যায়গা?

বলে কি। এই নির্জন পাহাড়ের মাথায় ভাঙ্গা অচল গাড়ি আর তিনজন মানুষ।

গাড়ি নেই যায়গা, সে নয় হলো। কিন্তু এখন হামলোগ কাঁহা যায়গা? এরপর তো দিন ফুরাকে রাত আয়গা। তখন কি হোগা। তখন তো এই জঙ্গল সে বাঘ ভাল্লুক আয়গা। আর ঠান্ডা তো আরো বাড়কে হাড় কাঁপায় গা। বাঘ সে বচা তো ঠান্ডাসে মর যায়গা।

তুরুং বললো। ডরিয়ে মত। ইঁহা বাঘ নেই হ্যায়। লেকিন আভি চলিয়ে। আশপাশমে কোই না কোই বস্তী তো জরুর হোগা। বঁহাই মিল যায়গা শেল্টার।

অনেক হেঁটে তবে একটা বস্তি পাওয়া গেল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাত্র সাত আটটা ঘর। সেটাই নাকি বস্তি। দূর থেকে বস্তিটা দেখিয়ে দিয়ে তুরুং উল্টো পথে হাঁটা দিল। ভাঙ্গা জিপের কাছে থাকতে হবে ওকে। এবং কি করে সেই ভাঙ্গা জিপ মেরামত করে সচল করা যায় তার উপায় করতে হবে।

- তবতক আপলোগ আরামসে ইস বস্তিমে রাত বিতাইয়ে।

আরামসে?! বলে কি হারামজাদা।?

বস্তিতে পা রাখতেই বস্তির জনা পাঁচেক লোকজন এসে আমাদের ঘিরে ফেললো। এরপর একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হলো। সে বৈঠক যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন অদ্ভুত। কারণ আমাদের ভাষা ওরা বোঝে না। ওদের ভাষা  আমরা বুঝি না। ফলে বৈঠকটা খুব লম্বা চললো। শেষমেষ মনে হয় আমরা তাদের এটুকু বোঝাতে সক্ষম হলাম যে আমরা বিপদে পড়েছি এবং আমাদের রাতে থাকার জন্য একটা আশ্রয় চাই।

সেটা বোঝার পর তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কিছু একটা স্থির করলো। তারপর আমাদের নিয়ে হাজির হলো একটা ঝুপড়ির সামনে। বিচিত্র দর্শন সেই ঝুপড়িটার একদিকে পাথরের দেওয়াল দেখা যাচ্ছে। সেটা সামান্য উঁচু। আর বাকিটা শুকনো পাতার চাল। চালটা একদিকে ঢালু হয়ে এসে মাটিতে মিশে গেছে। চোখ তুলে দেখলাম। বাকি ঘরগুলোর স্থাপত্য কৌশলও কম বেশি একই রকম। একটি মেয়ে এসে আমাদের ইশারা করলো এবং তারপর হামাগুড়ি দিয়ে পাতার নিচে দিয়ে ঐ ঢালু ছাদের ভেতর ঢুকে গেল। তার সেই ইশারার মানে follow me. এটা বোঝা গেল।

আমি আর আমার বউ ওর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ওর মতোই হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। খুব ছোটো একটা ঘর। এবং ঘরটা অন্ধকার। অথচ তখনো সন্ধ্যা হয়নি। বাইরে ভালই আলো আছে। নিরেট পাথরের দেওয়াল ঘেরা ঘরের কোথাও আলো আসার কোনো পথ নেই। মনে হলো অন্ধকারটা সেজন্যই।

বুঝলাম এই এলাকায় বছরের কোনো একটা সময়ে নিশ্চয় তুষারপাত হয়। তাই বাড়িগুলোর এরকম কনস্ট্রাকশন। কোথায় যেন পড়েছিলাম। বরফের দেশে এক ঢালের ঘর হয়।

এই ঘরে আসবাব পত্র বলে কিছু নেই। কিন্তু বড়ো সড়ো একটা লেপ জাতীয় কিছু ঘর জুড়ে ছড়িয়ে আছে। চোখে তো দেখা যাচ্ছে না কিছু কিন্তু সেটার অস্তিত্ব হাতে পায়ের ছোওয়া দিয়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। তবে সেই লেপ জাতীয় বস্তুটার ভেতরে তুলো ভরা নেই। ছোঁয়া দিয়েই বোঝা যাচ্ছে তার ভেতরে পাখির পালক বা পশুর লোম জাতীয় কিছু ভরা আছে। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হলেও ভেতরে কিন্তু দাঁড়ানো যায়। আমরা আমাদের স্যুটকেস আনিনি। সে সব জিপেই আছে। আনা হয়েছে একটা পিঠের রুকস্যাক। আর বউ এর অহঙ্কার ঝোলা। অর্থাৎ vanity bag। আমাদের সেই আঁধারে রেখে মেয়েটি বের হয়ে গেল। আমরা তাকে আবার অনুসরণ করার চেষ্টা করতেই সে গায়ে হাতের ঠ্যালা দিয়ে বুঝিয়ে দিল। This time don't follow me.

ও চলে যেতেই বউ এর আওয়াজ পেলাম।

- চলে এসো। একটু খসখসে কিন্তু বেশ গরম।

আওয়াজের উৎস সন্ধান করে দেখলাম ইতিমধ্যেই বউ দিব্যি ঐ লেপের তলায় সেঁধিয়ে গেছে। আমিও সেঁধিয়ে গেলুম। প্রথমেই বিটকেল একটা গন্ধ পেলাম। গন্ধটা আসছে ঐ লেপ জাতীয় বস্তুটার থেকে। হঠাৎ সেই দুর্গন্ধ ছাপিয়ে একটা সুন্দর গন্ধ পাওয়া গেল। কি ব্যাপার? ব্যাপারটা বউয়ের কীর্তি। তার অহঙ্কার ঝোলার মধ্যে সুগন্ধি স্প্রে ছিল। লেপের ভেতরে সেটাই স্প্রে করে দিয়েছে সে। অল্প কিছু ক্ষণের মধ্যেই আমরা উষ্ণ হয়ে গেলাম। গায়ে পরা জ্যাকেট আলগা করতে হলো।

বউ বল্ল, তোমার ঝোলায় টর্চ আছে না। সেটা বের করে জ্বালাও।

তাই করলাম। ছোটো টর্চ। সামান্যই আলো। সেই আলোতে দেখলাম ঘরটার চারদিকেই পাথরের দেওয়াল আছে। আর ছাদটা গাছের ডাল দিয়ে গড়া। তার ওপরে পাতার বোঝা চাপানো হয়েছে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সেই মেয়েটি এলো। তার হাতে একটা পাত্রে বেশ কটা সেদ্ধ ডিম। মুরগির না অন্য কোনো পাখির জানি না। কিন্তু সেগুলোই টপাটপ খেয়ে নিলাম দুজনে। বউ তার অহঙ্কার ঝোলা থেকে টাকা বের করে মেয়েটিকে ধরিয়ে দিল। বোধহয় সেটা একশ টাকার নোট হবে। মেয়েটি সেটা নিয়ে চলে গেলো। ঘরের কোণায় একটা ঝুলন্ত পাত্রে জল ছিল। মেয়েটি সেই পাত্রটি আমাদের এনে দিল। বউ কিন্তু  সেটা নিল না। আমার কাছে মিল্টনের ওয়াটার বটল ভরা জল ছিল। সেটা থেকেই জল খেয়ে তখনকার মত তৃষ্ণা মেটালাম আমরা। তারপর আর একবার সেন্ট স্প্রে করে আমরা লেপস্থ হলাম। এবং অচিরেই ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত কাটুক। সকাল হলে তখন দেখা যাবে তুরুং তার জিপটাকে সারাই করে "চলনেকা লায়ক" করেছে কি না। আপাতত ঈশ্বরকে সুক্রিয়া। তাঁর অসীম কৃপায় আমরা মারা পড়িনি। এবং রাতের খাবার ও উষ্ণ আশ্রয় পাওয়া গেছে।

অনেক রাতে মনে হলো কেউ একজন এসে ঠিক আমার পাশেই লেপটার মধ্যে ঢুকে পড়লো। কে কে জানে। আমার ঘুম একটু আলগা হয়ে আবার গাড় হয়ে গেলো। সে ঘুম ভাঙ্গলো সকালে। দেখলাম আগে যেমন ভেবেছিলাম ঘরের দেওয়াল তেমন নিরেট নিশ্ছিদ্র নয়। তার এক পাশে কয়েকটা ঘুলঘুলি আছে। তা দিয়ে ভোরের আলো ঘরে ঢুকছে। দেখে মনে হলো যেহেতু ঘুলঘুলিগুলো শুধু মাত্র ঐ একটা দেওয়ালেই। তাই সূর্য আকাশের উপর দিকে উঠতে থাকলে আর আলো আসতে পারবে না। আর সূর্য পশ্চিম আকাশে গেলে তখন তো নো আলো। তাই তখন ঘর হয়ে যায় ফুল অন্ধকার। কিন্তু এখন ঘর ভরে আছে নরম আলোয়। সেই আলোয় দেখলাম দুই ধারে দুই কলাগাছ আর মধ্যিখানে আমি মহারাজ। আমার দুপাশে দুজন ঘুমন্ত নারী। একজন আমার বউ। আর একজন সেই মেয়েটি।

ও হরি! তাহলে রাতে ইনিই এসে সেঁধিয়ে ছিলেন লেপে। সারারাত আমার পাশেই ছিলেন।

ক্যা তাজ্জুব কি বাত!

কিন্তু তাজ্জুবই বা কেন? এটা যদি তার ঘর হয় এবং সেখানে যদি এই একটাই লেপ থাকে তবে সে সেখানে ছাড়া আর কোথায় ঢুকবে?

আমি তড়বড় করে উঠে বের হতেই মেয়েটি চোখ খুললো। সেও উঠে পড়ল। তারপর ফিক করে হেসে দিল। হাসিটা সুন্দর কিন্তু মুখটা ময়লা। মনে হয় স্নান টান করেনি অনেকদিন। জানা ছিল পাহাড়িরা জলাভাব আর ঠান্ডার জন্য, মাসের পর মাস স্নান না করেই থাকে।

আমি ঘুরে দেখলাম বউ অকাতরে ঘুমাচ্ছে। মুখটা হাঁ করে। আমাকে মেয়েটি হাতের ইশারায় কিছু একটা বললো। আমি তার কিছুই বুঝলাম না দেখে সে আমাকে টপকে নিজেই হাত বাড়িয়ে আমার বউয়ের হা মুখটা আলতো করে বন্ধ করে দিল। সে সময় তার গোটা দেহটাই আমার কোলের উপর। কিন্তু সে দেহ পুরু পোষাকে ঢাকা। তাই ওজন আর দূর্গন্ধ ছাড়া অন্য কিছু অনুভবের সুযোগ নেই। তবু আমি ছটফট করে উঠে সরে গেলাম। আর লেপ থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মেয়েটিও সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার পর আমাকে হাতের ইশারায় ডাক দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে গেলো। এবারের হাতের ইশারার কমান্ড just follow me.

Follow করলাম।

সদ্য বিবাহিত। কিন্তু পুরুষ মানুষ তো। মন চন্চল হয়ে উঠলো।

ঘরের বাইরে বের হয়ে দেখি সদ্য ভোর হয়েছে। তার ফলে অবশ্যি পাখিরাই জেগেছে কেবল। তারা গাছে গাছে কিচিরমিচির করছে। গোটা বস্তি চুপচাপ। মনে হয় সেখানে আর কেউই জাগেনি। মেয়েটি আমাকে হাতের ইশারায় ডেকেই চলেছে। সুতরাং ফলো করতে থাকলাম। সে আমাকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামিয়ে নিয়ে চললো। আমার শরীরে মনে শিহরণ। এ কোন পার্বত্য অভিসার। এক সময় মেয়েটি থামলো। গাছের ফাঁক দিয়ে তেরছা আলো, স্পট লাইটের মতো এসে পড়েছে তার শরীরে, গায়ে মুখে। সেই আলোতে তার জোব্বার মতো ময়লা পোষাকটাকেও মনে হচ্ছে দারুন মহার্ঘ্য লহঙ্গা চোলি। মুখটাকেও আর ময়লা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সেটা একটা ফোটা ফুলের মতো সুন্দর। একেই বোধহয় ভোরের আলোর ম্যাজিক বলে। মেয়েটি হেসে আবার আমাকে ইশারা করলো। এবার তার ইঙ্গিত একটা ঘরের দিকে। এটা একটা ছাদ হীন ঘর। এটাই কি তবে আজ আমাদের অভিসারের জায়গা।

আমি একটা ঘোরের মধ্যে সেদিকে এগিয়ে গেলাম।

এবং অতঃপর স্বপ্নভঙ্গ হলো।

ঘরটা আসলে পাঁচিলে ঘেরা একটা ল্যাট্রিন।

ও হরি! ইসকা মতলব।

অন্য কিছু নয়। মেয়েটি আমাকে ভোরবেলায় উসখুস করতে দেখে ভেবেছে। সকাল হয়েছে সুতরাং আমার এখন এটারই প্রয়োজন।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন