কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪

তপনকর ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


চার্জ

দাশগুপ্ত, আমি… আমি বলছি…

আমি হাজরা মোড়ে বালীগঞ্জ ফা্ঁড়ির দিকে মুখ করে। আপনি আমাকে বলুন যে আপনি এখন ঠিক কোনখানে? মানে বলেছিলেন তো… বলুন দাশগুপ্ত… চার্জ চলে যাচ্ছে, প্লীজ বলুন, চার্জ নেই, দাশগুপ্ত… এ্যাই শালা দাশগুপ্ত…

চার্জ নেই। ব্যাটারির ক্ষমতা নেই চার্জ ধরে রাখার। আর্তনাদ করে ওঠে জনার্দন— কী হবে রে শালা তোর!

হা হা করে ওঠে জনার্দন। বুক থেকে থোকা থোকা হাওয়া বেরিয়ে যেতেই আবার হাওয়া টানে। বলে, শালা--শালা,জন্মশালা— কুত্তার জীবন তোর। এভাবেই অপদস্থ হওয়া তোর কপালে ছিল রে!

দাশগুপ্ত ছাড়া তো তার চলবে না। অথচ যোগাযোগের অন্য রাস্তা নেই।

হাতের চেটোয় মোবাইলের দিকে তাকায় জনার্দন। রং ওঠা, পুরনো, বিরক্তিকর। সেকেন্ড বা থার্ডও নয়, অনেক হাত ঘোরা এই রদ্দি মাল তার হাতে এসেছিল, মাস ছয়েক আগে। আলাপ হওয়ার পরে, টুকটাক করে দাশগুপ্তর কাজ শুরু করেছে যখন, সেরকম একটা দিন, জনার্দনের হাতে এই মোবাইলটা তুলে দিয়েছিল দাশগুপ্ত। বলেছিল, এটা রাখ। কাজ চলে যাবে। যতদিন চলে চলুক, তারপর একটা দেখেশুনে…

দাশগুপ্তর ঠিকানা সে জানে না। শুধু নম্বর। সেই যে বাংলার ঠেকে আলাপ, তারপর কাজ, ধান্ধার কথা, জনার্দনের কামাই, যা তেমন কোনদিনই না, তবু যা ছিল টুকটাক, কুড়িয়ে বাড়িয়ে, সেই সময় সেটুকুও হচ্ছিল না, দাশগুপ্তই মালের খরচা জোগাচ্ছিল, তারপর কাজ, দাশগুপ্ত তাকে কাজ দিয়েছিল, আর মোবাইল। এই খ্যাঁচা মালটা, সঙ্গে দাশগুপ্তর নম্বর।

নম্বরই ভরসা। যতবার টিপেছে, ওপারে খ্যানখ্যানে স্বর— আমি দাশগুপ্ত। সব ঠিক আছে তো? অথবা, কাজের খবর, কাজ শেষ করে তার খবর, নম্বর টিপলেই— হ্যাঁ হ্যাঁ , সব ঠিক আছে। পেমেন্টের কথা উঠলেই দাশগুপ্তর খ্যানখ্যানে স্বর ফ্যাসফ্যাসে। সঙ্গে খুকখুক কাশি। —আরে হবে হবে, ব্যস্ত হচ্ছ কেন?

আজ সেই পেমেন্ট পাবার দিন। হাজরা মোড়ে দেখা হবে — এতদূর ঠিকঠাক।  কিন্তু হাজরার চার মাথায় দাশগুপ্ত ঠিক কোনখানে জানতে জনার্দন নম্বর টিপতেই কিচাইন।ব্যাটারির চার্জ শেষ। জনার্দনের চটির সোল ক্ষয়ে ক্ষয়ে গোড়ালি থেকে উড়ে গেলেও, সে হাঁটতে পারে, যতক্ষণ তার নিজের ব্যাটারি ঠিক থাকে। কিন্তু মোবাইলের চার্জ শেষ মানে দাশগুপ্তকে না পাওয়া, যার আরে, কটা মানে পেমেন্ট না পাওয়া।

চার্জ আবার দেওয়া যায়। কিন্তু তাতে লাভ কতটুকু! চব্বিশের বদলে টানা আটচল্লিশ ঘন্টা চার্জে দিয়ে আজ বেড়িয়েছিল। তিন চার মিনিট দরকার ছিল, সবে দাশগুপ্ত সাড়া দিয়েছে, যদিও দাশগুপ্তর গেঁড়েমি ছিল, সে কখনো প্রথম চান্সে ফোন ধরে না, ধরলে চার্জ থাকতে থাকতে কথা হলেও হতে পারত, তবে এত তাড়াতাড়ি যাবে সে কথা দাশগুপ্ত তো বোঝেইনি, জনার্দনও বোঝেনি।

এবার যেন একটু বেশি, জলদি জলদি চলে গেলআর একটু সময়— কিন্তু হল না। এই না হওয়াটাই দস্তুর।তার যে কোন ব্যাপার— এরকমই।

চিরটা কাল। আটচল্লিশ ঘন্টা চার্জের পরেও  যে ব্যাটারি দু মিনিট ধরে রাখতে পারে না, দোষ তখন যতটা না ব্যাটারির, ক্যালানে জনার্দনও যে এর জন্য দায়ি— একথা পাবলিক বলবেই।— ও শালা তোর হাতে পড়েছে, এতদিন যে চলল সেই  না ঢের। ব্যাটারির আর কী-ই-বা দোষ!

এই প্যাঁচ পয়জারে জনার্দন হাঁপিয়ে ওঠে। না দৌড়, না হাঁটা— শুধু দাঁড়িয়ে নিজের মনে এসব কথা ভাবতেই যে এত হাঁপ— তার ভেতরটা তোলপার হয় আর বুকে  ধুকপুক শব্দ। এরপর কী হবে! দাশগুপ্তর সঙ্গে যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ — আবার চার্জ, আটচল্লিশে হল না,মানে বাহাত্তর, তাতে না হলে ছিয়ানব্বই ঘন্টা — যা দাঁড়াল, আরও চারদিন অপেক্ষা। এবং তারপর! এখানে জনার্দন ঠিকানায় ঢুকে যায়। ইস, কেন যে দাশগুপ্ত ঠিকানা দিল না বা, সে কেন নিল না। চাইলে হয়তো দিত, সে কেন চাইল না। না চাওয়ার হাতে গরম কারণ এই মোবাইল, দশটা সংখ্যা তুলে নিলেই হল,সঙ্গে নাম। এত আর স্মার্ট ফোন নয়,কম দামের ঝরঝরে মোবাইল, নাম আর পদবী এক সঙ্গে ধরে না, তাই কায়দা করতে হয়। নাম, ধরা যাক রতন, চার পাঁচজন রতন, তখন কী করবে? মোবাইল দেওয়ার সময় দাশগুপ্ত জনার্দনকে এভাবেই বুঝিয়েছিল— যে-ভাবে মনে রাখার সুবিধে, যেমন যেৃন রতন, তেমন তেমন ঢোকাতে হবে, আর এ-ভাবেই রতন (১), রতনদা, রতন কাকু, রতন মিষ্টি, রতন মুদি— এ-সব কথা বলতে বলতে দাশগুপ্ত নম্বর সেভ করার কায়দা দেখিয়ে দিয়েছিল। প্রথমে নম্বর, এই যে আমার নম্বরটা টিপে টিপে নিয়ে এলাম, এবার কী চাইছে দ্যাখ, নাম কী! কী লিখব? দাশগুপ্তই ভালো, তাই না? সব বলা হয়ে গেলে নিজের নম্বর সেভ করে দাশগুপ্ত জনার্দনের হাতে মোবাইল তুলে দিয়েছিল।

সেই থেকে দাশগুপ্তর এই খ্যাঁচাকলে জনার্দন। একটাই নম্বর, আর নেই। প্রয়োজন হয়নি,তাই নেই। এটারও দরকার হত না, যদি ঠিকানা দিত, কিন্তু এমন গান্ডু যে, কিছুতেই দিল না। কাজের কথা সব এই মোবাইলে, মাল পোঁছে দেওয়া, সাদা বাদামী খাম, প্যাকেট, নির্দিষ্ট জায়গায় জামার রং মিলিয়ে, কালো চশমা  অথবা গলায় সোনার চেন,মাথায় সবুজ টুপি— সব দেখেশুনে হাতে মাল তুলে দেওয়া---জায়গা যেমন, হাজরা পার্ক, আশুতোষ কলেজের দিকে, কৃষ্ণচূড়ার নিচে বা পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের পেচ্ছাপখানার পাশে।

আজ, এই পার্কের কোন ঘুপচিতে দাশগুপ্তর থাকার কথা, এবং সে কোথাও আছে তো বটেই, কিন্তু তা জনার্দনের নাগালের বাইরে। তার পেমেন্ট — দু হাজার টাকা, আর হল না ভাবতেই জনার্দনের বুক ধড়ফড়ানি, উঃ উঃ শব্দটা বুকেই, বুক থেকে গলায়---উফ্স। সেই সঙ্গে জিভে কামানো ঠোঁটের খরখরানি। একমাসের জমা দাড়ি গো্ঁফ টাকা পাবার আনন্দে আজ পয়সা খরচা করে বিদায় করেছে। কামানো জায়গায় চাটতে চাটতে সে ঘেমে নেয়ে সারা। ছিয়ানব্বই ঘন্টা মানে আরও চারদিন, এখনি বাড়ি ফিরে চার্জে দেওয়া মানে, আরও চারদিন – এক্ষুণি না রাতের দিকে — আর তখনই গোপু— গোপুর যা স্বভাব, জনার্দনকে দেখেই হাঁই হাঁই করে ওঠে, — অনেক্ক্ষণ ধরে তোর গেঁরেমি দেখছি। বিড়বিড় করেই চলেছিস। আ বে ক্যালানে, তোর কি বউ ভেগেছে? আ বে শালা জনার্দন — জন-জনা- জনার্দন —তোর মোবাইল না ও-টা?

জনার্দন গোপুকে মোবাইল দেখায়। বলে চার্জ হচ্ছে না। শালার ব্যাটারি সব শেষ করে দিল। একটা পেমেন্ট— এ শালার জন্য হল না। লোকটা কাছেই, কোথাও…

এ একটা ব্যাপার হল? তুই বাঁ… গান্ডুই থেকে গেলি… চ

পকেট থেকে গোপু তার মোবাইল বের করে। মোবাইলের পিছন ঠেলে ব্যাটারি। জনার্দনের মোবাইল থেকে ব্যাটারি খুলে নিজেরটা ফিট করে বলে, ডায়লগ করিয়ে দেব, বাট কথা আছে।

রক্তের ঝলকানি জনার্দনের মুখে, ---এত সহজ! দাশগুপ্তকে ধরা যাবে? নম্বর টিপলেই পেমেন্ট?

পেমেন্ট পেলে বাংলা? একটা পাঁইট? মনে থাকবে তো?

থাকবে না মানে— এক গাল হেসে ডি  টেপে জনার্দন, একবারের জায়গায় দুবার, তিন-চারবার, তারপর অস্ফুটে বলে, কিছু নেই তো!

কিছু নেই? বললেই হল? তোর যা, আমারও তা — একই কোম্পানি, এক মডেল… হাতে গরম পাঁইট ভো কাট্টা হতে পারে ভেবে গোপুর ডাউট হয়, সে মরিয়া ভঙ্গিতে বলে, ঢপ মারছিস না তো?

জনার্দন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ডি-এর উপর আঙুল রেখে টিপেই চলে…, মোবাইলে সাদা ফ্যাট ফ্যাটে আলো, নাম,নম্বর সব মুছে গেছে।

গোপুর বিশ্বাস হয় না। জনার্দনের থেকে মোবাইল নিজের আয়ত্তে নেয়। বলে, আগে ছিল?

ছিল মানে, আমি তো এটা দিয়েই করি।

শালা, বাটাম খেলে তোর ক্যাচরাপানা বেরিয়ে যাবে— বলে গোপু ডি টেপে কিন্তু সব সাদা।উবে গেছে? না কী ছিলই না?

একটাই তো নম্বর, দাশগুপ্ত…

মানে?

আমি আর কাকে করব?  দাশগুপ্তর সঙ্গে কারবার, ও-ই ভরে দিয়েছিল।

তোর মোবাইলে নম্বর ছিল? গোপু বিশ্বাস করতে পারে না। বাংলার পাঁইট বিশ বাঁও জলে। ভুতুড়ে মোবাইল! গোপু, যা ফোট— বলে ফুটপাথের ভিড়ে মিশে যায়।

এক হাতে ব্যাটারি,অন্য হাতে পেছন খোলা মোবাইল নিয়ে জনার্দন দাঁড়িয়ে থাকে।  সে জানে না, মোবাইলে ব্যাটারি লাগানোর কলা কৌশল।

হাজরা মোড় ছাড়িয়ে যদু ভট্টাচার্য লেন থেকে কালিঘাট রোডে পড়তেই জনার্দন একটা গলির মুখে রেশমিকে দেখল।পকেটে মাল্লু এলে ওই গলিতেই রেশমির ঘরে বেশ কয়েকবার,  পেমেন্ট পেলে আজও  যাবার টার্গেট ছিল জনার্দনের— এখন,বড়ো কথা একটাই— রেশমি মোবাইলে ব্যাটারি লাগাতে জানে।

রেশমির টাকার রেট একটু বেশি কিন্তু মালটা চাবুক। জনার্দন দেখল খদ্দের নিয়ে রেশমি গলির ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। জনার্দনের তাড়া নেই। পকেটে যতই ছ টাকা থাকুক, রেশমি নিশ্চয়ই ব্যাটারি ঢোকাতে টাকা নেবে না।

সেই নিশ্চয়তায় গোপু আশেপাশে না তাকলেও— ফোট শালা গোপু— বলতে পারে। তোর বাওয়াল একদিন তোর পেছনে—

গোপুর চোদ্দপুরুষ জনার্দনের বিড়বিড়ানিতে তার ঠোঁটের ফাঁকে। —তুই শালা বললি না, আমার ব্যাটারির চার্জ ঠিক আছে কী না, আায় না, রেশমির কাছে আয়, ওকে জিজ্ঞেস করে দেখ, ও জানে আমার ব্যাটারি কী রকম—

একা, নিজের মনে  খিকখিক করে হাসতে থাকে জনার্দন। হাসির মধ্যেই চোখ রাখে গলির ভিতরে। রেশমিকে ছাড়া চলবে না। রেশমিক তার খুব প্রয়োজন।

জনার্দন দাঁড়িয়ে থাকে, রেশমি কখন ফাঁকা হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন