কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন

 


(১৩)                   

একটা সময় অবধি শিক্ষিত বাঙালি মাত্রই বামপন্থী ছিলেন। সেটাই স্বাভাবিক ছিল। ব্যতিক্রম কতিপয় বনেদি এদেশি যেখানে বয়স্ক মানুষরা আমৃত্যু কংগ্রেসী। এটা ঘটনা যে, বামফ্রন্ট জমানা বাঙালির চেতনা অনেক উন্নত করেছে। মননশীলতার দিক থেকে ব্রিটিশ রাজধানী হওয়ার কারণে এবং পরবর্তীকালে দীর্ঘ বামফ্রন্ট আমল বাঙালি গো বলয় থেকে সর্বদা আলাদাই গুরুত্ব পেয়েছে। সমাজতত্ত্ব যতটা ছিল তেমনই ছিল নেতাদের ডেডিকেশন ও ক্যারিশ্মা। সেই সময় নিয়মিত পার্টি অফিসগুলোতে ক্লাস হতো সোশালিজম ও কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো সম্পর্কে। পার্টি ক্যাডারদের মধ্যে শৃঙ্খলা ছিল। প্রমোদ দাশগুপ্ত, বিনয় কোঙারের মতো মানুষ পার্টিকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু প্রথম দশ বছরের পর থেকে ধীরে ধীরে ভোল পাল্টে যেতে লাগল। বামফ্রন্টের প্রধান অবদান ভূমি বন্টন ও কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন আনা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের উদার হস্তে জমি দান ও শিক্ষকতা সহ নানা সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়া, যাতে কয়েক প্রজন্ম এই ঋণদায়ে নত হয়ে ভোট দিয়ে যায় পার্টিকে। তা হয়েছিল। শিক্ষকরা এই কৃতজ্ঞতাজালে আবদ্ধ হয়ে ক্লাস ফেলে চলে যেতেন মাঠে ময়দানে মিছিল করতে মিটিং করতে। সীমান্ত উদার হতে জনবিস্ফোরণ দেখা দিল। অসংখ্য তরুণ হয়ে গেল পার্টি ক্যাডার। শুরুতে যারা ক্যাডার ছিল সংখ্যা বৃদ্ধি হয়ে তারা পাড়ায় পাড়ায় উচ্ছৃঙ্খল মস্তানে রূপান্তরিত হলো। আমাদের চোখ থেকে সরে গেল সেই অলীক অর্থনৈতিক তত্ত্ব। সাধারণ মানুষ দেখল সেই ক্যাডারবাহিনীর চোখ রাঙানো, ঘরের সমস্যায় মাথা ছড়ি ঘোরানো, গড়িয়ার খালে মরা গরু মোষের সঙ্গে ভেসে আসা লাশ। নতুন শব্দ ‘তোলাবাজি’। পরবর্তীকালে যারা যখন ক্ষমতায় তারা সেখানেই রং পাল্টে  ছড়িয়ে পড়ল, কেউ কেউ মস্তান থেকে নেতা চামচা হয়ে গেছে। যাইহোক, ছাত্রাবস্থায় এস এফ আই করতাম। তবে একসময় পার্টির কাজে ও আদর্শের ফারাক বীতশ্রদ্ধ করে তুলল। তবুও দলকে ধরে রাখার কাজটি মূলত করে গেছেন অনিল বিশ্বাস আমৃত্যু। বিমানদা ব্যক্তি মানুষ হিসেবে চির শ্রদ্ধেয়। সুভাষ চক্রবর্তী চিরকাল দল নির্বিশেষে যেই তাঁর কাছে যেত সাধ্যমত সাহায্য করতেন। সেই কারণে তাঁর অগাধ জনপ্রিয়তা  হয়ত বামফ্রন্টের একটি শাখার শিরঃপীড়ার কারণ হয়। অন্যথায় সাধারণ মানুষ এই সফেদ এলিটিস্ট শাসকদের দেখা পেত না। ধীরে ধীরে সৎ ও ডেডিকেটেড কমরেডরা বিদায় নিলেন। মানুষের মনে ক্ষোভ বাড়ছিল। শিল্প কারখানাগুলি প্রায় লকাউট ইউনিয়ন শাসিত বয়কট অর্থনৈতিক স্থবিরতা সৃষ্টি করল। কংগ্রেস রাজনৈতিক ফয়দা নিতে ব্যর্থ হলো, কিন্তু ছাত্র পরিষদ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরণ হতে থাকল। প্রথম দশবছরের পর এই চৌত্রিশ বছরের শাসনকালে ‘সর্বহারা’ শব্দটি আর ব্যবহার হয়নি।

এই বিশেষ রাজনৈতিক পটবদলের সময় আমাদের প্রজন্মের দোটানার সময়, কারণ গভীর পাণ্ডিত্যের বয়স হয়নি সেই সময়। অনেকগুলি কথা পরস্পর সম্পর্কহীন বা সম্পর্কযুক্ত মনকে নাড়া দিত। সোশালিজম না বাস্তব উন্নয়ন অথবা দুটির সুষম ভারসাম্য, হঠাৎ তুলে দেওয়া হলো ইংরেজি প্রাথমিক স্তর থেকে, যাতে শ্রেণীবৈষম্য আরও প্রকট হয়, এমন একজন নেতা ছিলেন না অথচ যাঁদের ছেলেপুলে সরকারি স্কুলে পড়েছে। নিরঞ্জন হালদারের ‘নৈঃশব্দের আড়ালে মরিচঝাঁপি’ পড়েছি এইসময়। তবুও এই চৌত্রিশ বছরের বাম শাসন বাঙালি মানসে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকাশে সহায়তা করেছে ব্যাপক। যাবতীয় সাহিত্য সৃজন কবি চিত্রী  নাট্যকার ও বুদ্ধিজীবী উঠে এসেছেন এই সময়। এরপর শুরু অবনমন। তবু একটা আক্ষেপ থাকেই যে সি পি এম যদি তার শরিক দলগুলিকে যোগ্য সম্মান ও গুরুত্ব দিত একতা থাকত তাহলে...

আমার পিতৃদেবের কারণে দুটি অভ্যাস গড়ে উঠেছিল শৈশব থেকে। এক বই পড়া এবং দুই পেন ফ্রেণ্ডশিপ। মোবাইলহীন সেই যুগে দেশ ও বিদেশের অন্য রাজ্যের সমবয়সীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। মেসেজ নয় বিস্তারিত বিশদ ভাবনার আদানপ্রদান খামে ভরে আসা যাওয়া। পাওয়ার অপেক্ষা। তাই সংকীর্ণ ছোটো চিন্তা কখনও মনে আসেনি। যা হয়েছে তা আবেগের দাসত্ব করতে গিয়ে, আসক্তিজনিত ভুল।

 

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন