কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯

শিবাংশু দে




হরীতকী ফলের মতন  


 (৬)


'কাগজকলম নিয়ে চুপচাপ 'সে থাকা প্রয়োজন আজ;
প্রতিটি ব্যর্থতা, ক্লান্তি কী অস্পষ্ট আত্মচিন্তা সঙ্গে নিয়ে আসে।
সতত বিশ্বাস হয়, প্রায় সব আয়োজনই হয়ে গেছে, তবু
কেবল নির্ভুলভাবে সম্পর্কস্থাপন করা যায়না এখনো।
সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও
মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
বর্ণাবলেপন গুলি কাছে গেলে অর্থহীন অতি স্থূল বলে মনে হয়।
অথচ আলেখ্যশ্রেণী কিছুটা দূরত্ব হেতু মনোলোভা 'য়ে ফুটে ওঠে।...'

আমার বন্ধু সন্দীপ একটা কবিতার কাগজ বার করে। বেশ কিছুদিন ধরেই বলছে, 
পরের সংখ্যার জন্য অন্তত গোটা দশেক পদ্য ওর চাই। বড়ো অস্থির সময় যাচ্ছে
আজ। কতোবার বসার চেষ্টা করলুম, কতো খসড়া। কতোবার  প্রথম দু'তিনটে 
লাইন লেখার পরে নিরাশ ছিঁড়ে ফেলা। অথচ কতো কথা বলার বাকি থেকে যাচ্ছে,
কতো চমক দেওয়া শব্দবন্ধ মাছির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে মাথার চারিধারে। কিন্তু শাদা কাগজে কালো অক্ষরে তারা ধরা দিতে চাইছে না। মাঝে মাঝে হয় এমন। সেবড়ো 
সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়। নিজেকে বাহুল্য বোধ হতে থাকে। 
গানের কাছে যাই, মানুষের কাছে যাই, বইয়ের কাছে যাই, কিন্তু শব্দ বাঁধার রেশগুলো খুঁজে পাইনা। প্রিয় কবিদের প্রচুর পদ্য বারবার পড়ি, কতো জাদুর মতো
 প্রতীক, তৈরি শব্দের মায়া মাথায় ঝিলিক দিয়ে পালিয়ে যায়। পদ্যের শরীরে যদি প্রাণটাই প্রতিষ্ঠা না করা গেলো তবে তার অলঙ্কার কী প্রয়োজন। মৃতদেহের মাথায় হিরের মুকুট?

হঠাৎ চোখে পড়ে গেলো বিনয়ের ১৪ই অক্টোবর ১৯৬০, এই কবিতাটি। ফিরে এসো চাকায় সংকলিত রয়েছে। এই কবিতাটিই যেন আমি লিখতে চাইছিলুম। কিন্তু অপচয় ছাড়া আর কিছুর নাগাল পাচ্ছিলুম না।

'.... হে আলেখ্য, অপচয় চিরকাল পৃথিবীতে আছে;
এই যে অমেয় জল- মেঘে মেঘে তনুভূত জল-
এর কতোটুকু আর ফসলের দেহে আসে বলো?
ফসলের ঋতুতেও অধিকাংশ শুষে নেয় মাটি।
তবু কী আশ্চর্য, দ্যাখো, উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে
তার এই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সংগীতময় হয়।

পর্ণার সঙ্গে শেষ যতোবার দেখা হয়েছে, জানতে চেয়েছে, নতুন কিছু লিখতে পারলুম কিনা  প্রশ্ন করেছে, গান শুনিয়েছে, কিন্তু লেখাটা আর হয়ে ওঠেনি। ওকে এইকবিতাটা এখুনি শোনাতে হবে। কিন্তু ওকে এক্ষুনি পাই কোথায়?




(৭)


রোববার সক্কালে গানের ক্লাস থাকে রবীন্দ্রভবনে।  সময় তিনচার ঘন্টার জন্য  পর্ণাকে হাইজ্যাক করা  যেতে পারে। যদিও ওর সঙ্গে দেখা করার জন্য আমার অতোঅ্যাডভেন্চার করার দরকার নেই। ওকে বাড়ি থেকেই ডেকে নিতে পারি নির্দ্বিধায়। কিন্তু একটু আলোছায়া লাগে। রোদের সঙ্গে মেঘ না থাকলে বেঁচে থাকাটা কী বোরিং হয়ে যায়।

 যথারীতি জুবিলি পার্কের গেটের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকি সকাল সাড়ে আটটার  সময়। বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে এই ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। কপার ব্লু শাড়ি আর শাদা স্টোলে ঝলমল। বেঙ্গল ক্লাবের দিক থেকে তিনি হেঁটে হেঁটে আসছেন। কোনও দিকে দ্যাখেনা কেন? এতো অন্যমনস্ক ছন্দে অনুষ্টুপ চলন। পাইপলাইন ফ্ল্যাটের দিকে বাঁকার আগেই ধরে ফেলি,
 -এই যে নমস্কার...
-আরে   , আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম...
-সে কী তুমিও ভাবো? ওটা তো আমার একচেটিয়া বার্ডেন বলেই জানতুম।
-দ্যাখো সকাল সকাল মেজাজটা খারাপ কোরোনাতো...
-না না, সে অধিকার আমার আছে কোথায়?
-এখানে কী করছো?
-এই তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি...
-ওহ বুঝেছি, মধুরিমাও  গানের ক্লাসে ভর্তি হয়েছে নাকি?
কোথায় হলো? এতো করে বললুম, আমি সকালে বাইকে করে পৌঁছে দেবো আবার ফেরার সময়েও বাইকের ব্যবস্থা থাকিবে... কিন্তু শুনলে তো...
-কেন শুনলো না?
-বোধ হয় তোমার ভয়ে....
-আমার ভয়ে? আমার বয়েই গেছে....
-তাও বলেছিলুম, কিন্তু মানলো না.....
-দ্যাখো, এই রাস্তার উপর তোমাকে মারবো...
-দেবি, স্মরগরলখন্ডনং মমশিরসিমন্ডনম..... আমি প্রস্তুত,
-আর ভাঁড়ামি কোরোনা...
-বেশ করবো না, তবে একটা সিরিয়াস কথা আছে...
-এতো সকালে সি-রি-য়া- কথা !!
-না, মানে তুমি আজ গানের ক্লাসে যাচ্ছো না...
-পাগল নাকি? আজ বাকি আদ্ধেকটা গান শেখানো হবে....
- আমি শিখিয়ে দেবো, সেই তো দুলে দুলে 'তোমার সুরের ধারা'
না-, 'সুখহীন নিশিদিন...'
রাম, রাম, দিনটাই খারাপ যাবে...  সব ছাড়ো... আজ আমরা দোমোহানি যাচ্ছি।  তুমি পাগলের গপ্পো শুনতে চেয়েছিলে না, গায়ত্রী কে? সেই গপ্পো করবো আরএকটা অদ্ভুত পদ্য, মনে হয় আমারি লেখা, কিন্তু , আমার জ্ঞান হবার আগে থেকে বিনয়ের নামে ছাপা আছে।
চলো...

শীতের সুবর্ণরেখা আর খরকাই অপেক্ষা করে আছে, অপেক্ষা করে আছে তার ঋজু ধৈর্যশীল শালবন, উত্তুরে হাওয়ায় তারা পদ্যের উড়ে যাওয়া পরাগমোচনেরসাক্ষী  থাকবে কি ...

উনকি তমন্না দিলমে রহেগি
শম্মা ইসি মহফিলমে রহেগি
ইশকে মে জীনা, ইশকমে মরনা
অওর হমেঁ ক্যা করনা হ্যাঁয় ফির...



 (৮)

          
'...অথচ পালঙ্করাশি আছে,
রাজকুমারীরা আছে- সুনিপুণ প্রস্তরে নির্মিত
যারা বিবাহের পরে বারংবার জলে ভিজে ভিজে
শৈবালে আবিষ্ট হয়ে সরল শ্যামল হতে পারে।
এখন তাদের রূপ কী আশ্চর্য ধবল লোহিত।
অকারণে খুঁজে ফেরা;...'

রেঙ্গুনে জন্মেছিলো ছেলেটি, তার পর তারা সপরিবারে চলে আসে পশ্চিমবঙ্গে। শৈশব থেকে অংকপাগল। গণিতের মধ্যে খুঁজে পাওয়া ক্রমান্বয় যুক্তির সমারোহ, তার  গভীর সাংখ্য যাত্রা, অমেয় শুশ্রূষার স্বাদে মজে ছিলো সে আজন্মকাল। তাই কি  যুক্তিহীন পৃথিবীর প্রখর চাপ, দুয়ে দুয়ে পাঁচ হওয়া ঘটনাসমূহ, তাকে স্বাভাবিক সংসারী মানুষের বৃত্ত থেকে অনেক অনেক দূরে নিয়ে ফেলে দিয়েছিলো। তাঁর  কাব্যগুরু যেভাবে লিখেছিলেন, '...মরণ তাহার দেহ কোঁচকায়ে ফেলে গেল মিরুজিননদীটির পারে', অনেকটা  সেরকমই। মিরুজিন নদী তাঁর জন্য হয়ে যায় উত্তর চব্বিশ পরগণার ঠাকুরনগর  গ্রাম। গাণিতিক মস্তিষ্কের শ্রেয় ফল তাঁকে নিয়ে যায়শিবপুর কলেজে। সাফল্যের সঙ্গে মেকানিক্যাল ইনজিনিয়ারিং উত্তীর্ণ হন। উচ্চপদের বৃত্তিও লাভ করেন সম্মানের  সঙ্গে। প্রথম কবিতার বই,'নক্ষত্রের আলোয়'রুশ ভাষায় পন্ডিত।  ভাষায় লেখা  বৈজ্ঞানিক বইগুলি বাংলায় অনুবাদ করার কাজ করেছেন বহুদিন। হাংরির একজন  মুখ্য সদস্য। পরে দূরত্ব তৈরি হয় শক্তিরসঙ্গে। তাঁর গাণিতিক মস্তিষ্ক বাংলা কবিতায় আনে এক অন্যধরনের জঁর।

গায়ত্রী চক্রবর্তী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরিজি  বাংলায় সোনার  মেডাল পাওয়া মেয়ে। দুরন্ত সুন্দরী, অসম্ভব মেধাবী। যেকোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষী   পুরুষেরইএমন একজন নারীর সাহচর্য পাবার স্বপ্ন কখনও শেষ হয়না। বিনয়ের  স্বপ্নও কখনও শেষ হয়নি, চিতাকাঠ পর্যন্ত গেছে সম্ভবত। গায়ত্রী কলকাতার পাট  চুকিয়ে চলেযান কর্নেল ইউনিতে, সেখান থেকে বহু সারস্বত সাধনার জয়টীকা  অর্জন করে শেষ পর্যন্ত কলাম্বিয়া ইউনিতে অধ্যাপক। নারীবাদ, ইতরযান   সমাজতত্ত্বের ক্ষেত্রেএকটি আন্তর্জাতিক নাম। তিনি কি কখনো জানতে পেরেছিলেন বিনয় মজুমদার নামে এক যুবক তাঁর জন্য উত্তীয়ের মতো অপেক্ষা করে আছে?   রহস্যের কোনওপাথুরে উত্তর এখনও নেই। শুধু আছে ফিরে এসো চাকা। বাংলা কবিতার সর্বকালের একটি প্রধান কাব্যসংকলন; আমাদের মতো ইতরজনের জন্য।   

বিনয় কখনও বিবাহ করেননি, গায়ত্রী স্বল্পকালের জন্য স্পিভাক সাহেবের বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন।

কোনও পালঙ্করাশি ছিলোনা কোথাও, যা জীবনে ন্যূনতম রোমাঞ্চ এনে দিতে পারে। ছিলোনা  রাজকুমারীরা, যারা বিবাহের পর জলে ভিজে ভিজে শৈবালের মতোকোমল শূশ্রূষা এনে দেয় মানুষের মনে। সাগরহংসীর শুভ্র গান কখনও আসেনি। খুঁজে ফেরা অকারণই রয়ে গেছে,
'...আমাদের দেহের ফসল, খড় যেন ঝরে গেছে, অবশেষে স্বপ্নের ভিতরে।
এত স্বাভাবিকভাবে সবই ব্যর্থ-ব্যর্থ, শান্ত,ধীর।'



(৯)


টাটাবাবার শহর যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো কখনও হেঁটেছেন শহরের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের সেই মায়াবী কোণটিতে। যেখানে উত্তরবাহিনী পাহাড়ি বন্য নদী খড়কাই এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পূর্ববাহিনী সুবর্ণরেখার বিস্তৃত  স্রোতধারায়। জায়গাটির নাম দোমোহানি। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, এই যুগ্মধারার সব তীর জুড়ে  ছিলো অগণিত প্রাংশু শালের সমারোহ। সবই অতীত?  তাইতো তাইতো...

বাইক থেকে নেমেই পর্ণা বললো,
 দ্যাখো, জল কতো নেমে গেছে...
আমি বলি, তা বটে, কিন্তু দেখতো কতো পাথর  জেগে উঠেছে এই ফাঁকে। কেউ  কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, আরো কেউ জেগে থাকে। মানুষের দিন ফুরোয় না কখনও।জল হয়ে, পাথর হয়ে, বেঁচে থাকাটাই তো মুখ্য...
ওসব থাক, তুমি গায়ত্রীর গল্প বলো...
সব গায়ত্রীর গল্প কিন্তু তৎসবিতুর্বরেণ্য হয়না, সুরায় উন্মত্ত হয়ে পদাঘাতে বিচূর্ণ  হওয়া পুষ্পাধারের মতো পরিতাপহীন জীবনের গল্পই শুনতে পাবে তুমি...
 তারপর ছাড়া ছাড়া সংলাপে শোনে বিনয়, সুবিনয়, দুর্বিনয়ের...


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন