কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৬

বারীন ঘোষাল

কৌরবের  এক্কাদোক্কা  দিনগুলো



পুরানো সেই দিনের কথা আজকের অভিজ্ঞতার ছাঁকনি দিয়ে বলা যায় না। তোমাদের টাইম মেশিনে আমাকে সত্তর দশকের গোড়ায় পৌঁছে দাও যেখানে স্বপ্ন ছিল কিন্তু নো নিয়তি, অভিজ্ঞতা নেই, সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সঠিক বলা যাবে আমাদের এক্কাদোক্কা কবিতা দিনের কথা। সেটা তো হবার নয়। অভিজ্ঞতা আমাকে আর আমাদের একটা ব্যাপারকে একদম বদলাতে পারেনি। তা হলো আমাদের ধারণা, যে, আমি বা আমরা  তখনও, এখনও, যা করেছি বা করছি তাই ঠিক। শ্রেষ্ঠ কাজটা করছি। আমাদের কাগজ শ্রেষ্ঠ। আমাদের জীবনযাপন সবচেয়ে ভালোএটা ঢাক পিটিয়ে বলি না। কিন্তু  ফল্গুধারার মতো এই অন্ধবিশ্বাস আমাদের ১০০ সংখ্যা পর্যন্ত টেনে নিয়ে এলো কৌরব যদি স্থির করে - এই কাজটা করবে, তাহলে টাকা পয়সা সামাজিক সাংসারিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনো বাধাই থামাতে পারবে না। এসব কী করে হলো, সেই প্রাথমিক দিনগুলোতে ফিরে যাই চলো

পড়াশুনো শেষ করে বাড়ি ফিরে প্রায় বেকার জীবন কাটাচ্ছি, তখন ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি, আমার এক পুরনো বন্ধু সুভাষ ভট্টাচার্য দুজন যুবকের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলো। সুভাষ বেকার, তখন একটা নাইট কলেজে বি-এ পড়ে, মেয়েদের সাথে মেশা পছন্দ করত ব’লে। সেই কলেজেরই তার একজন সদ্য ঘনিষ্ঠ কমল চক্রবর্তীর সাথে আলাপ করিয়ে নাম বলল, দ্বিতীয় জন অরুণ আইন, কমলের পাড়ার বন্ধু। দুজনেই কবিতা লেখে, তুই আর আমিও তো মাঝে মাঝে এখন চারজন হলাম। আড্ডা শুরু হয়ে গেল।


অবাঙালি বেকার ছেলেরা নানা রকমের ধান্দা করে রোজগারের। বেকার বাঙালি  যুবক টিউশন পড়ায়, নয়তো কবিতা লেখে নাটক করে, অথবা তাস ক্যারাম। জামশেদপুরে নাট্যচর্চার পরম্পরা ছিল, কিন্তু কবিতা চর্চার একদম না। আমরা তখন পর্যন্ত নিখিল বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, টেগোর সোসাইটি, টেগোর পরিষদ এসবই চিনতাম আর পিকনিক পার্টি মনে করতাম ওগুলোকে। আমাদের পরিবারে কেউ কোনোদিন  সাহিত্য করেনি। কো্নো প্রকাশনী বা আমলা ছিল না আমাদের, নিদেন কোনো  যশোলোভী কোম্পানির বড় অফিসার বা ব্যবসায়ী। আমাদের বাবারা ছিলেন টিস্কোর কর্মচারী। কবিতার কথা ভাবা তো দূরের কথা, আমাদের বেকার জীবনকে অভিশাপ মনে করতেন।

এরকম এক টাঁড় জমিতে আমরা চারটে বীজ নিজেদের পুঁতে ফেললাম। কিছুদিনেই ফুটে বেরলো চারটে চারা-মানুষ। সুভাষের বাড়িতে ঘেরা বারান্দায় বসে আমরা  বর্ষায় একদিন কবিতা পড়া শুরু করলাম। কবিতা সম্পর্কে প্রাক অভিজ্ঞতা তখন স্কুল কলেজের পড়া এবং পুজো সংখ্যা বাণিজ্যিক সাহিত্য পত্রিকা। সুভাষদের কোয়ার্টার্সের বাগানে ছিল একটা পেয়ারা গাছ। সেই পেয়ারাকে আমরা বলতাম কবিফল। কবিফল খেতাম আর সুভাষের মা চা বানিয়ে খাওয়াতেন। একমাত্র সুভাষের বাবা যাত্রাশিল্পী ছিলেন বলে কাব্যসৃষ্টিতে ওদের বাড়িতে আমরা ছাড় পেতামকবিতা পড়ে যে যা বুঝি আলোচনা করতাম। সুভাষ বলল – এসব রেকর্ড করা হোক। আমরা খাতা কিনে কবির নাম কবিতার নাম আর আলোচনাগুলো লিখতে শুরু করলাম। সে আলোচনা শুধু মতামত নয়, প্রশ্নের উত্তরও দিতে হতো। টের পেলাম পড়াশুনো খুবই সীমিত। ক্রমশ দল ভারী হতে লাগল। দেখা গেল এক একদিন ৮-১০ জন ৪-৫-টা করে কবিতা পড়ছে আর ১৫-১৬ জন আলোচনা করছে। সুভাষদের পাড়ার একটা খালি বাড়িতে আড্ডা সরিয়ে নিলাম। প্রথম দিকে সপ্তাহে একদিন, পরে দুদিন আড্ডা বসতো। ঝড় জল শীত গ্রীষ্ম বাবার চোখরাঙানি উপেক্ষা করে, প্রেমিকার আর্তনাদ, রাজনৈতিক ভ্রূকুটি, পুলিশের শাসানি উপেক্ষা করে আমরা চালিয়ে গেলাম কবিতা চর্চাআমাদের নিষ্ঠা দেখে বাড়ির লোকরাও মেনে নিলো। ক্রমশ ভ্রাম্যমান হয়ে উঠল আমাদের সভা। আমাদের বাড়িতে, প্রত্যেক পাড়ায়, ক্লাসে, কলেজে, চায়ের দোকানে, কখনো জোর করে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে, কখনো আমন্ত্রিত  হয়ে কবিতা পাঠ চলল। সুভাষ শীর্ষাসন করে কবিতা শুনতো। ওতে নাকি শোনার ভলিউম বেড়ে যায়। একাদিক্রমে ৩০০ সভা শেষ করে ১৯৭২ সালে আমরা থামলাম। ততদিনে কৌরব বেরিয়েছে।

ঠিক করেছিলাম - জামশেদপুরের সাহিত্য যে পথে হেঁটেছে সে পথে আমরা যাব না। পড়াশুনো শুরু করলাম। ততদিনে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুভাষ মুখোপাধ্যায় পড়া হয়ে গেছে, আমরা হাংগ্রি সাহিত্য আর ইতিহাস শেষ করলাম। তারপর বোদলেয়ার, ফরাসী কবিতা, বাংলার পঞ্চাশ ষাট। ছন্দাভ্যাস, আঞ্চলিক আকাড়া জীবন ও ভাষা আর শ্লীল অশ্লীল মোছা যৌনতা হয়ে উঠল টুল। প্রথমেই জামশেদপুরে ব্রাত্য হয়ে পড়লাম। নিখিল বঙ্গ মার্কা প্রতিষ্ঠান দেখলেই ইয়ে জ্বলে যেত। তারা আমাদের অসভ্য বাঁদর বলে জানলো এবং তাদের ছোট কাগজে নিন্দা করলতাদের সভায় নিমন্ত্রণ না করলেও জোর করে ঢুকে পড়তামসাকচি গোলচক্করে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়লাম।  কোনো কমার্সিয়াল সাহিত্যিককে কোনো কলেজ বা ক্লাব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ডেকে  আনলে আমরা বাইরে কবিতা পড়ে ভিড় জমাতাম। নক্সালবাড়ি আন্দোলনের আঁচ জামশেদপুরে পৌঁচেছে। কিছু ছেলেপুলের চোখ তখন লাল হতে শুরু করেছে - তারাও আমাদের বিরোধিতা শুরু করল সি আই এ-র দালাল ব’লে। মাঠে বসে আড্ডা মারছি, বন্দুকধারী পুলিসের জিপ আমাদের ঘিরে ধরল উগ্রবাদী ব’লে। জীবনানন্দের মৃত্যুদিবস পালন হলো জনা পঞ্চাশ মোমবাতি হাতে রাত্রিবেলা মোর্চাবন্দী মৌন মিছিল  ক’রে। বেঙ্গল ক্লাবে রবীন্দ্র বিষয়ক ভাষণরত সন্তোষকুমার ঘোষকে - আপনি থামুন মশাই, কিছু জানেন না - ব’লে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলাম। ঘোর বর্ষার কারণে রবীন্দ্র পরিষদ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই সভার স্থান পরিবর্তন করলে সেখানে হাজির হয়ে টেবিল উল্টে দেওয়া... ইত্যাদি আচরণে কুখ্যাত আমরা এইসব বিরোধিতা এবং নিন্দা সত্ত্বেও জেদ না ছাড়ায় ভদ্রজনেরাও গুটিগুটি আমাদের সভায় হাজির হতে শুরু করলেন। প্রথম পাঠসভায় আমরা চারজন, আর তিনশোতম সভায় উপস্থিত ছিলেন ২০০ জন। এতে তিনটে ভালো কাজ হলোএক স্বদেশ সেন নিখিল বঙ্গ ছেড়ে কৌরবে এলেন। দুই  পূরবী মুখার্জি এলেন ভালোবাসা নিয়ে তিন - বীরেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত ওরফে শৌনক  গুপ্ত এলেন পশ্চিমের  জানালা নিয়ে। এরা আমাদের সাহিত্য জীবনকে ধীরে ধীরে দিশা দিলেন।

এর মধ্যে প্রথম বছরেই কমল একটা নাটক লিখলো। সূর্যের বুকে ফসিলের নীড় প্রবাসে বেকার বাঙালি যুবকরা নাটক করবে এ তো স্বাভাবিক কথা ঠিক করলাম আমরাই নাটক করবশুরু করলাম রিহার্সাল। কমলই দলের নাম দিল কৌরব১৯৬৮’র শেষে। ৬৮’র শেষে নাটক মঞ্চস্থ করে দুপয়সা হলে আমরা লাগিয়ে দিলাম  ‘তরুণ কবিতা মহোৎসব১৯৬৯ জানুয়ারিতে। কোনো হলে নয়, একেবারে আমার  প্রেমিকা, এই নাটকের নায়িকা গীতার বাড়ির বাগানে তাঁবু খাটিয়ে শতরঞ্জি পেতে। লিফলেট বিলি হলো জামশেদপুরে তো বটেই, বাইরে থেকে যাঁরা এলেন তাঁরাও  কোনোদিন এমন ব্যবস্থা দেখেননি। কবিতা নিয়ে এত হৈচৈ উন্মাদনা কেউ ভাবতেও  পারতো না। তাও বিনে পয়সায়। আর বাইরে থেকে কারা এলেন? পূরবীদির  সহযোগিতায় নিজস্ব ব্যক্তিগত খরচে উপস্থিত হলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নরেশ গুহ, সুপ্রিয় বন্দোপাধ্যায়, আমেরিকান কবি সিগমন্ড কোহেন। সেটা ছিল আমাদের গোল্ডেন জুবিলি, পঞ্চাশতম সভা। দুদিন এক রাত ব্যাপী ৬৯ জানুয়ারির শীতে ঘাম বেরিয়ে গেল উত্তেজনায়।

সেই প্রথম আমরা জলজ্যান্ত কিংবদন্তী কবিদের সঙ্গে মিশি, শুনি আর পড়ি। টের পাই আমাদের মধ্যে দুস্তর ফারাক। সঙ্গে মদ খেয়ে পিঠ চাপড়ে দিলেও বুঝতে পারি কবিতা অনেক দূর। তারপর হৈচৈ কমিয়ে পড়াশুনোয় মন দিলাম। জামশেদপুরে লাইব্রেরি নেই। আমরা বেকার। তারই মধ্যে পয়সা জমিয়ে জোগাড় করে কলকাতা থেকে বই, পত্রিকা কিনে আনতাম। ৩ শতাংশ কমিশনে কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন বিক্রি করতাম। কম তো চা সিগারেট ছেড়ে দিলো। পায়ের চটি ছিঁড়ে গেলে খালি পায়ে হাঁটলো এক বছর। রাঁচী, কলকাতা - একবছর আমরা মদ খেলাম না। পয়সা জমিয়ে শুধু বই কিনলাম। কমল খালি পায়েই কলকাতা চলে গেল বই কিনতে। লোকে হাসলো। সে সময়ের যত মেজর কবিদের বই। ফরাসী কবি, এলিয়ট, পাউন্ড, হুইটম্যান, ইয়েটস্‌, জার্মান কবিরা, নেরুদা, লোরকা, হিকমত, সোলঝেনিৎসিন, মায়াকোভস্কি, ইউতেশেঙ্কো, অ্যাপোলিনিয়ার, মালার্মে – শত শত, ঐ রেস্তোয় যা কুলায়। সুনীলদারাও তাঁদের বই দিলেন। সিগমন্ড কোহেন প্রচুর আমেরিকান বই দিলেন। আমাদের কমন লাইব্রেরি বেশ হলোআমরা পড়ছি পাগলের মতো। আমাদের  কপালে সি আই এ-র দাগ দিলো নকশালরা। পুলিশরা বলল এক্সট্রিমিস্ট। তুলে নিয়ে যাবে। নকশালরা বোম মারবে। একশতম সভায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় এলেন। সেই সভায় নকশালরা এসে চড়াও হলো সুভাষদার পরতাদের নিরস্ত করা হলো কোনো রকমে। সুভাষদার সঙ্গে জ্যোৎস্নারাতে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে মাইল পাঁচেক হাঁটলাম আমরা গল্প করতে করতে। সঙ্গে স্বদেশ সেন। সমস্ত কথাই কবিতার। কবিতার দেশ বিদেশের নানা আন্দোলন, জীবনানন্দের সাথে তাঁর ইন্টার‍্যাকশন নিয়ে। কী সব দিন!

দুশোতম সভায় এলেন তুষার রায়। সঙ্গে যোগব্রত চক্রবর্তী। তরুণতর কবির সঙ্গে কথাবার্তায় আমাদের দৃষ্টি বদলাতে থাকলো। তিনশোতম সভায় এলেন তারাপদ রায়। তাঁর হাসিখুশি কমিক দৃষ্টিভঙ্গী অন্যতর পথ দেখালো আমাদের। বড় হলে শখানেক  শ্রোতা। আমরা সবাই হাতে পোস্টার পেন্টিং করে চারপাশে ঝুলিয়েছি। নকশালরা এই সভাতেই ঝামেলা করল। বাইরে পরপর বোমা ফাটিয়ে চেঁচাতে থাকলো – কৌরব মুর্দাবাদ ধ্বনি দিতে দিতে ঝটিতি সভার ভেতরে ঢুকে সবার হাতে লিফলেট ধরিয়ে  দিলএই সব নানা রকমের ঢেউ ব্যস্ত রাখলো আমাদের শুরুর সময়টা।

এর মধ্যে ১৯৭০ সালে আমরা ঠিক করি একটা কবিতার সংকলন প্রকাশ করব। শুধুমাত্র কৌরবের কবিদের, এবং নাম হবে কৌরবআমরা তখন নিজেদের কৌরব  বলতাম, জামশেদপুরে সবাই, এখনো কলকাতায় ৫০-৬০-৭০ দশকের কবিরা আমাদের কৌরবই বলেন। আমরা পাড়ার দূর্গাপূজার প্যান্ডেলে খাবার দোকান দিয়ে চারদিন পরিবার এবং প্রেমিকাদের বঞ্চিত করে কোমরে গামছা বেঁধে মাংস, ঘুগনি ইত্যাদি পাউরুটির সাথে বেচলাম। সেই পয়সা দিয়ে কলকাতা থেকে সংকলন বার করলাম কৌরব নামে। দেশ পত্রিকায় সুনীলদা দারুণ আলোচনা লিখলেন সনাতন পাঠকের  কলমে। গাঁয়ে আমাদের ইজ্জত বেড়ে গেল। রোখ চাপলো, নিজেদের এসবের যোগ্য করে তুলতে হবেসারাদিন কবিতার কথা বলতে কোনো ক্লান্তি ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে তিন মাইল দূরে স্বদেশদার বাড়ি চলে যেতাম। তাঁর পায়ের কাছে বসে শুনতাম কবিতার কথা, ৫০-৬০-এর দশকে কলকাতায় পরিচয়-এর অফিস ঘিরে  সাহিত্যিকদের গালগল্পের কথা। যেতাম আমাদের পুবের জানালা পূরবীদির বাড়ি। তাঁর  ঘরে গোল হয়ে বসে কলকাতার ষাটের দশকের কফি হাউস, কবিতার আবহাওয়া, বিদেশী কবিতার অনুষঙ্গ শুনতাম। চলে যেতাম আমাদের পশ্চিমের জানালা বীরেনদার বাড়ি। ইওরোপ আমেরিকার সাহিত্যের ইতিহাস, আন্দোলনের কথা হতো। একটু পয়সা হলে আমি আর কমল বাংলা ঠেকে বসে দু-আনায় এক পোয়া করে কাচ্চি আদা নুন সহযোগে মেরে হাঁটতে থাকতাম কবিতার দিকে।

১৯৭০-এ এক শীতের দিনে কমল আর সুভাষ চলে গেল কলকাতা মুক্তমঞ্চে। মুক্তমঞ্চই পরে বইমেলার রূপ নেয়। তো কমল আর সুভাষ সেখানে মঞ্চে দাঁড়িয়ে চেঁচামিচি করে কবিতা পড়ল। সুভাষ ছিল ভীষণ জেদি। সে সূর্য সেন স্ট্রিটে গল্পকবিতা ম্যাগাজিনের অফিসে দুম করে ঢুকে টেবিলে বসা পাঁচ সম্পাদকের উদ্দেশে বলল - ‘আপনাদের ওই প্যানপেনে কবিতার সম্পাদনা থামিয়ে শুনুন আমি কি বলছি’ -  একটা চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে সে ঝড়ের বেগে ষোলটা কবিতা মুখস্ত বলে গেল। মুখস্ত করাটা সুভাষ তুষার রায়ের কাছে শিখেছিল। একবার ট্রেনে যাবার সময় তুষারের কবিতার ডায়েরি হারিয়ে যায় বলে, সেই দুঃখে তুষার সমস্ত কবিতা মুখস্ত করেছিল। দেখাদেখি সুভাষও। গল্পকবিতা সুভাষের ষোলটা কবিতাই সেই সংখ্যায়  ছাপলো। ঐ আমাদের প্রথম কোনো পত্রিকায় ছাপা। তারপর গল্পকবিতায় আমরা  সবাই লিখেছি। এভাবে লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে ধীরে ধীরেএকমাত্র কমলই কমার্শিয়াল কাগজে লিখেছে, আজও লেখে।

১৯৭০ সালে প্রথমে খাতায় হাতে লিখে পত্রিকা করা হলো, পাঠকদের কাছে ঘোরানো হলো, তাতে তারা মন্তব্যও লিখলেন। তারপর হাতে লিখে সাইক্লোস্টাইল করে কয়েক  কপি কাগজ। ১৯৭১ পুজোয় লেটার প্রেসে ছাপা কৌরব বেরলো। ডাবল ক্রাউন সাইজে, চার পাতার, নাম হলো মহিষকাঠের ব্লকে প্রথম পাতার মাঝখানে ‘মহিষ’  নামটা লাল রঙে ছাপা হলোউঁচু মাথা কতখানি হেঁট হয় বিজ্ঞাপন জোগাড়ে তখন  মালুম হলোপ্রথম বছর বিভিন্ন নামে চারটি সংখ্যা বেরলো সুভাষের সম্পাদনায়।  পাঁচ নম্বর সংখ্যা থেকে সাধারণ ডিমাই সাইজে বেরোতে লাগল কৌরব একবার  টাকা অনাদায়ের কারণে পুরুলিয়ার এক প্রেস মালিক আমাকে আর সুভাষকে তার বাড়িতে দোতলার একটা খালি ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিলো রাগের চোটে। সারারাত অভুক্ত কাটিয়ে ভোরে তার দোতলার জানালার ঢিলে শিক খুলে পালিয়ে আসি। থামতেই জানতাম না। এইভাবে ক্রমশ ১৯৮১তে সিগিনেট প্রেসের মালিক, যিনি প্রথম লিটল ম্যাগাজিন ছেপেছিলেন, দিলীপকুমার গুপ্ত, মারা গেলে কলকাতায় সেই প্রথম বছরে শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিনের জন্য ডি কে গুপ্ত পুরস্কার দেওয়া শুরু হলে কৌরব প্রথম বারের পুরস্কারটি পায়। এই তো নব্বইয়ের শেষে, বহরমপুরের ‘অন্তিক’ নামের একটি নতুন পত্রিকার ডাবল ডিমাই সাইজের চার পাতার কান্ড কারখানা দেখে তার সম্পাদক শুভ্র ব্যানার্জিকে কড়া ভাষায় লিখলাম - বহরমপুরে রৌরব একটা স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করেছেতোমাদের উচিত তা পেরিয়ে  যাওয়া। তারপর আমার লাইব্রেরি হাঁটকে খুঁজে পাই পুরনো কৌরব আর পুরনো রৌরব সেই চারপাতা ডাবল ক্রাউন। দেখে আমি ভীষণ লজ্জিত হলাম। আমার ওই  চার পাতায় যে নিষ্ঠা এবং গর্ব ছিল তা তো ফ্যালনা নয়। তাহলে শুভ্রকে আমি ওরকম বললাম কেন? আমারও যেন আর এরকম ভুল না হয়।



সবসময় ভাবতাম আমরাই শ্রেষ্ঠ। আজও তাই ভাবিএই ভাবনাটা খুব জরুরি মনে হয়। এটা একটা ড্রাইভিং ফোর্স। আগে তো লিখতেও পারতাম না, পরে একদিন হয়তো মনে হবে ২০০৪-এও, কৌরব ১০০ বার করার সময়  আমরা লিখতে পারতাম না তেমন। তা হোক। চালিকা শক্তিটা বড্ড প্রয়োজন। নানা সময়ের কবিতা আর কবিদের জীবনী পড়ে মনে হয়েছিল, নিজস্ব অভিজ্ঞতা খুব জরুরি তার জন্য প্রয়োজন ঘুরে বেড়ানোর। জামশেদপুরের দুদিকে নদী আর চারদিকে পাহাড় জঙ্গল - এইসব, পশুপাখী, সিংভূমের সমস্ত গ্রাম, গ্রামের মানুষজন, তাদের থাকা খাওয়া ভাষা চাষ সংস্কৃতি, পুরুলিয়া বাঁকুড়া বর্ধমান মেদিনীপুর পালামৌ চাইবাসা চক্রধরপুর - যেখানে যত ঝর্না আছে, আকাড়া মানুষ, মদের ঠেক, মহুয়া, হাড়িয়া, রমণী, পুরুষ বন্ধু, সব সব চষে বেড়ানো, কোথায় সূর্যাস্ত হয়, কোথায় সূর্য ওঠে, কোথায় হলুদ শিমূল, সাদা পলাশ - আর স্বদেশদার কাছে বসে ভাষা শিক্ষা, নতুন কবিতার পরীক্ষা নিরীক্ষা পাগলের মতো। পাগল বলত লোকে। কবিরা বোধহয় পাগল হয়সাধারণ মানুষের মতো হয় না। তাদের রক্তেই এক উন্মাদনা থাকে, ঘরছাড়া, পরিবারে থেকেও নেই, চাকরিতে থেকেও নেই, সবসময় চোখ ঘুরছে, কিছু খুঁজছে, মানুষকে লক্ষ্য করছে। দেশান্তরী হচ্ছে। প্রেমিকা পাল্টাচ্ছে, বউ পাল্টাচ্ছে - কারো ছকে তার মন নেই, কোনো ঈর্ষা নেই। শুধু ভালোবাসা, আরো ভা্লোবাসা মানুষকে প্রকৃতিকে,  কবিতাকে - শুরুর সময়টা আমাদের এরকম ছিল।

প্রথম যখন বইপত্র নিয়ে পড়াশুনো শুরু করলাম, এবং বহিরাগত সমস্ত সাহিত্যিকের পীঠস্থান হয়ে উঠল কৌরব, আমরা জেনে গেলাম বাংলা সাহিত্য এবং ষাট দশকের  আন্দোলনগুলির কথা, তখন সত্তর দশক কবিতা মুক্তির দশক স্লোগান উঠেছে,  পাশাপাশি বিধ্বংসী একাত্তর ঘটে গেছে। ঘৃণ্য এমার্জেন্সী এগিয়ে আসছে, শুধু বিশ্ব শিল্প সাহিত্যের ইতিহাস আমাদের বাঁচিয়ে দিল বয়ে যাওয়া থেকে। এই ব্যাপারে পূরবীদি  আর স্বদেশদার অবদান প্রচুর। তাঁদের প্রেরণা এবং সমাজ ও সময়কে বুঝে দেখার  হাজারো যুক্তি বিযুক্তি আমাদের চিনতে শিখিয়েছিল কোনটা নদীর বন্যা আর কোনটা অমৃতধারা, অন্ধকারের মধ্যেও আলো কোথায়, দুঃখের মধ্যেও কোথায় আনন্দ। নিজেকে পরিশীলিত করা এবং যা খুশি করতে পারার সাহস। প্রশ্ন করা নিজেকে। ক্রমশ আমরা কৌরব কাল্ট তৈরি করে ফেললাম। পাগলামো মেশানো এক ধরনের জীবনযাপনের পদ্ধতি, যা আমাদের এখনও টেনে নিয়ে চলেছে। থামতে শিখলাম না। 


অমিতাভ দাশগুপ্তর শালার বাড়ি ছিল জামশেদপুরে। অমিতাভদা এলেই চলে আসতেন আমাদের আড্ডায়, কখনোমরা তার ঠেকের ছাদে। কখনো বিয়ার রাম চললেও  প্রিয় ছিল মহুয়াঈশ্বর ত্রিপাঠী শ্বশুরবাড়ির সূত্রে জামশেদপুরে এসে আমাদের বন্ধু হয়ে  উঠলেন। আমরাও চলে যেতাম পুরুলিয়ায় প্রতুল দত্তর বাড়ি নির্মল সৈকতদের নিয়ে, অথবা দুর্গাপুরে রবীন্দ্র গুহর বাড়িতে বিমান মৃণালের সঙ্গে, অথবা চাইবাসায় সমীর রায়চৌধুরীর বাড়িকখনো সুকুমার ঘোষের সঙ্গে খড়গপুরে কালীপদ কোঙার বা  দীপক করের বাড়ি। এভাবে লেনদেন করে রোখ রাগ জেদ ভালোবাসা গর্ব সব  মিলিয়ে কৌরব দাঁড়িয়ে গেল। টাকাপয়সা নেই, প্রেস নেই, বিজ্ঞাপন নেই, গডফাদার নেই - কিন্তু ‘নেই’ শেষ কথা নয়। শেষ কথা হলো ‘হ্যাঁ’। তরুণ বয়সের লড়াইটা  আমরা ভুলিনি। তাই আজো নবীন তরুণ কবি আমাদের শ্রেষ্ঠ মূলধন।

1 কমেন্টস্: