চোখ
ঝপ করে চারপাশ আমার থমকে গেল, জমাটি আলোয় হঠাৎ লোডশেডিং যেন। আর সেই নিকষ অন্ধকারে একজোড়া মেয়েলি চোখ জ্যান্ত হলো।পলক তুলল। মাথার ভেতর অবিরাম মৌমাছির হুল! অসহ্য যন্ত্রণায় চারপাশ
ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে দুলতে থাকে আমার। দু’হাত বাড়িয়ে আছি তখনও; ওকে
কোলে নেওয়ার পালা আমার। ওর নাম কুর্চি। আমার মাসতুতো দাদার মেয়ে। এই প্রথম দেখছি ওকে। বউদি’র বকুনি খেয়ে চার মাস পর আসা। ওরা আমার
স্থানীয় অভিভাবক। সেই যে মেডিকেলে ভর্তির পর বাবার সাথে এসেছিলাম, তারপর এই আজ এলাম। সেবার বউদি ছিলেন বাবার বাড়ি, সিলেটে;
দেখা হয়নি। আজ সদলবলে এসেছি, বন্ধুরা আছে
সাথে। কুর্চি ঘুমোচ্ছিল। শুক্রবার। ভরপেট খেয়ে আমরা সবে আইসক্রিম চাটছি। আর তখনই ঘুম চটে গেল ওর। কাজের মেয়েটা কোলে করে নিয়ে এলো ড্রইংরুমে। সাথে সাথেই
কাড়াকাড়ির ধুম। কী মিষ্টি! এক
মাথা ঝাঁকড়া চুল। আমরা ওর জন্যে পুতুল, চকোলেট আর ছবির বই এনেছি। ফিরোজা আমার রুম-মেট। বেশ কায়দা
করে র্যাপিং করেছে। অল্পক্ষণেই সবার কোল ঘোরা শেষ। আমি হাত বাড়াতেই চোখে চোখ আটকে গেল আমাদের। আমি ঘোরের মধ্যে আবিষ্কার করি, কুর্চির কচি
মুখে অন্য কারো চোখ! ‘মিলু’! বুকের ভেতর
অনেক দূরে চেনা কেউ ডাকছে আমাকে!
ক্লাস এইট; বয়ঃসন্ধির গোলমেলে ‘তেরো’ হুড়মুড়িয়ে তাজা হয় নিমেষে। অমিদা’ ডাকছে। অমিত বড়ুয়া। ঢ্যাঙ্গা টাইপ। সারা মুখ জুড়ে এক জোড়া বিশাল
গরু-মার্কা চোখ। বিচ্ছিরি ড্রেস-আপ। পড়াশোনায় ভা্লো। গান গায় আরো
ভালো। তবে ব্যান্ডের গান
না। প্যাঁচকি গান, ক্লাসিক্যাল। দিদি’র সাথে পড়ে। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার। আন্তঃকলেজ বিতর্কে শ্রেষ্ঠ বক্তা। নমিতা মাসির
ছেলে। নমিতা মাসি আর মা একই স্কুলে
পড়ান। মা দিদিকে প্রায়ই ঝাড়েন, ‘অমির পা ধোয়া জল
চেয়ে খাস!’
আমার পায়রা বুকে সবে ওম ধরছে। দুপুরে হঠাৎ কোথাও কাক ডাকলেও
চমকে উঠি। আয়নায় নিজেকে দেখি বারবার। ফয়সল ভাই, মেঘা’র মাসতুতো দাদা। পোলিস সানগ্লাসে চোখ ঢাকা। টাইট জিন্স, ব্লু শার্ট। ড্যাশিং দেখতে। সানগ্লাস কপালে
উঠিয়ে কী গভীর তাকায় আর আমার পেটের ভেতর তখন হাজার প্রজাপতির সুড়সুড়ি। অদ্ভুত সেই অনুভূতি!
এক ছুটির দুপুরে কোচিং পালিয়ে মেঘা শুদ্ধু চলে যাই পতেঙ্গা।
ড্রাইভিং সিটে ফয়সল ভাই। আমি আর মেঘা পেছনে। তাতানো রোদ। তাতে কি? জুটিরা সব গা ঘেঁষে
এদিক-ওদিক, দু’জনে দু’জনার! আমরা তিনজন; মেঘা একটু দূরে, ফয়সল ভাই আমার পাশে। এত কাছাকাছি! ‘ওল্ড স্পাইস’এর সুবাস আমাকেও জড়ায়। আবেশে অবশ করে।
মেঘা বাড়ি ফিরতে চায় হঠাৎ। আমরা উঠি। আমারও ফেরা উচিৎ। ফয়সল ভাই বলেন, ‘আর একটু!’ মেঘা নামে, আমি
জায়গা পাল্টাই, সামনে বসি। গাড়িতে তখন সঞ্জীব চৌধুরী গাইছে,
‘আমি তোমাকেই বলে দেবো
কী যে একা দীর্ঘ রাত
আমি হেঁটে গেছি বিরাণ পথে,
আমি তোমাকেই বলে দেবো ----’
আমার কেমন কান্না পেতে থাকে। একটু পরে একটা দোকানের সামনে
থামেন ফয়সল ভাই। সিগারেট ফুরিয়েছে। আমি অপেক্ষা করি গাড়িতে। হঠাৎ রাস্তা ফুঁড়ে
কোত্থেকে যেন উদয় হয় অমিদা’! আমাকে দেখেই ভুরু
কুঁচকে তাকায়। চিনে ফেলেছে! আমি চোখ সরিয়ে নিই; মনে মনে ইষ্ট নাম
জপি। আমার দিকে আসছে না তো! আবার চোখ ফেরাই আর
তক্ষুনি দেখি ফয়সল ভাই অমি দা’কে ধাক্কা দিয়ে
সরাচ্ছে। অমিদা’ ফয়সল ভাইকে ঘুরিয়ে ঘুষি। উৎসুক লোকজন ঘিরে ফেলছে ওদের। আমি নেমে পড়ি গাড়ি থেকে, উলটো দিকে। রিক্সা ডেকে সোজা বাড়ির পথে।
হাত পা কাঁপছে থরথর। একবারও পেছনে তাকাই না। সে রাতে ধুম জ্বর। বেশ ক’দিন ভুগেছি। মেঘা ফোন দিয়েছিল বার কয়েক; বাড়ির ফোনে। ধরিনি।
আমার মোবাইল ফোন হয়নি তখনো।
প্রায় এক সপ্তাহ্ পর স্কুলে যাওয়ার পথে দেখি অমিদা’। যেন আমার
জন্যেই দাঁড়িয়ে আছে। আরো ঢ্যাঙা লাগছে। এক পলকের জন্যে চোখাচোখি, ‘মিলু!’ আমি তাড়াহুড়ো
উঠে পড়ি রিকশায়। কী লজ্জা!
ঠিক তিন দিন পর অমিদা’ লাশ হয়ে যায়। বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে চলে গেছে গুলি। ষোল শহর স্টেশনের কাছে পড়ে ছিল। অমি দা’র কোনো শত্রু নেই। রাজনীতি করতো না।
নমিতা মাসির কান্নায় আকাশ থমকায়, ‘আমার ছেলেকে এনে দাও!’
আমি জমাট বরফ হয়ে দেখতে থাকি অমিদা’র চোখ বোজা লাশ। কানে বাজতে থাকে, ‘মিলু!’
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন