কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯

তুষ্টি ভট্টাচার্য




রম্যরচনা

পদাবলি ১১



                         

(আমি-- আমি সামান্য শখের কলমচি। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি আর কী! আমার লেখার পাঠক খুবই কম যদিও। বড় বড় সাহিত্য সভায় আমাকে পাবেন না। পুরস্কারের বদলে তিরস্কারই পাই বরং। মনের দুঃখে ইচ্ছে জেগেছে পদাকে নিয়ে লিখতে। যদি যুগান্তকারী কিছু লেখা হয়ে যায়, অন্তত পদার নাম করে।
পদা— পদাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমারই বয়সী বলে ওকে আমার বন্ধু ভাববেন না। গরীব নয়, কিন্তু গরীব সেজে থাকে। বিচ্ছিরি রকম ড্রেস সেন্স, হয় পাজামার ওপরে টিশার্ট, নয় লুঙ্গির ওপরে ফুল শার্ট! আর পায়ে হয় কাপড়ের জুতো নয় প্লাস্টিকের চটি। সময়ে, অসময়ে হুটহাট আবির্ভূত হয়। আমাদের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। কথাবার্তার টপিক বিবিধ ভারতী থেকে বিলিতি আমড়া পর্যন্ত। গায়ে পড়ে এসে পিত্তি জ্বলানো কথা বলে। আমিও মাঝেমাঝে ওকে কিছু নিরীহ প্রশ্ন করে থাকি।

মাদাম তুভোঁ— আদপে ফরাসী হলেও এদেশের বাসিন্দা, রঙ জন্মসূত্রে সাদাই ছিল। এখন তাঁর তামাটে মোটা চামড়ায় খসখসে খড়ির দাগ। অত্যন্ত নাক উঁচু টাইপের। এবং জ্ঞানদা। এঁর কথা অর্থাৎ বাণী না শুনলে আমার আর পদার সম্পর্কটা ঠিক খোলসা হবে না। ইনি সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় এসে বাণী বিতরণ করে আমাদের আরও বিপাকে ফেলে প্রস্থান করেন।)

পুজো এসে গেলেই মাথার ভেতরে বেদম বয়লার জ্বলতে থাকে। কাজের চাপে, শপিং আর ভিড়ের চাপে সেই বয়লারের আগুন আরও উস্কে ওঠে। আর হয়ত দুতিনদিন বাকি তেনার আসার। এদিকে গভীর নিম্নচাপ। ছিঁচকাঁদুনে বৃষ্টি আর থামছে না। এবারে পুজোয় বোধহয় ছাতা আর রেনকোট পরেই বেরতে হবে। পদা বুদ্ধি দিয়েছে, ‘একটা মাল্টিকালার ছাতা কিনে রাখ যাতে সব ড্রেসের সঙ্গে ম্যাচিং হয়’। শুনেই আরও ঝাঁট জ্বলে গেল। নিজের মনেই গজগজ করে চলেছি—ভাই, তোকে এত নখরাছকরা দেখিয়ে কে আসতে বলেছে? প্রতি বচ্ছর যে আসতেই হবে, এমন তো কথা ছিল না! তা আসবি আয়, নাহয় দলবল নিয়েই আয়.. তা'বলে এত্ত নাকানিচোবানি খাওয়াবি আমাদের! একে তো খরচার পর খরচা.. রোজ রোজ বাজেটের পিণ্ডি দিয়ে প্রতিটা মানুষ এই সময়ে ঘরে ফেরে। তারপর হল গিয়ে ঘরদোরের ঝামেলা। থাকবি তো প্যান্ডেলে, সে করতে কত্ত খরচ হল শুনলে আর আসতি না! তবু কেন ঘরবাড়ি সাফাই করব, মানে করতেই হবে? যত্ত কোণাখামচি থেকে ধুলোময়লা, তেলচিটে খুঁজে বের করে সাফ করতে হবে, যত পর্দা, চাদর, বালিশের ওয়ার, তোয়ালে কাচতে হবে? কেন, কেন? গ্রিলে, জানলায়,দরজায় দাগ থাকা চলবে না? তুই ভাই কে এত হরিদাস পাল যে আমরা এত্ত গুরুত্ব দিয়ে সাজ সাজ, রব রব, গায়ে গতরে ব্যথা, হাড়মাস ভাজা ভাজা হয়েও তোর বন্দনা শুরু করব? তাও আবার এত্ত খরচার ভার মাথায় নিয়ে? ওই জন্য আজ অবধি লোকে তোর নামে দীর্ঘ উউউউ লেখে। এমনি এমনি কি লেখে? অনেক জ্বালায় লেখে রে ভাই! পদা বোঝেনি। আমি আজ বুঝলাম।

পদা তখনও যায়নি। চুপচাপ বসে আছে। যেন আমার গজগজানি শুনতে পাচ্ছে না। আমি কখন হাঁফিয়ে গিয়ে চুপ করব সেই অপেক্ষায় আছে। যেই থেমেছি, পদা সঙ্গে সঙ্গে কথা ঘোরানোর জন্য শুরু করল, ‘ওরে! গুগলের আজ ২১বছর বয়স হয়ে গেল, তোর  ফেমাজের কি সে খেয়াল আছে? এবার পাত্রীস্থ করতে হয় বাবাজীবনকে’। শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার মুখ দেখে ও কী বুঝল কে জানে! আবার শুরু করল—জানিস তো, আজকাল পুজোতেও বই বেরচ্ছে। জানিস নিশ্চই! ‘মহান’ লেখক হয়ে উঠেছিস যখন, এখবর তো রাখবিই। আচ্ছা এই যে কারুর বই প্রকাশিত হলেই তোদের সবাই লেখে, সংগ্রহ করব। 'সংগ্রহ করা' কাকে বলে আমি বুঝি না। কীভাবে সংগ্রহ করে? কিনব বা পড়ব বললে নাহয় কিছু বোঝা যায়। শুভেচ্ছা বা অভিনন্দন জানায় যারা, তারা যে কিনবে বা পড়বে না সেও বোঝা যায় দিব্যি। কিন্তু এই সংগ্রহ করব শব্দটাকে বেশ সন্দেহজনক লাগে। মানে কী বা কীভাবে করে, কে জানে!’ এই বলে তিনি থামলেন আবার। আড়চোখে আমার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছে।

আমি কি কম যাই কিছু ওর থেকে? তাই ওর চোখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললাম, ‘দ্যাখ্‌, কে কিনল আর কেই বা সংগ্রহ করল, এইসব ভাবলে তো লেখকের লেখাই চলে না। লেখকের কাজ লেখা, কে কবে কিনছে বা কে কোন পুরস্কার দিচ্ছে, এসব নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র ভাবিত নই। ভাল লিখলে তার জন্য কোন গোষ্ঠীকেই তেল দিতে হয় না, এলেবেলে পুরস্কার নিয়ে নিজের নাম ফাটাতেও হয় না। তাই আমি, নিলে একবারে নোবেল বা বুকার নেব। বাকি সব ফালতু!’  আজ যেন হঠাতই দিব্যজ্ঞান লাভ করে পদার সামনে এই ঘোষণা করে দিলাম। কী বুঝল সে কে জানে। মানে মানে কেটে পড়ল তখনকার মতো।

রাতে নাইট ক্রিম ল্যাবড়াতে যাচ্ছি, এই সময়েই ফটাশ! পচা ডিম ছুড়ে মারল মুখে কে যেন! এই কে র‍্যা? উত্তরে শুনলাম সেই গলা... জানিস না, আজ বিশ্ব ডিম দিবস। তাই সেলিব্রেট করছি। মুখ মুছতে মুছতে বল্লাম-জানিস না, আজ কান্নিভাল! ডিম্ভাতের ল্যাইনে ডাঁড়া গিয়ে! সেও তার অথেনটিক স্বরে উদাস মুখে জানাল-এখন ভেগান চলছে। আমি শুধু বেগুন খাই ভাই।



মিত্রোঁ! আমার আর নোবেল, বুকারেরও দরকার নেই, এই ঘোষণাও করলাম। ঢের শিক্ষা হয়েছে পচা ডিম খেয়ে। মর্মে মর্মে শিক্সা এরেই কয়। ওর যে পেটে পেটে এত, কে জানত! থাক, আমার আর নোবেল আর বুকারের দরকার নাই। এমনিতেই রসগোল্লা নিয়ে উড়িষ্যার সঙ্গে ক্যাচালটা সবে মিটেছে। ফলে রসগোল্লা এখন আমাদের। উড়িষ্যার রসগোল্লা চুলোয় যাক। আমি নাহয় বাংলার রসগোল্লা খেয়েই জীবনটা কাটিয়ে দেব। এই তো আজ রসগোল্লা দিবস। চুঁচড়োর ঘড়ির মোড়ে মিষ্টির ব্যবসায়ীরা পঁচিশ হাজার রসগোল্লা বিলোচ্ছে…ওরে পদা, তুই বরং বেগুন ছেড়ে রসগোল্লার ল্যাইনে ডাঁড়া গিয়ে। সেও তুরন্ত জবাব দিল, জানিস না, আজ ডায়াবেটিস দিবসও বটে। তুই যে রেটে রসগোল্লা খেয়েছিস বা খাবি ঠিক করেছিস, তোর ডায়াবেটিস হওয়ার চান্স খুব বেশি। তাই আগে থাকতেই এই দিনে আমি বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ঘোষণা করে রেখেছি। বল! ক’হাঁড়ি চাই?’

দেখতে দেখতে কালীপুজো, দীপাবলি সব কেটে গেল। হাওয়ায় বাজির গন্ধ মুছতে না মুছতে ভাইফোঁটা চলে এলো। 'এমন তো না যে, তোমার ভাই বছরে একবার আসে। কাল কি মাংস না খাওয়ালেই চলছিল না তোমার?' দু'ঘন্টা খাসির মাংসের দোকানে লাইন দিয়ে আজ সন্ধেয় অসহিষ্ণু কর্তার স্ত্রীকে এই প্রশ্ন। সবাই মুচকি হাসছে শুনে। গিন্নিমা কতটা রাগলেন কে জানে! কাল ভোর চারটের সময় কে যেন কাকে লাইন রাখতে বলছিল, এও শুনলাম। হ্যাঁ, আমিও ওই লাইনেই ছিলাম। ছেলে আর তার বাবার বোনেদের জন্য। আমার ভাইফোঁটা নেই। ওদের আছে। মোটকথা, ভাইফোঁটা কাল। ব্যাস! আজ থেকে রাস্তাঘাটে, দোকানে দোকানে কেনাকাটার হিড়িক লেগেছে। মিষ্টির দোকানের কথা আর বললাম না। এই হল বাঙালির খাইখাই। কিছু একটা বাহানা পেলেই হল।

পুনশ্চঃ এই মাংসের দোকানের লাইন না দেখলে গোটা ভারতের চিত্রটা আপনি কখনই বুঝবেন না। এই লাইনে আমার মতো কুর্তিধারী, আর শাড়ি পরিহিত মাঝবয়েসীর সংখ্যাই বেশি। তারকেশ্বর লাইন থেকে আসা চকচকে বা তাঁতের শাড়ি, চুকচুকে চুল, হাতে প্লাস্টিকের শাঁখা, পলা পরা মহিলারাও আছেন। এরপর বাচ্চা খোকা, থুড়ি এক কানে দুল পরা, সদ্য গোঁফ গজানোও আছে। আছে সাদা জিন্স আর সাদা স্নিকারে কোমর পর্যন্ত স্ট্রেট চুলে গোল্ডেন হাইলাইটেড তরুণী। এমনকি মুমতাজের ছোট চুলের মতো উইগ পরা, হলুদ সস্তা সিন্থেটিক টপ আর পায়ে স্বচ্ছ কালো পামোজা পরা মেয়েরূপী উৎকট মেক আপের ছেলে। রয়েছেন আধবুড়ো চশমা চোখো খিটকেল। রয়েছে এক রসিক, যিনি সারাক্ষণ টিকা টিপ্পুনি জুড়ে সকলের ভার লাঘব করছিলেন। তার মধ্যে একটা বলি-ও শামিম! তোর মাংসে কী মেশাস রে? তোর দোকানেই এত ভিড়?' শামিমের নির্বিকার উত্তর-হেরোইন। আমার এক লহমায় পদাকে মনে পড়ে গেল তখনই। কী আপদ!
‘হ্যাঁ, আমি তো আপদই! আমাকে আর কবে তোর মনে ধরেছে? কবে আর মন থেকে ডেকেছিস, এই বলে—নে পদা, আয় আজ একটু মাংস ভাত খেয়ে যা!’ ওর গলায় যেন আজ অভিমানের সুর। কী আশ্চর্য! ওরও অভিমান হয়! আমি জানতাম ওটায় আমারই একচেটিয়া অধিকার। তাই নরম সুরে বললাম, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, বুঝেছি। আর নাটক করিস না! খেয়ে যা। বস একটু’। কিন্তু বলে না—খেতে পেলে শুতে চায়! সেই হাল হল আমার। এক পেট খেয়ে দেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বলল, ‘নাহ! মাংসটা আজ তেমন জমেনি। নুন বেশি, ঝাল কম, একগাদা তেল ঢেলেছিস…’ রাগে আমার গা পিত্তি জ্বলে উঠল শুনে। কী কুক্ষণে ওকে খেতে বলেছি এই ভেবে নিজের কপাল চাপড়াচ্ছি। আর ঠিক তখনই তিনি এলেন। বিকেল হয়ে এসেছে। পদা কখন যেন একপাশে গুটিসুটি মেরে ভাতঘুম দিচ্ছে নিশ্চিন্তে।  




অদ্য মাদামের পদচিহ্নে কিঞ্চিৎ ধীরগতি। ইহা কি কেবলই বয়ঃপ্রাপ্তির লক্ষণ? জরা? বিষণ্ণতার প্রাদুর্ভাব? পদা নিদ্রা যাইতেছে, আমি মাদামের মুখোমুখি বসিয়া পড়িলাম তাঁহার বাণী শ্রবণের হেতু। মাদাম সম্ভবত আমাদিগের লিখনসংক্রান্ত তর্জায় প্রভাবিত হইয়াছেন। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে তাঁহার বাণী প্রদান করিয়াই নির্গত হইলেন ধীর পায়ে।   

স্থান, কাল, পাত্র ভেদে যখন কোন লেখা পাঠকের সময়ে এসে, তার নিজস্ব গণ্ডীর মধ্যে ধরা দেয়, একাত্ম হয়ে পড়ে, সেই লেখাই শাশ্বত। যুগের হাওয়ায় লেখার স্টাইল বদলায়, বাচন রীতি বদলায়, আধুনিক হয়ে ওঠে ভাষা। কিন্তু কনটেন্ট যদি পাঠককে ছুঁয়ে যায়, প্রাচীন সাহিত্যও হয়ে ওঠে আধুনিক। আর সেই সাহিত্যই বাঁচে। সেইজন্যই বোধহয় বারবার লেখকরা ক্লাসিক সাহিত্যের পাতা ওল্টান। আর তোমরা, মূর্খের দল, ফেসবুকের লাইক, কমেন্ট গুণতে থাক, পিঠ চাপড়াও একে অন্যের, বড় পত্রিকা আর সদ্য প্রকাশিত বইয়ের জন্য পুরস্কার পেয়ে বর্তে যাও এ যাত্রা। তাই বলছি, ক্লাসিক পড়’।  



1 কমেন্টস্: