ধারাবাহিক উপন্যাস
প্রিয়দর্শিনী
(দশম অধ্যায়)
(১৯)
গৌড়ের তাঁতীপাড়া মসজিদের চত্বরে বিবাক এর পূর্বে বার
দুয়েক গিয়েছে। গোপীর সঙ্গেই গিয়েছে। তবে ওমর মীর্জাকে সে কোনওবারেই দেখতে পায়নি।
পাওয়ার কথাও নয়। কারণ এ মসজিদের তিনি নির্মাণকর্তা হলেও বছর কয়েক আগেই পরলোক গমন করেছেন। গোপীর কাছেই শুনেছে তিনি
নাকি অতিশয় ভাল মানুষ ছিলেন। এখন বিবাক ওমর মীর্জার সমাধি কবরের একদম পাশটিতে চুপ
করে একলা বসে রয়েছে। কাল গোটা রাত তার না হয়েছে ঘুম, না কিছু খাওয়া। সমস্ত শরীর
জুড়ে এক অতৃপ্ত ক্ষুধা। মাধ্বীর শরীরের স্পর্শ যেমন অনন্ত এক পিপাসা, তেমনি অনন্ত
সুদূর এই জীবনের যাত্রা। দুপুরের খররৌদ্রে গঙ্গার ঘোলাজল চিকচিক করছে। মাঝনদীতে
একখানা বলিয়া নৌকো ধীরে সুস্থে চলে যাচ্ছে। দূরে মালদহের নিকট অস্পষ্ট বনরেখা।
বলিয়া নৌকাটা ঠিক কোন পক্ষের বোঝা যায় না। তবে আফগান শাসক শের খান যে এখনও গৌড়ে
এসে হাজির হননি, তা ভালই বোঝা যায়। নতুবা আজ সকালের এমন দিনেও রাস্তায় আসতে দুজন পথ চলতি মানুষকে হুমায়ূন বাদশার সন্মন্ধে
কথা বলতে শুনেছে। শুনেছে খুব শিগ্গিরী নাকি বাদশা আবার গৌড়ে ফিরে আসবেন। কারণ
কাবুল দেশের আকাশের চাঁদ নাকি এই এতটুকু। সেই চাঁদ বাদশার একদমই পছন্দ নয়।
মাধ্বীদের গৃহ থেকে লুকিয়ে নির্গত হওয়ার সময় গোপীকে
দেখতে পায়নি বিবাক। লেঠেলরা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলতেও পারে। কিছু আগেও গোপীর
তীক্ষ্ণ চীৎকার তার কানে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু তখন বিবাকের নিজের শরীর অত্যন্ত নিঃসাড়। মাধ্বীর দুই উন্মুক্ত স্তনে তখন
সে তীব্র নখরাঘাত হেনেছে। বাম স্তনকে একখন্ড তুলোর বলের মতই পাঁচ আঙ্গুলে চটকেছে,
খামচিয়েছে। রতিক্রিয়ার সমস্ত কৌশল ভাল
জানা না থাকলেও এতদিন বিবাক সে কর্মটিতে স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করে এসেছে। কারণ এই
ব্যাপারটিতে বিবাক খুবই ধৈর্যশীল। অথচ কাল সে কেমন করে হঠাৎ হিংস্র উন্মত্তবৎ হয়ে
উঠল! যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বারবার মাধ্বী বলছিল, ছাড়! ওরে ছাড় আমায়...! ছেড়ে
দিয়েছিল বিবাক মাধ্বীকে ঘন্টাখানেক পরেই। ততক্ষণে মাধ্বী নেতিয়ে পড়েছে। দুই চোখ
শুকনো, বিবর্ণ ওষ্ঠ, মাথার চুলে বীভৎস জট। তবু ওরই মধ্যে কোনক্রমে বলেছিল, বিবাক
পালা...
ওমর মির্জার সমাধি কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বিবাক একলা ভাবছিল
কাল রাতের ঘটনাবলীর সঙ্গে আজ সকালের বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই। সবটাই কল্পনা,
ধাঁধা। মাধ্বী এবং মাধ্বীদের মত মেয়েরা সে যুগে নানাভাবে ক্লিষ্ট হত। মাধ্বী মুসলমান সেনা কর্তৃক ধর্ষিত
হয়। তারপর বিক্রী হয়ে যায় বাইজী মহলে। শেষ
রাত্রে শাহজাদা যখন গভীর নিদ্রামগ্ন, চতুর্দিক নিঃসাড়, একটি মাত্র প্রদীপ জ্বলছে,
বিবাক এসে দাঁড়ালো চুপিচুপি দরজার কাছে। ঘরটি তখনও সুগন্ধে আমোদিত। ফিসফিস করে
ডাকলো বিবাক, মাধ্বী! মাধ্বী! মাধ্বী চোখ মেলে তাকাল। মদের নেশায় তার চোখদুটি
টকটকে লাল। তার অঙ্গে গাঢ় সবুজ একটি বুটিদার মসলিন। সর্বাঙ্গে হীরে জহরৎ ঝলমল
করছে। তাকে দেখামাত্রই বিবাকের শতরশুন্ডা
নদীর বহমান নীলাভ জলের কথা মনে পড়ে গেল। স্বচ্ছ কাচ সদৃশ স্রোতোস্বিনী। এত জল, তবু
নদীর নগ্নতা নিবারিত হয়নি। বঙ্গদেশের যাবতীয় তন্তুবায়কূল এই নদীর জলেই সুতো ধুয়ে পরিষ্কার
করত। তারপর সেই ধোয়া সুতোয় তৈরী হত জগৎবিখ্যাত ‘মশরু’ বস্ত্র, যার দু’পিঠই সমান।
আবুল ফজল নিজেও সুখ্যাতি করে গেছেন এ
নদীর।
শাড়ি গয়নার শব্দ করে উঠে বসল মাধ্বী। সে জানে কে তাকে
ডাকছে। হাতদুটি বাড়িয়ে নরম গলায় বিবাককে বলল, আয়!
যেন মাত্র গতকালই তাদের দুজনের দেখা হয়েছিল। যেন কোনওদিন
কিছুই হয়নি তাদের জীবনে।
বিবাক বলল, ওঠ্! চল আমার সঙ্গে।
খুব উৎসাহিত হয়ে মাধ্বী বলল, হ্যাঁ চল! কিন্তু...
কোনও কিন্তু না! বাইরে প্রহরীকে পাহারায় বসিয়ে এসেছি,
দেরী করলে ধরা পড়ে যাব।
কিন্তু আমরা কোথায় যাব?
বিবাক বলল, তুই আমার হাতটা ধর শক্ত করে... কখনও ভাবিনি
আবার তোকে খুঁজে পাব!
বিবাকের কথায় ফিক করে হাসল মাধ্বী। মাধবীকঙ্কণ। ঝরোকার ওপাশ থেকে ঘুমন্ত শাহজাদার প্রবল
নাসিকা গর্জন ভেসে আসছে। প্রদীপও
নিভু নিভু। মাধ্বী বলল, তুই কিন্তু দেখতে খুব সুন্দর হয়েছিস বিবাক! কেমন
রাজপুত্রের মত দেখাচ্ছে!
তুই আমার সঙ্গে যাবি না মাধ্বী? আর দেরী করলে কিন্তু
বিপদ! তাড়াতাড়ি কর!
দু’পা হাঁটতে গিয়েই টলে পড়ে গেল মাধ্বী। সঙ্গে
সঙ্গে তাকে দু’হাত দিয়ে জাপটে ধরে ফেলল বিবাক। বলল, কী এত ভারী ভারী গয়না পড়েচিস?
সব খুলে ফ্যাল!
সো বর কামিনী নীর নাহারাতি রিত ভালি হেঁ
চির মচরকে গচ পর বারিকে, দারেছ চল্ল চাহি হেঁ
রায় বেচারি আপন মনমে উপমাও চারি হে
কে ছঙ্গ মরোরতি সেত(শ্বেত) ভুজঙ্গিনী জাত চলি হেঁ।
সেই শ্রেষ্ঠ রমণী জলে স্নান করিতেছিলেন। এ রীতি ভাল। পরে
পুষ্করিণীর ঘাটের উপর বস্ত্র নিঙ্গড়াইয়া
উহার ধারে ধারে চলিয়া যাইতেছিলেন। তাহা দেখিয়া রায় বেচারা আপন মনে উপমা স্থির
করিলেন, যেন মূর্তিমতী শ্বেত ভূজঙ্গিনী চলিয়া যাইতেছেন।
গাঢ় অন্ধকারে ডুবে রয়েছে চতুর্দিক। দু’হাত দূরের জিনিষ
ভালমত ঠাওর হয় না। অবিলম্বে গুপ্তদ্বার
উন্মোচিত হল। দুর্গের উত্তর পশ্চিম কোণে যমুনা সংলগ্ন বড় একটি খাল। বিবাকের নৌকো
সেখানেই বাঁধা। চারখানা হাতি, তিনটি বহুমূল্য হীরে, কিছু অগুরু ও কর্পূর এবং
মূল্যবা্ন কিছু কাপাসতুলো, এগুলিই ছিল বিবাকের শেষ সম্পত্তি। এই জিনিষগুলির
বিনিময়েই প্রহরীকে সে হাত করেছিল।
একটু কেঁদে উঠে মাধ্বী বলল, আমার ছেলে! হারেমের ভেতরে
আমার ছেলে আছে যে!
হত বিহ্বল হয়ে গেল বিবাক। মাধ্বীর ছেলে হয়েছে? এ কথা সে
অতি দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। বলল, তাড়াতাড়ি কর...
শাড়ির আড়াল থেকে লুকনো খঞ্জর বের করে আনল মাধ্বী। এত
অন্ধকারেও তার দাঁতের সুস্পষ্ট ঝিলিক দেখা
গেল।
- ‘এত আস্পদ্দা তোর? তুই আমায় জোর করিস!’ তারপর উদ্যত
খঞ্জর হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে বিবাকের বুকের
ওপর।
কর্কশ চিৎকারে খানখান হয়ে গেল গুপ্ত খালদ্বার। টাল
সামলাতে না পেরে দুজনেই জলে পড়ে গেল। প্রশস্ত খাল দিয়ে যমুনার দিকে তখন প্রবল
স্রোত বয়ে চলেছে।
(শেষ)
এই উপন্যাসটি লিখতে যেসব গ্রন্থের সাহায্য নেওয়া হয়েছেঃ-
বাবরনামা – গুলবদন বেগম (সংকলন – প্রেমময় দাশগুপ্ত)
মধ্যযুগে বাঙ্গলা - কালীপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়
যশোহর-খুলনার ইতিহাস (২য় খন্ড) - সতীশচন্দ্র মিত্র
গৌড়ের ইতিহাস - রজনীকান্ত চক্রবর্তী
মধ্যযুগে ভারত (মুঘল আমল) - তেসলিম চৌধুরী
কত নদী সরোবর বা বাংলা ভাষার জীবনী - হুমায়ুন আজাদ
সেই সময় – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বঙ্গভাষার ইতিহাস - মহেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (মধ্যযুগ) - ডঃ তমোনাশ
চন্দ্র দাশগুপ্ত
দালির বালিঘড়ি -
অশোক তাঁতী
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন