কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

রেজাউল করিম

 

সমকালীন ছোটগল্প


সাগর জলে কাশীনাথপুর


কাশীনাথপুরের মাঠঘাট জলের স্রোতে সাগর হয়েছে। ধানের শিষ দুএকটা দেখা  যায়। বেশীর ভাগ জলের নীচে একাকার। কয়েক মাস আগেও এমনটা ছিল না। গোটা গ্রামে কয়েকটা পুকুর আর একটা খাল। পানি থাকে না সারা বছর। এবারে দলে দলে লোক এলো খালটায় যৌবন ফেরাবার জন্য। মানুষের যেমন যৌবন, খালেরও যৌবন চাই। যৌবনই তো জীবনের আসল। খালের যৌবন ফিরলে মাঠে হাসি ফুটবে। নঈমুদ্দী আকন্দের অনাবাদী জমিতে ইরি হবে বিঘায় ত্রিশ মন। নঈমুদ্দী আকন্দের তাই ব্যস্ততা, ছুটাছুটির অন্ত ছিলো না। যেন তার উদ্যোগেই সব হচ্ছে। আব্বাসও বাদ পড়েনি মাটিকাটা থেকে। পরন্ত বিকেলে খালের মাটি কেটে কোদাল হাতে ক্লান্ত শরীরে বৌয়ের হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেয়ে বলে  ‘এবারে আমাগো কপাল ফিরি যাইবে। অভাব থাকিবে না। গ্রামে সুখ আসিবে। বৌ আব্বাসের চিটচিটে মুখটার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না। আব্বাস মাসুর হতাশা বুঝতে পারে। সন্ধ্যা নামে। মাসুকে কাছে বসায়, দুচারটা অন্য কথা বলে।  আদর করে মাসুকে জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষণ ওরা বুকে বুকে থাকে।

খালের উত্তর পাড়ে আব্বাসের এক দোন জমি। পাট লাগিয়েছে এবারও। মাসু আপত্তি করেছিলো পাট দিতে। পানির দাম পাটের। বাজারে নিয়ে পানির দামে মহাজনের হাতে তুলে দিতে হয়। গতবারে ইটাকুমারী হাটে মনের দু:খে পাটে আগুন লাগানোর কথা শুনেছে মাসু। তবুও পাট লাগিয়েছে আব্বাস। ওর ধারণা ফি বছরেই কি একই রকম যাবে! এবার কি সরকার পাট কিনবে না? পাট বিক্রি করে মাসুর জন্য একটা শাড়ি কিনবে। অনেকদিনের ইচ্ছা নিজের একটা নতুন জামার।  অন্তত পনেরো টাকা দিয়ে একটা ল্যান্ডী বাজার থেকে সিল্কের জামা কিনবে।

কাশীনাথপুরে পানি ঢোকেনি তখনও। আব্বাস মাসুকে নিয়ে সিনেমায় আসে। সিনেমা হলের মালিকের বাড়িতে আব্বাস ঘরের কাজ করেছে কয়েকদিন ধরে।  সিনেমা দেখার ইচ্ছার কথা বলায় মালিক আসতে বলেছে। স্টেশন পর্যন্ত মাসু আর একবার এসেছিলো। আব্বাসের মামার বাড়ি বোনারপাড়ায় গিয়েছিলো ট্রেনে।  সিনেমা দেখে কলেজের মাঠ দিয়ে হাঁটা শুরু করে ওরা। ফাঁকা মাঠ। টিমটিমে আলো জ্বলে কলেজ হোস্টেলে। চাঁদ কলেজের বড় আমগাছটার মাথায়। হাঁটতে হাঁটতে মাসু  চারদিকে তাকিয়ে দেখে। আস্তে আস্তে হাঁটে। পেট ভার। মাসু বলে  ‘কলেজটা তো ভালা। এ্যই আমাগো পোলা হইলে এহানটায় পড়াবা না?’ আব্বাস মাসুর কথার জবাব দেয় না। শুধু চারদিকে তাকিয়ে দেখে মাসুর হাতটা ধরে কাছে টেনে নেয়। মেহগেনি গাছটার নিচে মাসুকে বুকে জড়িয়ে ধরে। গাছের উপরে তখন জ্যোৎস্নার ছায়া বিস্তৃত।

সাগরের কথা আব্বাস স্কুলে পড়ার সময় স্যারদের মুখে শুনেছে। পানি আর পানি। কুলকিনারা নেই। ঢেউয়ের পর ঢেউ। জোয়ার ভাটা। আব্বাসের বাড়ির চারদিকে সেই সাগরের মতো পানি আর পানি। উঠানেও পানি, ঘরের ভিতরেও পানি। টংগের  উপরে মাসু শুয়ে। বুকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবজাতক। মাসুর শরীর ভীষণ দুর্বল। দিনদিন ওর দুর্বলতা বাড়ছে। আব্বাস শেষ সম্বল কোদালটা বিক্রি করে এক কৌটা বার্লি এনেছে। সরকারী ডাক্তারখানায় ওষুধ শেষ হয়েছে। বাইরে থেকে একটা ভিটামিন কেনার মতো পয়সা নেই। পানির ছয়লাবে কোথাও কাজও নেই।

আব্বাস কাশীনাথপুরে সাগরের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। মাথার অনেক উপরে চাঁদ। সাগরের উপরেও। মা বাচ্চার সাড়াশব্দ নেই। দূরে নঈমুদ্দী আকন্দের উঁচু ভিটা বাড়ির উঠানে  ধানের আটির পালা দেখতে পায় আব্বাস।

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন