কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


নিশিকান্তর অক্ষরস্মৃতি

দূর থেকে অন্যের জীবন নিরীক্ষণ করতে থাকে নিশিকান্ত। কত দ্রুত কেটে যায় অন্যদের জীবন! দিন, মাস, বছর - সোশ্যাল মিডিয়ায়, ছবিতে ছবিতে। অথচ  নিজের জীবন? তা আর কাটতে চায় না। নিশিকান্তর মনে হয়, অন্যের জীবন হয়ে নিজের জীবন দ্রুত কাটিয়ে ফেলবে। কিন্তু তারপর ভাবে, অন্যের জীবনের ভেতরে ঢুকলে, কাছ থেকে দেখলে হয়ত দেখতে পাবে সেগুলোও কাটতে চাইছে না চট করে! অন্যের জীবন কেমন নিশিকান্ত হয়ে গেছে! নাকি সবাই যে যার জীবনের ভেতর ঢুকলেই কোন এক স্থবিরতাপ্রবণ নিশিকান্ত বেরিয়ে আসে

মা মারা যাবার পর থেকে যখনি বাড়ি আসে নিশিকান্ত, মার হাতে লেখা একটা গল্প খোঁজে। চাকরীসূত্রে থাকা হয় না পাকাপাকি। ছমাসে একবার বাড়ি ফেরে, তখন চলে তত্ত্বতল্লাশ। কিন্তু তল্লাশে কি আর তত্ত্ব মেলে? গল্প? কই তাও তো আর মেলে না! সেই যে একটা পূর্ণবৃত্তের গল্প লিখেছিল মা! একটি মেয়ে, সদ্য বিয়ে করে বরের চাকরীর জন্য আমেরিকা গেছে, তারপর কি সব গন্ডগোল! বরকে যা ভেবেছিল মেয়েটি, সে আদৌ তা নয়! এরকম একটা প্লট ছিল। নিশিকান্তর প্রথাসম্মত লেগেছিল সে আখ্যান। মার চলে যাবার পর যদিও দরকার পড়েছে ঐ গল্পের। তা কি আখ্যানের জন্য নাকি হস্তাক্ষরের স্মৃতি ধরে রাখার তাগিদে? অনেক খোঁজার পর মায়ের ডায়েরি থেকে যে দিনলিপি খুঁজে পায় নিশি, তাতে কোন গল্প নেই, কেবল দুঃখের প্রকাশ! নিশির মন কেমন করে! এতদিন ভুগে মারা যাবার আগেই যেন মারা গিয়েছিল মা। ঐ লেখা এক মৃত মানুষের হস্তাক্ষর! ভোগান্তিভরা মাতৃজীবনও কি তবে দূরত্ব থেকে দেখলে নিস্তরঙ্গ লাগবে? ঠেকবে নাকি শান্তিপূর্ণ? মনে তো হয় না! মায়ের ব্যাপারে কি চার্লি চ্যাপলিনের সেই কথা খাটে না?-- "life is a tragedy when seen in close-up, but comedy in long-shot."

নিশিকান্তর এখনকার প্রশ্নটা একটু আলাদা। মায়ের জীবন জীবদ্দশায় ট্র্যাজেডি হলে মৃত্যু-পরবর্তীতে ফেরৎ তাকালে কি তাকে কমেডি মনে হতে পারে? মা  কেন, এটা কি সাধারণভাবে বলা যায়? মৃত্যুকে যদি আমরা ট্র্যাজেডি আর কমেডির ভেদরেখা ভেবে থাকি, যেখানে ট্র্যাজিকের বাংলা করা হয় বিয়োগান্তক, তবে কি মানুষ মারা গেলে তার ট্র্যাজিক জীবনও কমিক হয়ে যায়? মৃত্যুর পরের ইতিহাস যা কিনা এককালে ট্র্যাজেডি ছিল তা কি ফার্স হয়ে ফেরে নাকি ফোর্স হয়ে? এতশত প্রশ্নের মোকাবিলা করতে না পেরে নিশিকান্তর মন নুয়ে পড়ে ঘরের এককোণে।

মায়ের হাতে লেখা পাতাটা দেখতে থাকে নিশিকান্ত। সময় যেন থেমে গেছে সেখানে। রোগে ভোগা জীবন কি আর দ্রুত কেটে যায়? না ঐ পাতার অক্ষরগুলো বলছে সে জীবন কাটতে চায় না, চায়নি তখনো, যখন মা ছিল। হলুদ হয়ে আসা পাতায় ভাঙা ভাঙা নীল বাক্যেরা একদিকে যেমন বলছে না কাটতে চাওয়া রোগপ্রবণ জীবনের কথা, আবার অন্যদিকে তারাই আত্মসচেতন হয়ে জানান দিচ্ছে - মৃত এক মানুষ লিখেছে এই বাক্যগুলো। মৃত্যুর আগে আরেকটা মৃত্যু  হতে পারে। তাই হয়েছিল মায়ের বেলায়। 

নিশিকান্তর মনে একটাই বাক্য হাওয়া কেটে শেষ বিকেলের ঘাটে জল গিলে যাচ্ছে অকাতরে:

ইচ্ছার মৃত্যু হলে জীবন নিজেই মৃত্যু বনে যায়।

মায়ের কেটে যাওয়া জীবনের বাইরে বেরিয়ে নিজের জীবনে ঢুকতে পারছে না নিশিকান্ত। অথচ নিজের জীবনে প্রবেশ করা জরুরী! নচেৎ সে জীবন কাটাবে কি করে? ডায়েরির পাতায় মার হাতের লেখার একটা ছবি তুলে নেয় নিশি। পাতার উপর সন্ধ্যা নামছে। সন্ধ্যা নামছে অক্ষরে।

প্রতিলিপি স্বস্তিদায়ক।

প্রতিলিপি গুনগুন করে বলে মৃত্যু-পরবর্তী অন্য এক জীবনের কথা।

সে জীবন লিখনের, সে জীবন ছবির! কিন্তু না, সে জীবন আর যাই হোক, গল্পের নয়!

  


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন