কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

রামশরণ শর্মা

 

প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা


(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)




(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social history of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)

*অধ্যায় - ২ / ৪*

 

*উৎস (Origin):*

বর্তমান পর্যালোচনার ভিত্তিতে এটি বলা অত্যুক্তি হবে না যে, আর্যরা ভারতে এসেছিল বিরাট সংখ্যায়। কিছু শত্রু উপজাতি, যোদ্ধা এবং পুরোহিতদের সম্ভ্যাব্য সংমিশ্রণ, আর্য জনসাধারণের কেবল একটি সংখ্যালঘু অংশ ছিল মাত্র। সময়ের সাথে সাথে আর্যদের সংখ্যাগুরু অংশ সাধারণ জনতার স্তরে অবনমিত হওয়া থেকে রেহাই পেতে পারতো না। কিন্ত ঋক-বৈদিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পৃথকীকরণ প্রক্রিয়াও ছিল অত্যন্ত প্রারম্ভিক স্তরে। প্রধানত পাহাড়ী উপজাতি-গোষ্ঠীর একটি সমাজে, সামরিক বাহিনীর নেতাদের, কষ্টকরভাবেও নিশ্চিত ও ধারাবাহিক খাদ্যশস্য বা গবাদিপশু যোগানের কোনো উৎস ছিল না, যার ওপর নির্ভর করে তারা এবং তাদের যাযকীয় সমর্থকেরা বেঁচে থাকতে ও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। তাদের আয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসটি নিহিত ছিল সময় বিশেষে রাজস্ব আদায় করা এবং যুদ্ধ-বিধ্বস্ত মানুষদের কাছ থেকে যুদ্ধ-জঞ্জাল লুঠ করা, যেগুলিরও সম্ভবত তাদের ভাগ দিতে হতো উপজাতির সদস্যদের। ঋগবেদে, 'বলি' (Bali) হচ্ছে একমাত্র শব্দ যা উদ্বৃত্ত সংগ্রহ করা বা আদায় করার প্রচলিত নিয়মকে (practice) নির্দেশিত করে। সাধারণ অর্থে এটি রাজস্ব অথবা দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত নৈবেদ্য-কে বোঝায়, কিন্ত এটি রাজাকে প্রদত্ত রাজস্ব অর্থেও ব্যবহৃত হয়। খুব সম্ভবত 'বলি' ছিল ঐচ্ছিক, কারণ এটি সংগ্রহ করার না কোনো নিয়মিত ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব ছিল, না ছিল এর কোনো সংগ্রাহক, যেমনটি ছিল 'বলিসহায়াক'-এর ক্ষেত্রে (balisahayaka), বৈদিক যুগ পরবর্তী পর্যায়ে জনতার কাছ থেকে এটি সংগ্রহ করার জন্য। আপাতদৃষ্টিতে উপজাতীয় জ্ঞাতিগোষ্ঠীরা, তাদের ন্যাস্তদ্রব্য ও স্বেচ্ছাকৃত উপহারসমূহ প্রদান করতো তাদের প্রধান-কে, যার বিনিময়ে তিনি যুদ্ধ জয়ের ক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্ব দিতেন এবং তাদের যুদ্ধ-জঞ্জালের (spoils of war) ভাগ নেওয়া মঞ্জুর করতেন।

একমাত্র পরাজিত বিদ্রোহী উপজাতীরা বাধ্য ছিল 'বলি' দিতে বা স্বেচ্ছাকৃত উপহার প্রদান করতে। এছাড়াও খুব বেশি হলে রাজপুত্র ও পুরোহিতেরা, নারী ক্রীতদাসদের গৃহস্থালী বা পশুপালনের কাজে ব্যবহার করতে পারতো। ঋক বৈদিক পরিবারগুলি নিজেদের জমি নিজেরাই চাষ করতো বলে মনে হয়, এবং এটি মনে হওয়ার কারণ এই যে, ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষায় বেতন (wages) সংক্রান্ত কোনো সাধারণ শব্দের অস্তিত্ব ছিল না। ঋগবেদ এমনকি কৃষি-সংক্রান্ত ক্রীতদাস বা বেতনভোগী মজুর অথবা ভাড়াটে-মজুরদের (karmakara) সম্পর্কেও জ্ঞাত ছিল না, যারা কৃষিকাজের গুরুত্বপূর্ণ সব উপাদান হিসেবে অস্তিত্বে এসেছে বৈদিক-যুগ পরবর্তী পর্যায়ে। অনুগামী যোদ্ধা বা পুরোহিতদের  উপজাতীয় প্রধানদের দ্বারা অনুদান স্বরূপ জমি প্রদানের কোনো নিদর্শনও পাওয়া  যায়নি, সম্ভবত এই কারণে যে, কৃষিজাত জমি সামগ্রিকভাবে উপজাতীয় অধিকারভুক্ত ছিল। ঋক-বৈদিক সমাজের প্রায়-সমমাত্রিক (near egalitarian) চরিত্রের প্রমাণ পাওয়া যায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রে সমান দন্ডপ্রদানের বিধান থেকে, আর ক্ষতিপূরণের পরিমান ছিল একশত গরু।

সারমর্মের দিক থেকে, ঋক-বৈদিক আর্য সমাজের চরিত্রায়ন করা যায় তার সদস্যদের মধ্যে তীব্র শ্রেণী-বিভাজনের অনুপস্থিতির মধ্য দিয়ে, যেটি এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যা সাধারণত পরিলক্ষিত হয়ে থাকে প্রাচীন উপজাতীয়  সমাজগুলিতে। এই ধরনের সমাজে, বিভিন্ন পদমর্যাদা থাকা সম্ভব, কিন্ত নানান সামাজিক শ্রেণীর অস্তিত্ব সম্ভবপর ছিল না। বর্ণের উৎস সম্পর্কিত পৌরাণিক জল্পনা হয়ত এই স্তরটিকেই নির্দেশিত করেছে, যখন সেটি বিবৃত করে যে, ত্রেতা যুগের আবির্ভাব পর্যন্ত বর্ণের ভাগ-বিভাগ এবং লালসা অথবা চুরির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কিন্ত এমনকি প্রাচীন কালেও, ধীরগতিতে উদীয়মান সামরিক প্রধান ও পুরোহিতদের সাথে সাথে ক্ষেতমজুর ও কারিগরদের অস্তিত্বও ছিল, যারা নানান রকমের কারুশিল্পের অনুশীলন করতো। তাঁতী, চামার, ছুতারমিস্ত্রী, পটুয়া (painter) প্রভৃতির সাধারণ জবান (Common word) সুপারিশ করে যে তারা ছিল ইন্দো-ইউরোপিয়ান। রথ-এর (chariot) একটি বহুবিস্তৃত ইন্দো-ইউরোপিয়ান শব্দের অস্তিত্ব দর্শায় যে, রথ-প্রস্তুকারীরা হয়ত ইন্দো-ইউরোপিয়ানদের সাথে পরিচিত ছিল। রথকার (rathakara), (অর্থাৎ রথ-প্রস্তুতকারক) শব্দটি যদিও ঋগবেদে প্রদর্শিত হয়নি, তথাপি ছুতোরমিস্ত্রীদের কাজের কথা প্রথম দিকের কয়েকটি অংশে উল্লেখিত হয়েছে। অথর্ববেদ থেকে জানা যায় যে, রথ প্রস্তুতকারক এবং ধাতু শ্রমিকেরা (karmakara), সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করেছিল। এই সংকলনের প্রাথমিক পর্যায়ে, এক নব-নির্বাচিত রাজাকে, একটি ভেষজ-মাদুলির (plant-amulet) (অথর্ববেদ-এর ভাষায় parna-mani) কাছে প্রার্থনা করতে দেখা যায় যে, রথ-প্রস্তুতকারক এবং সুদক্ষ ধাতু-কারিগরেরা, যারা সর্বদা রাজার চারপাশ ঘিরে থাকে, তাদের মধ্যে রাজার নিজের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য তাঁকে সাহায্য করতে। এর অর্থ, সেইসব কারিগরদের তাঁর অধীনস্থ সহকারী হিসেবে স্থান নির্দেশ করতে প্রার্থনা করা হচ্ছে। রথ-চালক (suta) এবং সৈন্যদলের প্রধানেরা (gramani), যারা নিজেদের রাজার সমতুল্য বলে মনে করে অথচ যারা রাজার চারপাশ ঘিরে থাকা লোকজনের একটি সমষ্টি মাত্র, তাদের তথা এই জাতীয় অন্যান্য লোকেদের, তাঁর সহকারী হিসেবে স্থান নির্দেশ করতে প্রার্থনা করা হচ্ছে।

স্পষ্টতই উপরোক্ত কারুশিল্পসমূহ  অনুশীলিত (practised) হতো আর্য সমাজের সদস্যদের (vis) দ্বারাই এবং তাদের ওপর কোনো পাংশু সামাজিক প্রতীকও (stigma) আরোপিত করা হয়নি। ঋগবেদের পরবর্তী একটি অংশে ছুতোরমিস্ত্রীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে তারা সাধারণত পিঠে ব্যথা অনুভূত না হওয়া ইস্তক কাজের ওপর ঝুঁকে থাকতো। এই অংশে বিভিন্ন ধরনের কাজ সম্পর্কে কিছু ধারণা জ্ঞাপন করা হয়েছে, কিন্ত সেগুলি সম্পর্কে অবজ্ঞাসূচক কোনো অর্থ প্রকাশ করা হয়নি। ছুতার-রা নীচু জাতের ছিল বা তারা ভিন্ন জাতের মানুষের একটি শ্রেণীর উদ্ভব ঘটিয়েছিল, এমনটি নিশ্চিতভাবেই বৈদিক পর্যায় সম্পর্কে সত্য ছিল না। কিন্ত কামার (kamara), ছুতোর (taksan), চামার (carmamna), তাঁতী (weaver) এবং অন্যান্যদের, যাদের জীবিকা  ঋক-বৈদিক পর্যায়ে যথেষ্ট সম্ভ্রমশালী ছিল এবং আপাতদৃষ্টিতে ভিস (vis)-এর সদস্যদের দ্বারা প্রশংসিত হতো, তারাই পালি পাঠ্যাংশসমূহে (Pali texts) শূদ্র (sudra) হিসেবে পরিগণিত হতে লাগল। এটি স্বাভাবিক যে, অনার্যরাও স্বাধীনভাবে এই ধরনের কারুশিল্পসমূহের অনুশীলন করতো, কিন্ত এবিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, অনেক বিক্ষুব্ধ আর্য কারুশিল্পীরা, যারা নিজেদের পুরনো জীবিকাকে আঁকড়ে ধরে বসেছিল, তাদের শূদ্রদের অবস্থানে নির্বাসিত করা হয়েছিল।

চতুর্বর্ণ সম্পর্কিত সবচেয়ে পুরাতন ভবিষ্যদ্বাণীর সন্ধান পাওয়া যায় ঋগবেদ-এর 'পুরুষাসুক্ত' (পুরুষের সৃষ্টি) নামক স্তবগানের পৌরাণিক কাহিনীতে। এটিকে এই সংক্রান্ত সংকলনের দশম গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত করা হয়। কিন্ত এটিকে ঋক-বৈদিক সাহিত্যে, পুরাণসমূহে ও ধর্মশাস্ত্রে সামান্য পরিবর্তন সহ এবং মহাকাব্যের ঐতিহ্য অনুসারে পুনঃপ্রকাশিত করা হয়েছে। যেটি বিবৃত করেছে যে, ব্রাহ্মণেরা উদ্গত হয়েছে (emanated) আদি মানবের মুখ (mouth) থেকে, ক্ষত্রিয়রা তার বাহু (hands) থেকে, বৈশ্যরা তার উরু (thighs) থেকে এবং শূদ্রেরা তার চরণযুগল (feet) থেকে। এই অংশটি হয় সুচিত করে যে শূদ্ররা সেই উৎসমূলে অবস্থান করতেই অনুমিত হয়েছিল এবং সেই কারণে তারা আর্য  সম্প্রদায়েরই একটি অংশে পরিণত হয়েছিল অথবা অন্যথায়, সেটি বিভিন্ন উপাদানে গঠিত (heterogeneous) ব্রাহ্মণ্য সমাজের একটি সাধারণ পৌরাণিক উৎস সন্ধানের প্রচেষ্টার প্রতিনিধিত্ব করেছে। সময় বিশেষে পুরুষাসুক্ত'র  দৃষ্টিকোণ-কে  (vision) অথর্ববেদ পর্যায়ের শেষে এতে আরোপিত করা যেতে পারে, যেটি হবে এর সর্বশেষ পর্যায়, সম্ভবত সুদূর বিলম্বিত ৮০০ খৃষ্ট পৃর্বাব্দে। মনে হয় এটি উপজাতীয় সমাজের বিভক্তিকরণের মাধ্যমে শ্রেণীসমূহ সৃষ্টি করার একটি তত্ত্বগত ন্যায্যতা (theoretical justification) প্রদান করতে চায়। ঋক-বৈদিক পর্যায়ে শ্রমের বিভক্তিকরণ প্রক্রিয়া, ইতিমধ্যেই বহু দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। কিন্ত যদিও একই পরিবারের সদস্যরা কবি, চিকিৎসক এবং পেষাইকারী (grinder) হিসেবে কর্তব্যরত থেকেছে, তথাপি সেটি কোনো সামাজিক বিভেদের সাথে সংযুক্ত হয়নি। যদিও অথর্ববেদ পর্যায়ের শেষের দিকে, কাজকর্মের পৃথকীকরণ-কে কেন্দ্র করে, সমাজটি পদ, জাতি ও বংশগত ভাঙ্গন বিকশিত হওয়ার দিকে ঝুকেছে এবং ক্রমে ক্রমে সামাজিক শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। এটি মনে হয় যে শূদ্র-উপজাতি অথবা বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত আর্যদের অংশগুলিকে চতুর্থ বর্ণের অবস্থানস্থল প্রদান করা হয়েছিল এবং সেই অর্থে চারটি বর্ণের সাধারণ উৎসের ঐতিহ্যে, সত্যের উপাদান থাকতে পারে। এটি সম্ভব যে উত্তরকালীন সময়ে, আর্য-শূদ্রদের মধ্যেকার বিক্ষুব্ধরা নতুন উর্বর গাঙ্গেয় উপত্যকার বসতিগুলিতে সংখ্যাগতভাবে গুণকারক হারে বৃদ্ধি পেতে থেকেছে, কিন্ত তথাপি বৈদিক পর্যায় থেকে, বৃহৎ সংখ্যক আদিম অধিবাসী বা  আদিবাসীদের অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়া ভান্ডারকে সফলতাপূর্বক শূদ্র বর্ণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্পষ্টতই, বর্ণের সাধারণ উৎস সম্পর্কিত পুরনো  ঐতিহ্য, অনার্য উপজাতিদের ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ে সংযোজনকে স্বীকার করে নিতে পারেনি, কিন্ত এটি একটি কার্যকর অলীক কাহিনী হিসেবে পরিবেশিত হতে পারে। এটি বিভিন্নধর্মী (heterogeneous) উপাদানসমূহকে সম্মিলিত করে ও একত্রে ধরে রাখতে সাহায্য করতে পারে এবং যেহেতু শূদ্রেরা আদিম মানুষের পদযুগল থেকে উদ্গত হয়েছে বলে অনুমিত হয়েছে, সুতরাং সেটি ব্রাহ্মণ্য সমাজে তাদের ক্রীতদাসতুল্য অবস্থানকে যুক্তিসিদ্ধ করতে পারে।

কবে প্রথম শূদ্রেরা উচ্চতর তিনটি বর্ণের সেবা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে একটি সামাজিক শ্রেণী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল? ঋক-বৈদিক সমাজে কিছু পুরুষ ও নারী ক্রীতদাস ছিল, যারা গৃহস্থালীর কাজে দাসের ভুমিকা পালন করত, কিন্ত তারা শূদ্রদের মতো ক্রীতদাস বর্ণের গঠনকারী হিসেবে বিবেচিত হতো না। একটি সামাজিক শ্রেণী হিসেবে শূদ্রদের প্রথম ও একমাত্র উল্লেখ পরিলক্ষিত  হয়েছে ইতিমধ্যেই উল্লেখিত ঋগবেদের পুরুষাসুক্ত অংশে, যার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে অথর্ববেদ-এর উনবিংশতিতম গ্রন্থে। একই গ্রন্থে, আরো দুটি অংশ আছে, যেগুলিতে চতুর্বর্ণের অস্তিত্বের কথাও উল্লেখিত হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে দুর্বা ঘাসের (grass) কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে -- উপাসকদের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র ও আর্যদের প্রিয়পাত্র করে তুলতে। এক্ষেত্রে আর্য বলতে সম্ভবত বৈশ্যদের  বোঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় অংশটিতে ঈশ্বর, রাজা এবং শূদ্র ও আর্য, উভয়েরই প্রিয়পাত্র হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মনে হয় ঈশ্বর ব্রাহ্মণের পরিপূরক এবং আর্য বৈশ্যের পরিপূরক। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই সমস্ত গ্রন্থাংশগুলি উনবিংশতিতম গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে, যেটি বিংশতিতম গ্রন্থের সাথে একযোগে অথর্ববেদ-এর প্রধান সংকলনের একটি সম্পূরক অংশের গঠন করেছে। একটি পূর্বোক্ত গ্রন্থাংশ, ব্রাহ্মণ, রাজন্য অথবা শূদ্রদের দ্বারা প্রস্তুত একটি কবচ-এর (charm) কথা উল্লেখ করেছে এবং তার সাথে একটি জাদুমন্ত্রের উচ্চারণ অন্তর্ভুক্ত করেছে, যার প্রয়োগের মাধ্যমে সেটি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রত্যাগমন করতে পারে। এটি অংশভুক্ত হয়েছে অথর্ববেদ-এর দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ বিভাগে (Book VIII-XII), যেটি হুইটনি'র (Whitney) মতানুসারে পুরোহিতদের উৎস সংক্রান্ত বলে প্রতীয়মান হয়। এটি নির্দেশিত করে যে, বর্ণ ব্যবস্থার চিন্তাধারা বিকশিত হয়েছে যাজকীয় প্রভাবে।  আমাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একমাত্র উল্লেখটি, যেটিকে হুইটনী'র মূল নীতি অনুযায়ী অথর্ববেদ-এর প্রাচীন পর্যায়ে আরোপিত করা যেতে পারে, সেটি ব্রাহ্মণ, রাজন্য এবং বৈশ্যদের কথা উল্লেখ করেছে কিন্ত শূদ্রদের বাইরে রেখেছে। এটি স্পষ্ট যে শূদ্ররা একটি সামাজিক শ্রেণী হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছে একমাত্র অথর্ববেদ-এর শেষ পর্যায়ে, যখন হয়ত তাদের উৎস সম্পর্কিত পুরুষাসুক্ত সংস্করণটি ঋগবেদের দশম গ্রন্থে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

প্রশ্ন ওঠে যে, চতুর্থ বর্ণটি কেন 'শূদ্র' নামে পরিচিত। এটি প্রতীয়মান হয় যে, ঠিক যেমন সাধারণ্যে স্বীকৃত ইউরোপীয় 'স্লেভ' (slave) শব্দটি এবং সংস্কৃত 'দাস' শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে পরাজিত মানুষদের নাম থেকে, একই ভাবে শূদ্র শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে পরাজিত উপজাতিদের সেই নাম থেকে। কোনো সন্দেহ  নেই যে, চতুর্থ শতাব্দীতে, একটি উপজাতি হিসেবে শূদ্রদের অস্তিত্ব ছিল, কারণ ডিওডারোস (Deodaros) লিপিবদ্ধ করেছেন যে, শূদ্র নামক উপজাতির বিরুদ্ধে আলেকজান্ডার যুদ্ধে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং আধুনিক সিন্দ নামক অঞ্চলটিকে দখল করেছিলেন। গ্রীক লেখকদের দ্বারা উল্লেখিত কিছু উপজাতিসমূহের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া গেছে, প্রাচীন যুগের বহু পূর্বে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, আর্যদের আবাস্তোনোই (যেটিকে ডিওডারোস বলেছেন সম্বাস্তাই) শব্দটিকে চিহ্নিত করা যেতে পারে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এর আমবাস্থাস-এর সঙ্গে, যার দ্বারা এক আম্বাস্থা (Ambastha) রাজাকে উল্লেখিত করা হয়েছে।  শূদ্র উপজাতির ক্ষেত্রেও একই জিনিস প্রযুক্ত হতে পারে, এবং এইভাবে, আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর শূদ্র বর্ণ-কে খুঁজে পাওয়া সম্ভব খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতাব্দী থেকে খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর শূদ্র উপজাতি থেকে।

অথর্ববেদ-এর গোড়ার দিকের অংশে শূদ্রদের তিনটি উল্লেখের ব্যাখ্যা করা যায় এই আলোকে -- হুইটনী'র বিবরণ অনুযায়ী, তারা অথর্ববেদ (Book I-VII)-এর প্রথম মুখ্য বিভাগের অংশীভূত ছিল, যে বিভাগে বৃহৎ আকারের জনপ্রিয় উৎস সমূহ অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং যে কোনো মতভেদ অনুযায়ী, সেটি ছিল এই সংস্করণের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অংশ। এর মধ্যে দুটি অংশে উপাসকেরা, আর্য হোক অথবা শূদ্র, প্রত্যেককে দেখার এবং বনৌষধির সাহায্যে তাদের মধ্যে মায়াবী সনাক্ত করার অভিলাষ ব্যক্ত করেছে। এই প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণ বা রাজন্যবর্গের কোনো উল্লেখ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে যে, আর্য এবং শূদ্ররা কি এখানে দুটি সামাজিক শ্রেণীর (বর্ণের) অথবা দুটি উপজাতীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেছে? পরবর্তী অনুমানটি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। আর্য এবং দাস অথবা দস্যুদের মধ্যেকার পূর্ববর্তী বিরোধিতা প্রতিস্থাপিত (replaced) হয়েছে আর্য এবং শূদ্রদের মধ্যেকার বিরোধিতায়। এটি জোর দিয়ে বলার যায় যে, এই সমস্ত উল্লেখসমূহ, সামাজিক  দূরত্ব বা সামাজিক বৈকল্য সম্পর্কে কোনো ধারণা ব্যক্ত করে না, যেগুলি বর্ণে'র ধারণার মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে। এগুলির তুলনা করা যেতে পারে এই সংস্করণের অন্য একটি অংশের সাথে, যেটি আর্য এবং দাসেদের কথা বয়ান করেছে এবং যার মধ্যে পুরোহিত বা বরুণ (Varuna) দাবি করেছে যে, কোনো দাস বা আর্য, তাঁর দ্বারা প্রতিপালিত কার্যপরম্পরার কোনো ক্ষতিসাধন করতে পারবে না। ঋগবেদেও একই রকমের গ্রন্থাংশ সমূহের (passages) উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে উপাসকেরা বাসনা প্রকাশ করেছে তাদের শত্রুদের পরাস্ত করার, -- দাস অথবা দস্যু, উভয়কেই। ব্রাহ্মণ্য মন্তব্যকারীদের দ্বারা এই ধরনের বৈদিক রচনাসমূহের সঠিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যে একটি মাত্র প্রতিবন্ধকতা আছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে সামাজিক সম্পর্কের ওপর, সেটির প্রবণতা রয়েছে সামনের দিকের পরবর্তী বিকাশসমূহের দিকে দেখার। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে, ঋগবেদে দ্র্যা এবং দাস শব্দের অর্থ সম্পর্কিত। সায়ানা দ্র্যা শব্দটিকে গ্রহণ করেছেন প্রথম তিনটি বর্ণের সদস্য হিসেবে এবং দাস (dasa) শব্দটিকে শূদ্র (sudra) বর্ণের অন্তর্গত হিসেবে; এর ভিত্তি অবশ্যই রয়েছে পরবর্তী কালের চতুর্বর্ণে সমাজ বিভাজনের উপর, যেটিকে সায়ানার ব্যাখ্যা যুক্তিসিদ্ধ করতে চেয়েছে। একইরকম ভাবে, অথর্ব-বৈদিক উল্লেখসমূহ, যেগুলি আলোচনার পর্যায়ে ছিল, সেগুলিতে সায়ানা দ্র্যা-কে প্রথম তিনটি বর্ণের সদস্য হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যেটি স্বাভাবিক ভাবেই শূদ্রদের চতুর্থ বর্ণের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত করে। কিন্ত ধর্মশাস্ত্রে বিকশিত আর্য ও শূদ্র সম্পর্কিত এই ধারণার বশবর্তী হয়ে পূর্ববর্তী পাঠ্যাংশ সমূহকে ব্যাখ্যা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

 

(ক্রমশ)

  


1 কমেন্টস্: