কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় ইংরেজী ছবি – প্রাক-ইতিহাস থেকে ১ম পর্ব





 

আমার ইংরেজী ছবি দেখার প্রাক্-ইতিহাস

 

মা’র লেখা স্মৃতিচারণে দেখছি যে আমায় প্রথম সিনেমা হলে নিয়ে যাওয়া হয় ৩১শে মার্চ ১৯৫৯-এ অর্থাৎ তখনো আমার দু’বছর বয়স পূর্ণ হয়নি। বিরতি অবধি নাকি বেশ খুশীই ছিলাম। বিরতির পর মূল ছবি, ১৯৫৮ সালের Tom Thumb, অভিনয়ে পীটার সেলার্স ও টেরি টমাস, এর দুটি দৃশ্য দেখার পর বাবা আমার অধৈর্য দেখে আমাকে বাইরে ‘লবি’তে এনে বসেন। পরে কাজের লোকের সঙ্গে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রেক্ষাগৃহ ধর্মতলা-চৌরঙ্গী অঞ্চলের  ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক মেট্রো!

৩১শে জুলাই ১৯৬০-এ আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১৯৫৫ সালের Lord of the Jungle দেখতে। জনি ওয়াইসমুলারের টার্জান ছবিগুলিতে টার্জানের পালিত পুত্র ‘বয়’ করে বিখ্যাত জনি শেফিল্ড ‘বোম্বা’ নামে এক জংলী ছেলে সেজে যে ‘সিরিজে’ অভিনয় করেছিল, এটি সেই সিরিজেরই একটি। আবার, বিরতি অবধি দেখে আইসক্রীম খাবার বায়না জুড়েছিলাম। প্রেক্ষাগৃহের নামোল্লেখ মা করেননি। জানি না, এই ছবি দেখার সময়েই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম কিনা, “ঐ দেখ, দাদা, ‘নদীজলে ভেসে চলে হিপোপটেমাস’!” এই কীর্তিটিও মা’র মুখে শোনা! চোখের সামনে দিয়ে পর্দায় একটা বড় কুকুরকে চলে যেতে দেখেছিলাম, বাবা বলেছিলেন, “ঐ দেখো, কুকুর নিয়ে গেল!” ভেবেছিলাম কুকুরটি কি যকের ধন-এর বাঘা? বাঘা কিন্তু বিদেশী কুকুর নয়, দেশী, তা’ খেয়াল ছিল না। আর দৃশ্যটিও যে এই ছবিরই, তা’ও জোর গলায় বলতে পারব না!

৬ই ডিসেম্বর ১৯৬০-এ বাবা স্মৃতিচারণের খাতায় লিখছেন যে লাইটহাউস সিনেমায় আমায় ওজন করে দেখা গেছে যে আমি ৩৩ পাউন্ড। ছবির নামের উল্লেখ নেই। হতে পারে ছবি ছিল জুল ভের্নের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৫৯ সালের Journey to the Center of the Earth, অভিনয়ে জেমস মেসন ও গায়ক প্যাট বুন।

Tom Thumb বা Journey to the Center of the Earth-এর বিন্দুমাত্র কিছু আমার মনের পর্দায় ফুটে ওঠে না।

 

প্রাক্-ইতিহাস থেকে ইতিহাসের প্রথম পর্ব

১৯৬৩-র জানুয়ারিতে আমি কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে অবস্থিত সেন্ট লরেন্স স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে পড়তে শুরু করি। স্কুলে প্রতি বছর জুলাই মাসে স্কুলেরই বাসে চাপিয়ে পার্ক স্ট্রীটের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ৩৫ মিমি পর্দা-সম্বলিত প্রেক্ষাগৃহে নিয়ে যাওয়া হতো ‘রেক্টর দিবস’ উপলক্ষে ছবি দেখাতে। ১৮ই জুলাই ১৯৬৩-তে এখানে দেখলাম ইংরেজীতে ‘ডাব’ করা ১৯৫৯ সালের জাপানী ছবি, Magic Boy - কিছু দৃশ্য এখনো চোখে ভাসেঃ একটি মেয়েকে দুর্বৃত্তরা দু’-হাতে দড়ি বেঁধে খাদের ধার থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছে, কাহিনীর নায়ক সারুতোবি সেসুকে তাকে রক্ষা করবে। সেসুকের প্রতিপক্ষ এক প্রবল ক্ষমতাশালী দানবী ইয়াকুসা। এটি নাকি মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ারের মাধ্যমে ১৯৬১ সালে আমেরিকায় মুক্তি পাওয়া প্রথম ‘অ্যানিমে’ ছবি। এইরকম সময়েই আরও কিছু বিদেশী ছবির কথা মনে পড়ে। মেট্রোয় রবিবার সকাল সাড়ে দশটায় বাড়তি একটি শো হতো (সোম থেকে শনি সমস্ত হলেই ৩টি করে প্রদর্শনী চালু ছিলঃ ম্যাটিনি, ইভনিং, ও রাত – ৩টে, ৬টা, ও ৯টার আশে-পাশে। দুপুরের শো কলকাতায় এসেছে বোধহয় ৭০-এর দশকে)। এই সকালে মাঝে-মধ্যেই আসত স্বল্প-দৈর্ঘের একাধিক কার্টুনের সঙ্কলন। প্রথমে দেখেছি Tom and Jerry, তারপর Woody Woodpecker।

বাবা ভারতীয় সৈন্যদলে থাকার জন্য ১৯৫৯ থেকেই আমাদের বাসস্থান ছিল বালিগঞ্জ ময়দান ক্যাম্পের মধ্যে। এখান থেকে সবচেয়ে কাছে ছিল ভবানীপুর-কালিঘাট। আর সেখানকার বাংলা ছবির পাড়ায় রবিবার সকালে দেখানো হতো, পূর্ণ আর বসুশ্রীতে, ইংরেজী ছবি, ঊজ্জ্বলায় সাধারণত দক্ষিণ ভারতীয় ছবি। ব্যতিক্রম-হিসেবে ঊজ্জ্বলা এক রবিবার আনে আমার দেখা প্রথম Western: ১৯৫৮ সালের The Lone Ranger and the Lost City of Gold । ‘লোন রেঞ্জার’-এর কমিক্স বাড়িতে প্রচুর ছিল, দাদা সেগুলোর থেকে ছবি দেখিয়ে  আমায় গল্প বলতেন। তিনিই ছবিটি দেখতে আমায় নিয়ে যান, আমার বয়স তখন ৫ বা ৬। মনে আছে পর্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে লোন রেঞ্জারের সাদা ঘোড়া ‘সিলভার’ আর নেপথ্যে দরাজ গলায় গান হচ্ছে, “Hi yo Silver Away!” তারপর লোন রেঞ্জার সিলভারের পিঠে চেপে ধাওয়া করেছে আততায়ীদের, বার করেছে তার রূপোর বুলেট-ভরা রিভলভার, দাদা বলছেন, “দেখ, দেখ, লোন রেঞ্জার বন্দুক বার করেছে!” তার পরেই রিভলভারের নল দিয়ে ধোঁয়া আর দুম! কাহিনির মূল প্রতিপক্ষ এক মহিলা, যিনি স্বর্ণনগরের খোঁজে নিজের দলের লোককেও পেছন থেকে pickaxe ছুঁড়ে নির্দ্বিধায় খুন করেন! সবশেষে লোন রেঞ্জার আর তার লাল-মানুষ বন্ধু টোন্টো আবিষ্কার করবে সোনার শহর! এক চমকপ্রদ দৃশ্য!

পূর্ণ-তে (ঊজ্জ্বলার মতো এটিও এখন আর নেই, যদিও বাড়িটি দেখা যায়;  ঊজ্জ্বলার জায়গায় এখন নতুন ইমারত!) যত-না বাংলা ছবি দেখেছি, তার চেয়ে বেশী দেখেছি ইংরেজী! পূর্ণ-র প্রথম স্মৃতিই এক অতি স্নেহপ্রবণ টিকিট-চেকারের, যিনি “এসো ছোট ভাইটি আমার! কী দেখবে?” বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন। দেখতে গিয়েছিলাম ১৯৫৮ সালের Son of Robin Hood[1] গল্পের চমক হলো রবিন হুডের ছেলে নয়, মেয়ে ডিয়ারিং হুড! তরোয়াল খেলা ছিল আমার কাছে ছবির মূল আকর্ষণ! গল্প পরে মা’ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

এই পূর্ণতেই দাদা এক রবিবার সকালে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলেন, বাড়িতে যার সম্বন্ধে বই ঠাসা, সেই টার্জানের, আমার কাছে, প্রথম ছবি, ১৯৫৯ সালের  Tarzan’s Greatest Adventure,[2] এবং তার কয়েক রবিবার পরে, ১৯৬০ সালের Tarzan the Magnificent[3] পরে, ৮০-র দশকে, ব্রিটিশ টেলিভিশনে দুটি ছবিই আবার দেখেছি। অবাক হয়েছি যে প্রথমটিতে খলনায়কদের নেতা ‘স্লেড’-এর ভূমিকায় ছিলেন পরবর্তীকালে Operation Crossbow, Lawrence of Arabia, এবং আরও পরে শেক্সপীয়রের রচনার চিত্ররূপে অভিনয়কারী স্যর অ্যান্টনি ক্যোয়েল, আর স্লেডের এক সহকারীর ভূমিকায় শীঘ্রই জেমস বন্ড-রূপে যিনি বিখ্যাত হবেন, সেই শন কনারী! দাদার সঙ্গে আমার প্রথম দুটি টার্জান ছবি দেখি ৬ বছর বয়সে, আর সেই দাদারই মেয়ে, আমার ভাইঝিকে নিয়ে আশির দশকের শুরুতে মিনার্ভা, পরে নাম পালটে যা হয়েছিল ‘চ্যাপলিন’, প্রেক্ষাগৃহে দেখব ১৯৬২ সালের Tarzan goes to India,[4] যাতে Tarzan the Magnificent ছবির খলনায়ক কয় ব্যান্টনের ভূমিকায় অভিনয়-করা জক ম্যাহোনি আবির্ভূত হবেন নায়ক টার্জানের ভূমিকায়!

মোটামুটি এই সময়েই মা আর দাদার কাছে ট্রয় আর গ্রীসের যুদ্ধের গল্প শুনে  ভালো লেগেছিল। দাদা লাইটহাউসে নিয়ে গেলেন ১৯৬১ সালের The Trojan Horse দেখতে। প্রথম দৃশ্য এখনো চোখে ভাসেঃ অ্যাখিলিস তাঁর রথে বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ট্রয়ের মহাযোদ্ধা হেক্টরের মৃতদেহ, কারণ হেক্টরের হাতেই মৃত্যু ঘটেছিল অ্যাখিলিসের প্রাণাধিক সখা প্যাট্রোকোলাসের। প্যারিস, যার অদম্য লালসার জন্য এই বিধ্বংসী যুদ্ধ বাধে বলে মনে করা হয় (এখন পণ্ডিতেরা বলেন হেলেনের প্যারিসের সঙ্গে ট্রয়-পলায়নকে ছুতো হিসেবে ব্যবহার করে গ্রীস ঈজিয়ান সাগরে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সভ্যতাকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে!) কি রকম যেন হোঁদল-কুতকুতে, তবে ছবির মূল তারকা ইনিয়াসের ভূমিকায় স্টীভ রিভস (যিনি একাধিক ছবিতে হারকিউলিস-রূপে বিখ্যাত)। এরপর কাঠের ঘোড়ার মধ্যে লুকিয়ে গ্রীকেরা ট্রয় নগরে প্রবেশ করে শহর ও সভ্যতা একসঙ্গে ধ্বংস করে। হেলেনের স্বামী মেনেলস প্যারিসের চুলের মুঠি ধরে তার পেটে ঢুকিয়ে দেন তরবারি।

আর মনে আছে, এর অনেক পরে মক্ষমূলার ভবনে দেখা, কিন্তু আগে তোলা, ১৯৫৬ সালের Helen of Troy ছবিতে প্যারিস বারবার রথে-চড়া অ্যাখিলিসের দিকে তীর নিক্ষেপ করছেন, কিন্তু অ্যাখিলিসের শরীর তো একটি জায়গায় ছাড়া অভেদ্য! শেষে প্যারিস দেবরাজ জিউসকে স্মরণ করে তীর ছোঁড়েন, আর সেই তীর গিয়ে লাগে অ্যাখিলিসের গোড়ালিতে। মা থেটিস যে ওই গোড়ালি ধরেই ছেলেকে স্টিক্স নদীতে ডুবিয়ে তার দেহ অস্ত্রের পক্ষে দুর্ভেদ্য করেছিলেন! অ্যাখিলিসের মৃত্যু হয়।

প্রথম পর্ব এখানেই শেষ করছি। আপনারা অভয় দিলে আরও লিখব।

 



[1] By Source (WP:NFCC#4), Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=49449467

[2] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=26749132

[3] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=43190783

[4] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=26745430


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন