কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

নীতা বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


ওদের স্বাধীনতা উৎসব

ওরা ক’দিন ধরে হাঁটছে। লতিকা, শম্ভুনাথ, রোশেনারা, গণেশ, কৌশল্যা, লক্ষ্মীমণি,   মোতিবিবি, আয়েশা, মৃত্তিকা, রূপচাঁদ, মুন্নি… হাঁটছে… হাঁটছে… হাঁটছে… কোথায় যাচ্ছে জানে না। চর ডুবে গেলে ঘর ভেসে গেলে গাঁ ছাড়তে হয়। ভাসতে হয় সর্বস্ব হারানো মানুষদের। তাই ওরা হাঁটছে। অনিকেত অভি্যানের মানুষগুলোর কিচ্ছু নেই বললে ভুল বলা হবে। ওদের আছে বারে বারে সবহারানোর জব্বর ইতিহাস। সেই ন্যাংটো ইতিহাস কোলে কাঁখে নিয়ে ওরা হাঁটছে ক’দিন ধরে। কিন্তু এ কোথায় পৌঁছালো? মনে হচ্ছে কোনো শহর হবে! আর তো পা চলে না! যে মাটির দিকে তাকিয়ে তাদের প্রতি পদক্ষেপ, সেই মাটির এক কণাও যে তাদের কি না, একথাও ভাবতে জানে না ওরা।

এ কোন তেপান্তরের মাঠে এলাম রে পদ্ম? চোখ চাওয়া চাওয়ি করে ওরা।

এতবড় একখানা মাঠের ওই পাশে অনেক লোক জড়ো হয়েছে কেন? রায়ট লেগেছে নাকি? রায়টের সাথে যে ওদের খুব খারাপ একটা অভিজ্ঞতা জড়িয়ে আছে! লতিকা মোতিবিবি দুজন দুজনকে ভয়ে জড়িয়ে ধরে। না কি ওরাও বানভাসী মানুষজন আমাদের মতো? শম্ভু বলে, আরে না না। ওই দ্যাখ আমাদের সাঁইচরে যেমন বছরে একদিন শহরের বাবুরা ম্যাডামরা এসে পতাকা তোলে, লেকচার করে, বন্দেমাতোরোম গান হয়, জয়হিন্দ বলে চেঁচায়, এখানেও দ্যাখ তেমনি পতাকা তুলতে এসেছে মনে হচ্ছে রে। ওই দ্যাখ তিরঙ্গা উড়ছে। ছোট্ট মুন্নি ঘ্যানঘ্যান  করছিল অনেক্ষণ ধরে। এখন আধো আধো স্বরে জিজ্ঞেস করে তিরঙ্গা কি রে মা? মোতিবিবি বলে ওই যে ফেলাগ দেখচিস, ওটাকেই তিরঙ্গা বলে। আসলে সে নিজেও জানেনা তিরঙ্গা মানে কি। থামিয়ে দিয়ে বলে ওই দ্যাখ দড়ি টেনে পতাকা তুলছে আর কেমন ফুল ঝরে পড়ছে মাটিতে! পতাকার তলায় সাদা সবুজ গেরিমাটি রঙের আবির দিয়ে কি যেন আঁকা দেখছি! ক্লাস ফাইভে পড়া বাপ্পা বললো, ওটা ভারতবস্যের ম্যাপ।

এতবড় ফাঁকা মাঠ দেখে তো ওরা বেজায় খুশি। কী আশ্চয্যি, এত বড় জায়গাটাতে একটাও ঝুপড়ি নেই, একটাও কুঁড়েঘর নেই! ওরা খানিকটা জায়গায় ছড়িয়ে  বসেছে।  মৃত্তিকার কাঁচ ফুটে যাওয়া পা খানায় এখনো রক্ত বেরোচ্ছে। এতখানি জায়গা দেখে মৃত্তিকার পায়ের ব্যথার কথা মনে পড়েছে। গাছের ছায়া দেখে ও দিব্যি  গুটিয়ে শুটিয়ে পুঁটলির পাশে শুয়ে পড়েছে।

মাঠের ওপাশে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দিচ্ছেন কেউ। মাইক্রোফোনে তার গলা  শোনা যাচ্ছে। এখানে দেখতে পাচ্ছেন, এই যে ঠিক আমার পায়ের কাছে লাল সবুজ হলুদ রঙের আবির দিয়ে যে মানচিত্র আঁকা হয়েছে, এটা আমাদের দেশের মানচিত্র। এই দেশ আমাদের জন্মভুমি। আমরা সবাই ভারতবাসী। আমাদের প্রত্যেকের হক আছে এর প্রতিটা ইঞ্চি মাটিতে। জয় হিন্দ। বন্দে মাতরম্‌। ভারত মাতা কি জয়। একপেট ক্ষিধে নিয়ে ওরা  মুগ্ধ হয়ে শুনছে। সব ভুলে ওরাও চেঁচিয়ে উঠেছে জয় হিন্দ। বন্ধেএ এ এ এ মাতোরোম।

মানচিত্র কী মা?  

চুপ কর না! সেই থেকে কী কী করছে! ওই যে বল্লো না, আবির মাখা আলপনার  মতো, ওটাই হবে বোধহয়! আমি কি ইস্কুলে পড়েচি কুনোদিন যে ওসব ইংরিজি  কতার মানে জানবো! মুন্নি ভাবে, সত্যিই তো! আমি ইস্কুলে গিয়েও মানে জানি না। মা কী করে জানবে! পাশের থেকে একজন ভদ্রলোক বললেন, ওটা আমাদের  দেশের ছবি। বুঝলে না? মা-মেয়ে একসাথেই প্রায় বলে উঠলো, দেশ বুঝি এরকম আবির লেপা হয়? ভদ্রলোক যেতে যেতে বললেন, শুধু আবির কেন, রক্তমাখাও হয়।      

আরে আরে! এরা কারা রে? কোত্থেকে এলো? চল তো দেখে আসি! কোনো গ্রামের  থেকে এসেছে বোধহয় আমাদের স্বাধীনতা উৎসব দেখতে! দাঁড়া নেতা মশাইকে  বলি যে আপনার লেকচার শুনতে কতদূর থেকে মানুষজন এসেছে দেখুন।

স্যার, মাঠের ওখানটায় কারা যেন এসে বসে আছে। দেখে মনে হ’লো বড্ড গরিব।  লেকচার আর গানের পরে তো খাবার দেওয়া হবে সবাইকে। ওদের জন্যেও… কথা শেষ করতে পারে না ধৃতিমান বিবস্বান দেবমাল্য। মাঝখানে ওদের থামিয়ে দিয়ে একধারে টেনে এনে স্যার বলেন, ওই যে পুঁটলি টুটলি নিয়ে বসে আছে, ওদের কথা বলছো? একদম ওদের পাত্তা দেবে না। তাড়িয়ে দাও ওদের। খেতে পেলেই শুতে চাইবে। তখন ঠেলা সামলাতে পারবে তো? দেখো, দুদিন যেতে না যেতেই এই মাঠ ওরা দখল করে ঝুপড়ি ঘরে ভরিয়ে দেবে। ছিঃ। এলাকার নেতা দয়াময় মুখার্জী মুখ বিকৃত করেন। কোথা থেকে যে এই রাস্তার লোকগুলো…!  ছেলেরা অবাক হয়ে   ওদের নেতাকে দেখতে থাকে। এক্ষুণি যে তিনি সকলের অধিকার নিয়ে ভাষণ  দিচ্ছিলেন!

দেবমাল্যদের দিয়ে ওদের সরানো যাবে না বুঝতে পেরেছেন নেতা স্যারটি। খুব সরলতা আর সহানুভুতি ওদের কচি মুখে। উনি দেরি না করে তাঁর দলের ছেলেদের ডেকে ওদের তাড়িয়ে দেবার অর্ডার দিয়ে দেন।  

এই। চলো ভাগো এখান থেকে। ওঃ! পোঁটলা পুটলি নিয়ে জুড়ে বসেছে সব! ভাগ ভাগ…  

ভাগতে ভাগতেই তো এপর্যন্ত এসেছে ওরা। পেছন থেকে তাড়া খেয়ে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করেছে লোকগুলো। ভিড় ভেঙে একেবারে পতাকার কাছে চলে এসেছে। আর তো ওদের দম নেই। ভাগো ভাগো শুনতে শুনতে বানভাসি চরভাসি ঘরভাসি ওরা আবিরে রাঙানো ভারতের মানচিত্রের ওপরই শুয়ে পড়ে কাতরাচ্ছে। লাল হয়ে উঠেছে ওদের ময়ালা শাড়ি-ধুতি-লুঙ্গি। আর, সব চিৎকার ছাপিয়ে সাউন্ডবক্স কাঁপিয়ে গান বাজছে  “সারে জহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হমারা / হম বুলবুলে হ্যাঁয় ইসকি, ইয়ে গুলিস্তাঁ হমারা…”

                                                                                                         

 

   

  

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন