কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২

শুক্লা মালাকার

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৯


সোফা

এত জোরে কথা বলছে রিয়া বসার ঘর থেকে, ছেলেটা ঠিক শুনতে পাবে। গত  বছর যখন এসেছিল গোটা চারেক ঢাউস কাঁঠাল, আমড়া, দুটো মোচা, চার টুকরো থোড় আর একটা বড়ব্যাগ ভর্তি আম এনেছিল। সপ্তাহভোর ঘরময় আম কাঁঠালের গন্ধ। রিয়ার গা-বমি হচ্ছিল। পার্টি বাতিল করতে হয়েছিল রিয়াকে। আকাশ নিজেও বিরক্ত হয়। কাঁঠাল ছাড়িয়ে খাওয়ার লোক বহুদিন গত হয়েছে। রাঁধুনিরাও আজকাল থোড় মোচা রান্না করতে পারে না। কিন্তু তাদের বোঝাবে কে?

সদ্য বিধবা দূরসম্পর্কের অসহায় এক আত্মীয়াকে ঠাকুমা সস্তায় কিনে রাখা  কাঠা ছয়েক জমি থাকার জন্য দিয়েছিল। সঙ্গে ঘর করার জন্য চারহাজার টাকা। এর বেশি কিছু আকাশ জানে না, জানতে চায়ও না। এটুকু জানে বছরে একবার   বালিগঞ্জের এই বাড়ি সদ্য পেড়ে আনা আম-কাঁঠাল ইত্যাদি প্রভৃতিতে ভরে যাবে। সেই রাজপুর চৌহাটি থেকে নানান মাপের ছেঁড়াখোঁড়া ব্যাগ বয়ে এনে  একজন তাদের সাজানো বসার ঘরে বেমানান জড়সড় হয়ে বসে থাকবে।

আকাশ দেখেছে, দাদু-ঠাকুমা বসার ঘরে বেতের চেয়ারে বসে কথা বলতেন।  ঠাকুমা যত্ন করে দুপুরের ভাত খাইয়ে তারপর বাড়ি পাঠাতেন। পুরোটা সময় ঘাড়ে পাথর নিয়ে গ্যালিলিওর ছবির কথা মনে হতো আকাশের। বাবা দু-চার কথায় ইতি টানতো। ঠাকুমা যতদিন ছিলেন বাকি সময়টা তিনিই সামলাতেন। মায়ের স্কুল ছিল। লুচি-আলুর তরকারি, অমলেট-মিস্টি আর চা, ঘন্টাখানেকের ব্যাপার। 

বসার ঘরের দিকে যেতে যেতে ঠাকুমার গায়ে জড়াজড়ি করে দেখা আধবুড়ো লিকলিকে এক মানুষের কথা মনে পড়লো। প্রথম যেবার তার সমবয়সী একটি ছেলে সঙ্গে এসেছিল, সেবার বুঝেছিল, লোকটা বাবার থেকে খুব বড়ো না। পরপর তিনবছর সেই বাচ্চার সাথে বসার ঘরে দেখা হয়েছে, কিছুটা সময় কেটেছে। তারপর তো আকাশ রেসের মাঠে।

ঠাকুমা মারা যাবার দিন লোকটা তার মাকে নিয়ে এসেছিল। প্রথম সেই মা নাকি তার পনেরো বছরের ছেলেকে নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিলেন। ছেলে বড়ো হয়ে লোক হলে আর আসেননি।   

রান্নাঘরে মুখ বাড়িয়ে শেফালীদিকে চা-টোষ্ট বানাতে বলে এলো। বাবা চলে যাবার  পর মা কি একটু বদলে গিয়েছিল? নাকি রিটায়ার হয়ে ঘরে থাকতো বলে অতটা সময় দিত? ততদিনে ওদিকের লোক বদলে গেছে। যে বছর লাস্ট সেমেস্টার সেই বছর বাবার কেনা কালো লেদারের সোফাতে আকাশ এক ঝকঝকে পোশাকে উজ্জ্বল চোখের তরুণকে দেখেছিল। আগে মা ওদের জিনিসপত্র নিয়ে আসা বন্ধ করার কথা বলতো। রিয়ার কাছে শুনেছে কয়েক বছর মা নাকি ছেলেটিকে নিজে বসে থেকে জলখাবার খাইয়েছে। সরকারী দপ্তরের হিসাবরক্ষক সে। তাকে গত বছর নতুন শাড়ি জামা কেনার টাকাও দিয়েছে মা।

বসার ঘরে ঢুকেই রিয়ার কেনা বিশাল সোফাসেট জুড়ে ছটফটে মিষ্টি এক পরীর দেখা পেল আকাশ। ছেলে রিক ছুটে গেল সেদিকে। পাশে বসা ফিটফাট যুবকের হাসিমুখ দেখে লজ্জা পেল। ওর নামটা তো জানেই না আকাশ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে চেন বন্ধ ব্যাগের সংখ্যা কমেনি একটুও।

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন