কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

রাহুল দাশগুপ্ত

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


(৩১)             

অনির্বেদ আর কথা বাড়ায় না। শ্রমণ দাঁড়িয়ে থাকে। অনির্বেদ ওদের অনুসরণ করে। কিন্তু অতলান্ত আর বিহান এখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত। ঠিক কথাও নয়, ওরা নিজেদের মধ্যে হাসি-মস্করা করছিল। অনির্বেদের  অস্তিত্বই যেন ওরা ভুলে গেছে। এত তাচ্ছিল্য! নিজেকে খুব অপমানিত লাগছিল অনির্বেদের। পা ভারী হয়ে উঠেছিল। তবু ও নিজেকে থামাতে পারছিল না। ভেতর থেকে কে যেন ওকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল।

অতলান্ত একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ফুলচর্চা তাহলে কবে বেরোচ্ছে?

সেটা আগ্নেয়ই জানে। ফুল নিয়ে একটা গোটা সংকলন। ওরই আইডিয়া। তবে প্রথম লেখাটা তোরই থাকছে। আমিও তাই চাই। একটা বড়ো লেখা দিতে হবে...

আর কে কে লিখছে?

অনেকের কথা ভেবেছি। তবে মুখ্য আকর্ষণ তোরটাই।

হৃদয় লিখছে না? হঠাৎ জানতে চাইল অতলান্ত।

আমার কোনও ইচ্ছাই নেই। তবে আগ্নেয় হয়ত চাইবে। সৌজন্যবোধ। এর বেশী কিছু নয়।

ওরা কম্পানির স্টলে ঢুকে যায়। ঝলমলে স্টল। গিজগিজে ভীড়। ভীড়ের মধ্যেই হারিয়ে যায় ওরা।

অনির্বেদ কিছুক্ষণ চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। পাশেই একটা টেবিল। তার ওপর অতলান্তের বইয়ের অনেকগুলো কপি পরপর সাজানো। হঠাত দেখতে পায় সামনেই অতলান্ত। পাশে একটি সুন্দরী মেয়ে। একটা বই তুলে অটোগ্রাফ দিতে ব্যস্ত অতলান্ত। তারপর সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দেয়। মেয়েটি খুলেও দেখে না। শুধু থ্যাঙ্কস বলে বইটি ব্যাগে ঢুকিয়ে ঝলমল করতে করতে বেরিয়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত তার পিছনটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখে অতলান্ত।

অনির্বেদের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। তবু ফিসফিস করে বলে, অতলান্ত, আমি কি থাকব?

জিজ্ঞেস করে দেখি। কথাটা ছুড়ে দিয়েই আবার ভীড়ে মিশে যায় অতলান্ত।

অতলান্তের কৃপা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার স্পর্ধা নেই অনির্বেদের। সে তাই ঠায় দাঁড়িয়েই থাকে। যদিও সে লক্ষ করে, অতলান্ত আবার ওর উপস্থিতি মন থেকে মুছে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করার কথা বলল বটে, কিন্তু সে ব্যাপারে কোনও উদ্যোগই নিচ্ছে না। কোনও ইচ্ছাই নেই ওর। অতলান্তর হাতে এখন হুইস্কির গ্লাস। একটার পর একটা গ্লাস সাবাড় করে দিচ্ছে সে। আর হাতে কখনও মটন কাটলেট, কখনও প্রন কাটলেট নিয়ে বড় বড় কামড় বসাচ্ছে।

সামান্য একটা বই, তার জন্য এত তাচ্ছিল্য সহ্য হচ্ছিল না অনির্বেদের। একবার বিহানের চোখে চোখ পড়ে গেল। কেমন তাচ্ছিল্য নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সারা শরীর যেন জ্বলে গেল অনির্বেদের। বিহানের কাছে গিয়ে একবার ফিসফিস করে বলল, অতলান্ত তো চা পর্যন্ত খেত না, শুধু জল। কখনও একটা আলুর চপ মুখে তুলতে দেখনি। শুধু মুড়ি। ও অসুস্থ না?

ফুঃ, হেসে উড়িয়ে দেয় বিহান, মদ ছাড়া এখন ওর চলে না। আর শুধু মদও ওর পছন্দ নয়...

একদম তাজ্জব বনে গেল অনির্বেদ। এ কোন অতলান্ত? কোনটা আসল আর কোনটা নকল? যাকে ওরা চিনত না, না কি যাকে এখন চিনছে? অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করল সে। পারল না। অতলান্তকেই খুঁজতে লাগল ওর চোখ। কিন্তু কোথায় অতলান্ত? ভীড়ের মধ্যে অতলান্ত আর বিহানকে কোথাও খুঁজে পেল না অনির্বেদ। কিন্তু এও কি সম্ভব? এইভাবে ওকে ফাঁকি দিয়ে ওরা পালিয়ে যেতে পারে? অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল অনির্বেদের।

কিন্তু ওরা সত্যিই পালিয়ে গেছে। ওদের কোথাও খুঁজে পেল না অনির্বেদ। বাকিটা ও শুনেছিল শ্রমণের কাছে। একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিল শ্রমণ। কিছুটা অন্যমনস্কভাবেই একটা সিগারেট খাচ্ছিল। হঠাৎ দেখতে পেল, একটা বড় টাটা সুমো গাড়ি ওর সামনেই ঘোরানো হচ্ছে। গাড়িটার মাঝখানের সিটে বসে আছে অতলান্ত আর বিহান। ওদের দেখে শ্রমণ কয়েক-পা এগিয়েও গেল। কিন্তু ওরা এমন একটা ভান করল, যেন ও নেহাতই একটা উটকো লোক। গাড়িটা ততক্ষণে ঘোরানো হয়ে গেছে। একটু পরে সেটা মিলিয়েও গেল অন্ধকারে। কেউ শ্রমণকে ডাকল না। ওকে দেখে এক সেকেণ্ডের জন্যও থামল না। হতবাক শ্রমণ এমনভাবে দাঁড়িয়ে রইল, যেন কেউ তার পায়ে পেরেক গেঁথে দিয়েছে।

অনির্বেদ ফিরে এলে শ্রমণ শুধু বলেছিল, কয়েকদিন আগেও তো ওদের সঙ্গে কোলাকুলি করেছি। হঠাত ওরা এতদূরে চলে গেছে? জীবন কি এইরকমই?

অনির্বেদ কোনও উত্তর দেয় নি। কিন্তু গোপনে অতলান্তের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গেছে। একদিন প্রাইভেট সেক্রেটারির বাড়িতে একটা অভিজ্ঞতা হল ওর। এখন ওদের কম্পানির হয়ে কিছু কিছু কাজ অনির্বেদও করে। অতলান্তই ওকে ডেকে নেয়। সেদিনও ডেকে নিয়েছিল। সকালবেলা উঠেই চলে গিয়েছিল অনির্বেদ। অতলান্ত ওকে কাজটা বুঝিয়ে দিয়েছিল। প্রচুর ফুল এসেছে বিদেশ থেকে। তাদের একটা তালিকা তৈরি করতে হবে। খুবই বিরক্তিকর কাজ। কম্পানির অফিস। পাঁচতলার একটি ছোট্ট ঘরে বসে কাজটি করছিল অনির্বেদ। কাচের জানালা দিয়ে ও দেখল, প্রাইভেট সেক্রেটারি আর অতলান্ত বসে বসে আড্ডা মারছে। ওদের সামনে হুইস্কির বোতল রাখা আছে। অনির্বেদকে এক কাপ চাও কেউ দেয়নি। গলাটা ওর শুকিয়ে গেছিল। তাছাড়া সামান্য একটু মুড়ি ছাড়া আর কিছুই সকাল থেকে ওর পেটে পড়েনি। খিদেও পেয়েছিল খুব।

হঠাৎ ওর মাথায় একটা খেয়াল চাপল। সোজা গিয়ে প্রাইভেট সেক্রেটারিকে বলল, আচ্ছা অতলান্ত কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবে? কাজটা তাহলে তাড়াতাড়ি হয়।

খুব সরলভাবেই প্রস্তাবটা দিয়েছিল অনির্বেদ। ফুলের বাগানে ওরা দুজনে মিলে কত কাজই তো একসঙ্গে করেছে। দুজনেই হাতের কাজে দক্ষ। মুক্তোর মতো হাতের লেখা। সুন্দর করে কিছু লিখতে বা আঁকতে হলে হৃদয় সব সময়ে ওদের দুজনকে সেই কাজের দায়িত্ব দিত। আর ওরা দুজনও পাশাপাশি বসে সানন্দে সেই কাজ করতে বসে যেত। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কত মিষ্টি মধুর কথা হত দুজনের। গান বা কবিতার লাইন বিনিময় হত। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও হত কখনও কখনও। মনে তখন কী আনন্দই না ছিল! কথায় কথায় দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরত।

সে সব কথাই মনে পড়ছিল অনির্বেদের। ছবির মতো ভাসছিল দৃশ্যগুলি। কিন্তু প্রস্তাবটা দিয়েই ও বুঝতে পারল, সাংঘাতিক একটা ভুল করে বসেছে। অতলান্তের মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। আর প্রাইভেট সেক্রেটারি বেগতিক দেখে সঙ্গে সঙ্গে সামলে দিতে বলে উঠেছিল, না না ও যেতে পারবে না। অতলান্তের এখন অন্য কাজ আছে।

ভাঙা মন নিয়ে অনির্বেদ ফিরে এসেছিল। খুব কান্না পাচ্ছিল ওর। কিন্তু দেরি করলে চলবে না। ও আবার কাজে মন দিয়েছিল। অতলান্ত নিজের জায়গা ছেড়ে একচুলও নড়েনি। ওরা দুজনে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে গল্প করেছে। অনির্বেদ বুঝতে পারল, ওর কথা ভেবেই এই কাজ বরাদ্দ করা হয়েছে। ওকে এই কাজের উপযুক্ত মনে করা হয়েছে। অতলান্ত এখন অনেক উঁচু ডালে উঠে গেছে। এসব মামুলি কাজ ওর জন্য নয়। সেটাই ওরা দুজনে বুঝিয়ে দিল। ওর প্রস্তাব শুনে সেই কারণেই প্রাইভেট সেক্রেটারি শিউরে উঠেছিল। অনির্বেদকে দিয়ে যে কাজ অনায়াসে করিয়ে নেওয়া যায়, অতলান্তকে সেই কাজ দেওয়ার কথা ভাবাই যায় না। পরিস্থিতি এই জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারাক্রান্ত মনেই সেদিন ফিরে এসেছিল অনির্বেদ।

(ক্রমশঃ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন