কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

সাইদুর রহমান

 

সমকালীন ছোটগল্প


স্পর্শের বাইরে

রাত প্রায় দশটা। টেলিফোনটা বেজে উঠল। অলসভাবে রিসিভারের দিকে এগিয়ে গেল আকাশ। অফিসটা আকাশের শোবার ঘর, শোবার ঘরটায় অফিস। আলতোভাবে রিসিভারটা হাতে তুলে কানের কাছে নিয়ে এল আকাশ, “হ্যালো। আকাশ বলছি।”

“চিনতে পারছেন?”

ওপার থেকে একটি মসৃণ কন্ঠ ভেসে এলো আকাশের কানে। এই কণ্ঠস্বর আকাশের চেনা। কিন্তু, তার তো এত রাতে ফোন করার কথা নয়। এমনিতেই সারাদিন অফিসের খাটুনি। সমস্ত শরীর-মন একটা অলসতায় ভরে আছে আকাশের। রিসিভার  তুলতেই ইচ্ছে করছিলোনা তার।  কিন্তু এতো তার ফোন।

রিসিভারটা কানের কাছে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো আকাশ, “চিনতে না পারলে খুশি হতে বুঝি?”

খুব ধীরে ধীরে কথাগুলি বলল সে।
ওপার থেকে আবার সেই মসৃণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “আমার খুশি অখুশিতে আপনার কিছু যায় আসে না কি?”
এ কথার কি উত্তর হতে পারে আকাশ ভেবে পেল না, “কার কিসে যায় আসে, তা তার একান্ত নিজের ব্যাপার নয় কি?” কথাগুলি যেন বাতাসে আলতোভাবে ছড়িয়ে দিল আকাশ।
“কথাটা খাঁটি বটে। সত্য নয়।” ওপার থেকে উত্তর ভেসে এল আকশের কানে।
“কেন?” রিসিভারটা আরও কানের কাছে চেপে ধরল সে।
“মানুষের স্বাধীন চিন্তা চেতনায় আমিও বিশ্বাস করি। কিসে তার ভালো লাগবে কিসে লাগবে না, কি করবে আর কি করবে না, কিসে তার রুচি আর কিসে তার রুচি নেই - তা তো তার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু এই জগতের বাইরে তো আরেকটা জগৎ আছে। আপনি সেই জগতেরও একজন। সেখানে আপনি কেবল আর আপনি নন, সেখানে আপনি আরও পাঁচজনের। সেখানে আপনার যাওয়া-আসার উপরে আরও অনেকের
  কিছু যাওয়া-আসা নির্ভর করে।” কথাগুলি যেন বহুদূর সমুদ্রের উপর থেকে ভেসে এল আকাশের কানে।

আকাশ বলল, “মানি। কিন্তু আরো পাঁচজনের মধ্যে থেকেও তো কেউ আলাদা থাকতে পারে।”
আপনার সাথে কথা বলে মনে হচ্ছে আমি কোনও বিচ্ছিন্ন দ্বীপের লোকের সাথে কথা বলছি।” উত্তর ভেসে এলো আকাশের কানে।

একটু চুপ করে থাকল আকাশ। তারপর বলল, “একই জগতে বাস করলেও প্রতিটি মানুষই তো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতোই। ব্যস্ততার নির্জনতাই যেখানে সে একা, সেখানে সে তো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতোই বাস করে।”

কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। তারপর আবার ওপার থেকে উত্তর ভেসে এলো, “জানি। আমি এ ও জানি মানুষের জীবনটা একটা সীমাবদ্ধ পুকুর।  কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতার মাঝেও যখন সমুদ্রের অসীমতা এসে আঘাত করে জীবনটাকে অসীমের মাঝে নিয়ে এসে দাঁড় করায়, তখন তার গতিকে যে রোধ করা যায়না আকাশ। তখন সেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপও যে অসীম  সমুদ্রের তীব্র আহ্বানে নিজেকে আর আলাদা করে রাখতে পারেনা।”

চমকে উঠলো আকাশ। এভাবে নাম ধরে সে তো এর আগে একদিনও ডাকেনি।

আকাশ দেখল ওপার থেকে কেবল নিঃশ্বাসের একটা মৃদু শব্দ আকাশের কান ছুয়ে যাচ্ছে। কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিল না আকাশ। বেলা আজ এত কথা বলছে কেন?
হঠাৎ সে অজান্তেই ডেকে উঠল, “বেলা!”
আকাশ দেখল বেলাকে ডাকতে গিয়ে তার নিজের গলাটাও কেমন যেন কেঁপে উঠল।
ওপার থেকে উত্তর এল, “বলুন।”
আকাশ বলল, “তুমি আজ এত কথা বলছ কেন বেলা! এর আগে তো তুমি এতো কথা বলনি?”
“এর আগেও বলেছি আকাশ। হয় তুমি ইচ্ছে করে শোন নি, কিংবা শুনেও না শোনার ভান করে এড়িয়ে গেছো।” ওপার থেকে বেলার স্পষ্ট উত্তর ভেসে এল।
স্পষ্টতার আর যেন কোনও আড়াল নেই। ভয় হল আকাশের। আজ কী বলতে চাইছে বেলা!

আকাশ ভাবতে পারছিল না সে কি বলবে বেলাকে। সেকি বেলার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে? তাহলে এতদিনের সংযম, আত্মকেন্দ্রিকতার বাঁধ কি মুহূর্তে ভেঙে পড়বে না? আকাশ ভাবলো যে করে হোক কথার মোড় ঘোরাতে হবে।
আকাশ বলল, “ভুল বললে বেলা। প্রতি মুহূর্তে তোমার খবর রেখেছি। কিন্তু যাক সে কথা। তোমার
 নতুন সংসার জীবন কেমন কাটছে? তোমার স্বামী কেমন আছেন?”
বেলার উত্তর এল, “আমার স্বামী আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন।”
 
আকাশ বলল, “আর তুমি তোমার স্বামীকে ভালোবাসো না?”
উত্তর এল বেলার, “আমার স্বামী ভীষণ ভালো মানুষ। তাকে আমি শ্রদ্ধা করি।”
“তারমানে তুমি তোমার স্বামীকে ভালোবাসো না।” আকাশ বলল।
বেলার উত্তর এল, “বলছি তো আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি তাকে। তার সাথে আমি সারা জীবন সংসার করব। কারণ আমি তাকে
  বিয়ে করেছি। আমার কাছে ‘বিবাহ’ আর ‘ভালোবাসা’ দুটোর সংজ্ঞা আলাদা।”
“তারমানে?” টেলিফোনের রিসিভারটা আরও জোরে চেপে ধরল আকাশ।

“যাকে দেখে আমার প্রথম ভালোবাসার স্পন্দন জেগেছিল, আমার ভালোবাসার সমস্ত অর্ঘ্য আমি যে তারই পদতলে অর্পণ করে রেখেছি আকাশ। সে আজ তিন বছর আগের কথা। সেই অর্ঘ্য আমি আরেকজনকে কি করে দিতে পারি বল? বিয়ে করে আমি একটি বন্ধনে জড়িয়ে গেছি, কিন্তু সেই ভালোবাসাটুকু তো আমার মুক্তির আকাশ, আকাশ! সে জায়গাটিতে আমি যে কোন বন্ধনের প্রাচীর তৈরি করতে চাই না।”

বেলার কথা গুলো আকাশের কানে এক অদ্ভুত অনুরণন তুলতে তুলতে প্রবেশ করছিল।
অজানা আশঙ্কায় আকাশের বুকটা কেঁপে উঠলো। বেলা কাকে ভালোবাসে? যাকে নিয়ে সে নিজে একটি নীরব স্বপ্নের জগৎ তৈরি করেছে, সে জগৎ কি আজ ভেঙ্গে যাবে? যতক্ষণ অস্পষ্টতা, ততক্ষণ একটা অদ্ভুত স্বপ্ন সুখ। স্পষ্টতার মাঝে অসীম প্রশান্তি।
 আকাশের মনে হলো একবার সে জিজ্ঞাসা করে কাকে সে ভালোবাসে। আবার মনে হলো, না, থাক। যদি সে অন্য কাওকে ভালোবাসে। তা তাছাড়া একমাস হয়ে গেল তার বিয়ে হয়ে গেছে। নাইবা জানলাম তার মনের কথা।

কথা ঘোরানোর জন্য আকাশ বলল, “কিন্তু যাকে নিয়ে তুমি সংসার করবে, তাকে যদি তুমি নাই ভালোবাসতে পারো তা কি অন্যায় নয়? এ কত বড় ফাঁকি তা কি তুমি বুঝতে পারছ না বেলা!”
“প্রশ্নটা ন্যায়-অন্যায় নিয়ে নয় আকাশ বাবু। প্রশ্নটা হল জীবন নিয়ে। মানুষ বিয়ে করে একটা বন্ধনকে মেনে নেয়, কারন সে বন্ধনের মধ্যে থাকতে চায়। আমিও তার বাইরে নই। ভালোবাসা, সে যে আমার কাছে মুক্তি! তোমাকে কি করে বোঝাবো আকাশ, স্বামীকে আমি একটুও ফাঁকি দিতে চাই না। কিন্তু আমি যাকে ভালোবাসি...।”

কথা শেষ হলো না। আকাশ বুঝতে পারল ওপারে বেলার কন্ঠ ভেঙে পড়েছে।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না আকাশ। সে জিজ্ঞাসা করল, “একটা কথা জিজ্ঞেস করব বেলা?”
উত্তর এল বেলার, “বলুন, উত্তর জানা থাকলে নিশ্চয়ই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।”

আকাশ খুব শান্ত ভাবে জানতে চাইল, “ভালোবাসার লোকটি কে জানতে পারি?”

উত্তর আসতে একটুও সময় লাগলো না, “এতক্ষণ ধরে যার সাথে কথা বলছি সে। আপনি।”
                                .........

ধর্মতলার মোড়। এসপ্ল্যানেড মেট্রো রেল স্টেশনে থেকে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল আকাশ। সবে রাত্রি আটটা। সামনে বাসস্ট্যান্ডে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে দূরপাল্লার সব বাস।

সামনের বাসটার জানলা থেকে একটি ছেলে ডেকে উঠল, “স্যার।”

আকাশ তাকিয়ে দেখল সামনে উত্তরবঙ্গ পরিবহনের একটি বাস দাঁড়িয়ে। ছেলেটিকে চিনতে পারল আকাশ। হাওড়া শিশু বিকাশের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফিরছে। সেখানে চাকরি করে আকাশ।
বাসটার দিকে এগিয়ে গেল আকাশ, “বাড়ি যাচ্ছো নাকি আরিফ? সাথে কে আছেন?”  
আরিফ বলল, “হ্যাঁ স্যার। বাড়ি যাচ্ছি। বাবা আর দিদি আছে। আপনি ভালো আছেন তো স্যার?”
“হ্যাঁ ভালো আছি। তুমি ভালো আছো তো?”
কথা বলতে বলতে আকাশ বাসের উপর উঠে গিয়েছিল। বাস ছাড়তে তখনও মিনিট বিশেক দেরি। কয়েকজন যাত্রী তাদের সিটে বসে আছেন। আরিফের পাশের সিটে একজন মেয়ে বসে আছে। বয়স উনিশ কুড়ি
 হবে।  পরনে নীল রংয়ের চুড়িদার। পেছনে খোলা চুলের প্রান্তসীমা কোমর পর্যন্ত চলে গেছে। লাবণ্য মাখা মুখমন্ডলে কেমন একটা প্রশান্তির স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে মেয়েটির। তাকাতে গিয়ে তাকাতে পারলো না আকাশ। কেমন যেন একটা লজ্জার শীতলতা তার চোখকে অন্যদিকে সরিয়ে দিল।
আরিফ মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “দিদি, আমার স্যার।”
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “সালাম”। আমার নাম সুমিতা কামাল। ডাকনাম বেলা।”

আকাশ বলল, “কোন ক্লাসে পড়ো?”
“ফার্স্ট ইয়ার, বাংলা।”

মেয়েটির প্রতিটি কথার মধ্যে একটা স্পষ্টতা ও বুদ্ধির ছাপ লক্ষ্য করছিল আকাশ।
কি একটা বলতে যাচ্ছিল আকাশ। আরিফ বলল, “প্লিজ, আপনি সিটে বসুন স্যার। আমি আব্বাকে ডেকে নিয়ে আসি।”
পাশের একটি চায়ের স্টলে বসে ছিলেন আরিফের বাবা। আরিফ নেমে গেলে বেলা জানলার দিকে সরে গিয়ে পাসের সিটে বসতে বলল।
ইতস্তত করছিল আকাশ। পাশে বসে বেলার দিকে তাকাল সে, “আমার নাম...”
“আমি জানি। সুমিত। ডাক নাম আকাশ।”
আশ্চর্য হয়েছিল আকাশ, “তুমি আমার নাম জানলে কি করে?”
“আরিফের কাছে আপনার নাম অনেকবার শুনেছি।”
হাসল আকাশ, “বা! নাম তো আগেই জেনে গেছো।”
বেলাও মৃদু হেসে বলল, “আপনার সম্বন্ধে আরও একটি খবর জানি।”
“আরও খবর! কী বলতো শুনি।”

“কয়েকদিনের মধ্যেই আপনি অন্য চাকরি নিয়ে উত্তরবঙ্গে যাচ্ছেন।”

কথা আর বেশি এগোয়নি। আরিফের বাবা এসে পড়েছিল।

এভাবে সেদিন ধর্মতলার মোড়ে বেলার সাথে আকস্মিকভাবে পরিচয় হয়েছিল আকাশের। এবং এই গোপন ভালোলাগা তৈরী হয়ে গিয়েছিল তার। এই গোপন ভালোলাগা ছিল আকাশের একান্ত গোপন, নিজস্ব ও ব্যক্তিগত। বেলাকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখত, গান লিখত, কবিতা বানাত। সে যখন একা একা চলত, বেলা যেন তার পাশে থাকতো। যখন সে চুপচাপ বসে থাকতো, বেলা এসে চুপিচুপি কানে কানে গান শুনিয়ে যেতো। এভাবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বেলার অশরীরী উপস্থিতি অনুভব করতো আকাশ।
মাস আট-নয় হয়ে গেছে। উত্তরবঙ্গে কাজে যোগ দিয়েছে আকাশ।
 মালদহের উপর দিয়ে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করা হয়ে গেছে তার। কিন্তু বেলাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। আকাশ ইচ্ছে করে করেনি। যদিও বেলা সেদিন তাকে তাদের বাড়ির ফোন নম্বর দিয়েছিল।  নিজের তৈরি করা জগতকে কোনমতে ভাঙতে চাই নি সে।
ঘটনাটা ঘটল অদ্ভুতভাবে। বেলাদের বাড়িতে আকাশ ফোন করতে চায়নি। সেদিন মালদার একজনকে ফোন করেছিল আকাশ। অফিসের কাজে মাঝে মধ্যেই তাকে ফোন করতে হয়। কিন্ত সেদিন
 ফোনটি ঢুকে গিয়েছিল বেলাদের বাড়ি। রিং হতেই ওপার থেকে একটা মেয়ের মসৃণ কন্ঠ ভেসে এসেছিল, “হ্যালো।”
আকাশ বলেছিল, “অমিতদা আছেন?”
রং নম্বর।”

“রং নম্বর! কিন্তু এর আগে এই নম্বরে তো ফোন করেছি।”

“আপনি কে বলছেন?”

“আমার নাম সুমিত। অমিত চৌধুরীকে চাইছিলাম। আপনি কে?”
একটু সময় নিয়ে মেয়েটি বলেছিল, “সত্যি কি আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না আকাশবাবু?”
“সত্যি কথা বলতে কি। প্রথম কণ্ঠস্বরেই তোমাকে আমি চিনে ফেলেছিলাম। সাহস হচ্ছিল না।” হঠাৎ দ্রুত কথাগুলো বলে ফেলেছিল আকাশ।
“সাহস কি পাওয়া যায় আকাশবাবু! সাহস সঞ্চয় করতে হয়!” বেলা বলেছিল।

উত্তর দিতে সময় নেয়নি আকাশ, “সাহস সঞ্চয়ের একটি অধিকার থাকা চাই বেলা। জোর করে তো অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় না।”
বেলা বলেছিল, “যেখানে অধিকার খুব সহজেই অর্জন করা যায় সেখানে জোরের প্রসঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক নয় কি? কিন্তু যাক সে কথা। আপনি তো অনেকদিন হলো উত্তর বঙ্গে চলে এসেছেন। কবে আসছেন আমাদের বাড়ি।”

“সামনের মাসেই তো অফিসের কাজে মালদহ যেতে হচ্ছে। সময় পেলে অবশ্যই যাব।” আকাশ বলেছিল।

এইভাবে ফোনে ক্রশ কানেকশন হয়ে আবার বেলার সাথে যোগাযোগ গড়ে উঠে আকাশের।

মাসখানেক পরে অফিসের কাজে মালদহে গিয়ে বেলাদের বাড়ি গিয়েছিল আকাশ। মাত্র কুড়ি পঁচিশ মিনিট ছিল সে। সেদিন বেলা পড়েছিল গোলাপি রঙের তাঁতের শাড়ি। সদ্য স্নান করা ভেজা চুল খোলা পিঠের মাঝ বেয়ে কোমরের নিচ পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। লাবণ্য মাখা মুখমন্ডলে কেমন একটা হালকা হাসি লেগেছিল সর্বক্ষণ। একটা হালকা পারফিউমের মিস্টি সুবাস আকাশকে পাগল করে তুলেছিল। বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি আকাশ। যতক্ষণ ছিল, একটা অদ্ভুত আনন্দে মন ভরে উঠেছিল আকাশের। আকাশের বার বার মনে হচ্ছিল, “এখানেই যদি থাকতে পারতাম। বেলার সাথে কথা বলতে বলতে সারা রাত কাটিয়ে দিতে পারতাম।”

সেদিন আকাশ তার গোপন কথা ভালবাসার কথা বলতে গিয়েও বলতে পারেনি।

এরপর আরও প্রায় বছর খানেক গড়িয়ে গেছে। এরমধ্যে আকাশ বেলাদের বাড়ি দু’একবার গিয়েছে। মাঝে মধ্যেই ফোন করেছে আকাশ। বেলাও তাঁকে ফোন করেছে অনেকবার।

একসময় আকাশের গোপনসঙ্গী হয়ে উঠেছিল বেলা। বেলার গোপন প্রেম আকাশকে দিল চলার শক্তি। এগিয়ে যাবার মন্ত্র। আকাশ যেন এখনই লাফিয়ে আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে। রাতের পর রাত জেগে ডায়েরির পাতা ভরিয়ে দিল সে।

আকাশ লিখল, ‘জীবনের এক চরম মুহূর্তে তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিল বেলা। তোমাকে ভালোবাসি। সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালোবাসি। সমস্ত আত্মা দিয়ে ভালোবাসি। আমার চলার পথটায় তৈরী হয়ে গেছে তোমাকে কেন্দ্র করে। প্রতিদিন কাজের চাপে, এক ঘেঁয়েমির ক্লান্তিময়তায় যখন শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ে, অলসতায় যখন কেউ পায়ে দড়ি বেঁধে দেয় তখন আমি তোমাকে আঁকড়ে ধরি। আর তুমি যেন বহুদূর সমুদ্রের পার থেকে একটা শীতল হাওয়ার সুকোমল স্নিগ্ধতায় আমাকে আদর করে দিয়ে যাও বার বার। একটা অনাবিল বিষন্নতা যখন মাঝে মাঝে গ্রাস করতে থাকে – ঠিক তখনই সকালের এক পশলা বৃস্টির মতো আমার জীবনে এসে পড় এবং এক নির্মল প্রশান্তির স্নিগ্ধতায় আমাকে শীতল করে দিয়ে যাও। তুমি বিশ্বাস কর বেলা, যেদি তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়, সেদিনই তোমার মধ্যে আমি আমাকে খুঁজে পেয়েছিলাম। সকালের ঝরা শিউলির সুবাসে পরিস্নাত এক ঝলক মন পাগল করা হাওয়া যে সেদিনই আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছিল। যেদিন প্রথম তোমার হাতের স্পর্শ পেয়েছিলাম, যেদিন প্রথম তোমার পাশে বসে নারীর ঘ্রাণ অনুভব করেছিলাম, সেদিনই আমার সমস্ত দেহ-মনে এক নতুন পুলক জেগে উঠেছিল। সেদিনই সমস্ত আকাশ বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, নদ নদী – সবাইকে ডেকে চিৎকার করে আমার ভালোবাসার প্রথম সুর শুনিয়েছিলাম। তুমি জাননা বেলা – তোমাকে পাওয়া আমার জীবনের কতবড়ো আবিষ্কার।’

বেলা এখন থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। আকাশ ভাবল বেলার পরীক্ষা হয়ে গেলে তাঁকে তাঁর ভালবাসার কথা জানাবে।

সেদিন ছিল শনিবার। সারারাত ধরে প্রকৃতি তার অশ্রুসজল ধারায় ঝরে চলেছে। উত্তরবঙ্গে এই রকম বৃষ্টি এর আগে সে দেখেনি। সকাল প্রায় আট টা। তবুও বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণ নেই। কোনও বাধা নেই, বন্ধনও নেই । প্রকৃতির এই কান্না যেন থামবেনা। আকাশের মনেও আজ একটি নীরব বিষন্নতা সকাল থেকে উঁকি ঝুকি মারছিল। এবারে বেলাকে জানিয়ে দিতে হবে তাঁর মনের কথা।

ঠিক এই সময়েই আকাশের মোবাইল বেজে উঠল। আকাশ দেখল বেলাদের বাড়ির নম্বর। লাফিয়ে উঠল আকাশ, “হ্যালো বেলা!”

“আমি বেলার আব্বা বলছি। ভাল আছ তো?” ওপ্রান্ত থেকে উত্তর এল।

নিজের চঞ্চলতায় খুব লজ্জা পেল আকাশ। বলল, “হ্যাঁ ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?”

“আমিও ভাল আছি। কিন্তু আগামীকাল যে তোমাকে আমাদের বাড়ি আসতে হবে বাবা।”

আপনাদের বাড়ি! সে তো ভাল কথা। কিন্তু হঠাৎ! কোনও উপলক্ষ্য আছে নাকি!” ‘ব্যাপারটা একেবারে আকস্মিক ঘটে গেল বলতে পার। আসলে ওদেরও পছন্দ হয়ে গেল। আমিও দেখলাম পাত্র মন্দ হবেনা। তাই রাজী হয়ে গেলাম।”

কি একটা অজানা আশংকায় আকাশের বুকটা হঠাৎ চিন চিন করে উঠল। মুখে বলল, “আপনার কথা বুঝতে পারছিনা কাকাবাবু! কিসে রাজী হয়ে গেলেন?”

বেলার বাবা ওপার থেকে উত্তর দিল, “আগামীকাল যে বেলার বিয়ে।”

সহসা আকাশের গালে কে যেন খুব জোরে চড় কষাল। আকাশ দেখল ধীরে ধীরে তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে সরে যাচ্ছে। পৃথিবীর গতি যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরা থেকে রক্ত মাথার উপর উঠে আসছে। কি করবে, কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলনা আকাশ। কোনরকমে সে ধীরে ধীরে বলেছিল, “আমি যাওয়ার চেষ্টা করব কাকাবাবু।”

রাত বারোটা কি একটা হবে। ঘুম আসছিলনা আকশের। জীবনের সবচেয়ে দামী বস্তুটিকে কে যেন চুরি করে নিয়ে গেছে। আজ বিকেলের দিকে বেলার ফোন এসেছিল। মোবাইলে নম্বর ভেসে উঠতেই আকাশ নিজে থেকেই ফোন কেটে দিয়েছিল।

চেয়ারটা টেনে নিয়ে টেবিলে মুখ গুঁজে দিয়ে বসল আকাশ। ভাল লাগছেনা। কখন কোন অজান্তে চোখের পাতা ভেদ করে অশ্রু গড়িয়ে টেবিল ভিজিয়ে দিয়েছিল আকাশ বুঝতে পারেনি। উঠে দাঁড়াল সে। বিকেলের দিকেই বৃষ্টি ছুটে গিয়েছিল। আকাশ এখন সম্পূর্ণ পরিস্কার। ঘর থেকে বেরিয়ে এল আকাশ। ঘরের দরজার পাশ বেয়েই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ইউক্যালিপ্টাস। তারপরেই খেলার মাঠ। মাঠের পরেই সোজা দক্ষিণ –পূর্ব সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেছে খাঁ খাঁ মাঠ। চাঁদের আলো আজ যেন সোজা মাটিতে। এত আলো এর আগে চোখে দেখেনি আকাশ। হাঁটতে হাঁটতে একটা ইউক্যালিপ্টাস গাছের নীচে দাঁড়াল সে। কি একটা পাখি গাছের ডাল থেকে সোজা উত্তর দিকে যেতে চেয়েও পূর্ব দিকে উড়ে গেল। ভাল লাগল না আকাশের। হাঁটতে হাঁটতে সে মাঠের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল আকাশ। দেখল চাঁদের শরীর থেকে হাজার হাজার আলোকণা যেন সিঁড়ি বেয়ে একটা একটা করে পৃথিবীর বুকে নেমে আসছে। চাঁদের পাশে আরও লক্ষ কোটি তারার দল ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা, আজ আকশে এত তারা কেন? লক্ষ – কোটি বছর আগে যে সমস্ত তারা নক্ষত্রের দল মরে গিয়েছিল আকাশের বুকে – তারাও কি আজ জেগে উঠেছে! ওরা কি আকাশকে ডাকছে? কিছু কি বলছে ওরা! ওরা তো লক্ষ কোটি যোজন দূরে এক দূর্বোধ্যতার আড়ালে নিজেদের আলাদা করে রেখেছে। বেলা কি ওদের মতোই আজ নিজেকে লক্ষ কোটি যোজন দূরে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে দুর্বোধ্যতার প্রাচীর তুলে দিল। সে দেখতে পেল আকাশের এক কোণে একটি তারার পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেলা। হালকা হাসির হাতছানিতে তাকে ইশারা করছে। ওকে দেখে আকাশ বলল, “বেলা তোমাকে কি আমি ভালোবাসিনি? আমার সমস্ত পুস্পাঞ্জলি কি তোমার চরণে অর্পণ করিনি? পথের ধারে যে চারা গাছটি ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠছিল, তাতে তুমি আমি কি একই সাথে জল দিইনি বেলা? হয়তো জলটা আমি একাই দিয়েছিলাম। তুমি শুধু নীরবে দূর থেকে দেখছিলে। কিন্তু, সেই নীরবতা কি মৌন সমর্থন নয়!”

কখন কোন সন্তর্পণে চাঁদ পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ল আকাশ বুঝতে পারলনা। কখন দুটো শেয়াল গুটি গুটি পায়ে তাকে কাছে থেকে দেখে গেল আকাশ বুঝতে পারল না। পাশের ছাতিম গাছ থেকে কয়েকটি নিশাচর পাখি চুপি চুপি আকাশকে ঘরে যেতে বলে গেল আকাশ বুঝতে পারলা না। সহসা একটা শীতল দমকা হাওয়া আকাশকে সামনে থেকে ধাক্কা দিয়ে সোজা পূর্ব দিকে দৌড়ে গেল এবং একটি শেষ হতে না হতেই আরেকটি। আকাশ দেখল চাঁদ তার দিকে চেয়ে আজকের মতো বিদায় চাইছে। আকাশের বুক থেকেও তারাদের প্রস্থান শুরু হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে ঘরে ফিরে এল আকাশ। দূরের কোন এক মসজিদ থেকে ভোরের আজান ভেসে আসছিল তখন।

.........

যে মুহূর্তে আকাশ শুনল বেলা তাকে ভালবাসে - তার এতদিনের বাঁধ যেন ভেঙে গেল। দিগন্ত – প্লাবিত আকাশের বুক থেকে ধেয়ে আসা অসংখ্য আলোর শিখা যেন তার হৃদয় আলোকিত করে গেল। আকাশ দেখল জীবনের দূর্দান্ত মত্ততায় সমুদ্র আছড়ে পড়ছে উপকূলে। পাড় ভাঙছে – ভাঙছে এবং ভাঙছে। শত সহস্র শ্বেতপুঞ্জ ফেনা শত সহস্র শাখায় ফুলে উঠে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।

কি এক অশান্ত আবেগে ডেকে উঠল আকাশ, “বেলা!”

ওপার থেকে বেলার কন্ঠস্বর ভেসে এল, “মাফ করবেন আকাশবাবু। আমি আজও জানি না আপনি আমাকে ভালবাসেন কিনা। আমি শুধু আমার কথাটুকু বলেছি মাত্র!”

আকাশ বলল, “আমার ভালোবাসার কথা নাইবা জানলে বেলা। শুধু এটুকে জেনে রেখ, জীবনের প্রথম প্রত্যুষে ভালোবাসার যে গোলাপটি ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছিল – তা মাঝ পথেই শুকিয়ে গেছে। আমি কবিতা লিখেছি, ছবি এঁকেছি, স্বপ্ন দেখেছি তাকে নিয়ে। গুনগুনিয়ে উঠেছি তাকে নিয়ে। আমি জানতামইনা সে গুনগুনানির সুরে সুর দেওয়ার সুযোগ আমার হবেনা। তোমার ভালোবাসার কথা আজ বলছ। হয়তো না বলা কথার অব্যক্ত বেদনা তোমাকে এতদুর টেনে এনেছে। কিন্তু যাক সে কথা। তুমি তোমার নতুন জীবনকে বুকে আঁকড়ে থাক। আমি আমার স্বপ্নের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসি। তবে একটা কথা মনে রেখ বেলা। আজ আমাকে তোমার ভালোবাসার কথা না জানালেই ভাল করতে। যে আগুনটি নিভে গিয়ে কেবল ধোঁয়া উঠছিল – তা যে আবার সহস্র শিখায় জ্বলে উঠবে তা কে জানত! জানি না সে আগুন নেভানোর জন্য আরও কতটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। ভাল থেকো!”

রিসিভার নামিয়ে রাখল আকাশ। সে দেখল এখান থেকে মালদহের রাস্তা অনেক দূর। ইচ্ছে থাকলেও যাওয়া যাবে না। 

 

 

 




 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন