কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

সুপর্ণা ভট্টাচার্য

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২৩


অনল

'আবার জলে  ডুবে বসে আছিস!'

'গা টা জ্বলে যায় যে'

'জলে ডুবালেই গা জ্বলুনি কমে যাবে'

'কমে না তো'

'ওই মন গড়া জ্বলুনি কমবেও না'

'মনগড়া কে বললে তোমাকে'

'কে আবার বলবে। মাথাটা এবার পুরোপুরি যাবে তোর'

পুকুরঘাটে আপাতত কেউ নেই। পরাণ নামে জলে। হাত ধরে টেনে তুলতে যায় মনসাকে।

'টানছ কেন? রেঁধে বেড়েই তো এলাম'

'খেতে দিবি চল'

নির্জন দুপুরে পুকুরঘাট শুনশান।

ভিজে কাপড়ে সপসপ করে পরাণের পিছু পিছু ফেরে মনসা। কালো বেতের মত হিলহিলে শরীর যেন বিষধর সাপ।

পরাণ মাছ ধরে, জেলে। বাপের করা বাড়িঘর। উঠোন আছে কয়েক হাত। জাল বিছিয়ে রাখে রোদে। একটা আঁশটে গন্ধ ঘর উঠোন।

মৌরলা মাছের ঝাল চচ্চড়ি আর ভাত। তিনটে থালা সাজায় মনসা। আড়চোখে দ্যাখে পরাণ।

একটা থালায় ভাত আর মাছ চচ্চড়ি পড়ে থাকে। খালি খাওয়ার আওয়াজ ওঠে মৃদু।

'রোজ রোজ খানিক খাবার নষ্ট। গরীবের ঘোড়া রোগ'

বিড়বিড় করে বলে পরাণ।

মনসা খেয়ে মাটির ঠাণ্ডা মেঝেতে শোয়। শরীর জ্বলে যায়। যেন গনগনে রোদের তাপ। এক এক সময় টানা দু তিন রাত ঘুমায় না মনসা। দুপুরে ঝিম মেরে থাকে তাই।

মনসা জানে না এখন পরাণ মাঝরাতে বের হয় মাছ ধরতে সারারাত নির্ঘুম থেকে। আগে শেষ সন্ধেয় রাত শুরুর আগে পরাণ খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। যেদিন বের হতো না, সেদিন হত তাদের সোহাগ রাত।

বছর দুই আগে পরাণের মা মরে গেল ডিসেম্বরের কনকনে শীতে। বুকে সর্দি বসে। মনসা জানল সে মা হবে,  ঠিক শাশুড়ি মরে যাওয়ার পরেই।

'মা আবার আসবে, আমাদের মেয়ে হয়ে', মনসা রোজ একবার করে বলত।

'তোর মাথাতেও আসে, যত বোকা বোকা কথা। '

জুনের তুমুল বর্ষায় পরাণ রাতেই ফিরল মাছ ধরা বন্ধ রেখে। ঘুমন্ত, দুর্বল মনসাকে যাবার সময় না ডেকেই আগল টেনে চলে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় বৃষ্টি  শুরু হয়নি। নিজের ঘরের দরজায় গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। মিশমিশে কালো অন্ধকারে মিশে পাথুরে শরীরে বুড়ো বাপ। পরাণের পাশ দিয়ে বের হয়ে যায় বাপ দ্রুত। পরাণ ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালে। বিছানায় থৈ থৈ রক্তের মধ্যে শুয়ে মনসা।

পরদিন ভোরে বৃষ্টি থামতে পাড়ার সবাই দেখে পরাণের বাপটা পুকুরঘাটের বাঁধানো সিঁড়িতে উপুড় হয়ে নিথর মরে পড়ে আছে।

মনসার শরীরটা তারপর থেকেই  লঙ্কা বাটার মতো জ্বলে।

যে শাশুড়ি আসবে ভেবেছিল, তার জন্য দুবেলা ভাত বাড়ে।

পরাণ শুধু ভাবে, বাপটা সেই রাতে মরে গেল কী করে! না মরলে যে সেই বাপকে মেরে ফেলত একদিন,  এও পরাণ নিশ্চিত জানে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন