কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

সুজাতা গাঙ্গুলী

 

পাঠ প্রতিক্রিয়া : When Breath Becomes Air




টিভিতে শুধু মৃত্যুর খবর। নদীতে ভাসা লাশের ছবি। কত আর নেওয়া যায়! দিন তিনেক আগে সরকার আর সিস্টেমের অপারগতা দেখে দেখে বিমর্ষ একটি সন্ধ্যে কাটিয়ে রাত্রে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। ঘুমকাতুরে মা’কে গভীর রাত অবধি জেগে থাকতে দেখে মেয়ে পড়া ছেড়ে গল্প করতে এলো। নানা কথার মাঝখানে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কী পড়ছিস তুই এখন? তখনই এই বইটির কথা জানতে পারলাম। বইটির নাম When Breath Becomes Air.

বইয়ের নামটি বারবার একটাই কথা মনে করাচ্ছিল। এখন সব থেকে জরুরী কী? অক্সিজেন! প্রাণবায়ু! কিন্তু যখন এই প্রাণবায়ু শুধু বায়ু হয়ে যায়! বইটির কাছে যেতে ইচ্ছে করছিল না। বুঝতে পারছিলাম এই বই আমাকে গ্রাস করে নেবে। পড়ুয়া মাত্রই জানেন সে যন্ত্রণা। এক একটি বই এড়িয়ে যেতে চাইলেও সে আপনাকে ছাড়বে না। কখনো ফিসফিস করে ডাকবে, কখনো এমন ডাক দেবে, আপনি যে কাজ করছেন তা ছেড়ে বইয়ের কাছে আসবেন। আসবেনই।  আমার ঠিক এই অবস্থা হলো। ডাক এড়াতে পারলাম না। একটু একটু করে পড়লাম। সময় নিয়ে নিয়ে। সরে গেলাম, ফিরে এলাম। শেষ হওয়ার পরেও সে আমায় ছাড়ছে না। কে? এই বইয়ের লেখক পল কলানিথি, আবার কে!

দু’শ ছাব্বিশ পৃষ্ঠার ছোট্ট একটা বই, পল কলানিথির নিজের জীবনের শেষ  দিনগুলোর কথা!

পল কালানিথি ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান। বাবা মা দুজনে দুই ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে তাঁদের বিবাহ তাঁদের পরিবার মেনে নিতে পারে নি। বাবা ডাক্তার ছিলেন, মা ফিজিও। তাঁরা আমেরিকায় চলে আসেন। তিনভাই পলরা,  তিনজনেই মেধাবী। পলের ছোট থেকেই সাহিত্য এবং মনস্তত্ত্ব পড়ার ইচ্ছে, তিনি তাই পড়েন কলেজ অবধি। কিন্তু তারপরে ইয়েল মেডিক্যাল স্কুল থেকে পড়াশোনা করে নিউরোসার্জন হন। অসম্ভব মেধাবী একজন মানুষ মাত্র পঁয়ত্রিশ  বছর বয়সে মৃত্যুর মুখোমুখি।

প্রচণ্ড ব্যস্ত নিউরোসার্জন পল, হ্যাপিলি ম্যারেড, যিনি নিউরোসার্জারির ফিল্ডটাকে অনন্য উচ্চতায় নেবার মত মেধা ও স্বপ্ন দুটোই পালন করতেন,   তাঁর অসামান্য স্বপ্নময় জীবনে নেমে এলো নির্মম সীমাবদ্ধতা - তিনি আর মাত্র কয়েক মাস, বড়জোর বছরখানেক বাঁচবেন। ডাক্তার হিসেবে রোগের এবং চিকিৎসার প্রতিটি ধাপ তাঁর জানা। কতটুকু সময় তিনি শারীরিক এবং মানসিক সুস্থ থাকতে পারবেন, তাও তাঁর জানা।  

এই সীমিত সময় নিয়ে কী করবেন পল? বাকি দিনগুলো সর্বোচ্চ কাজে লাগাবেন কীভাবে? জীবনের মর্মার্থ খুঁজতে দর্শন ও নিউরোসার্জারি অধ্যয়ন করা মানুষটি  কি জীবনের মর্মার্থ খুঁজে পাবেন? যদি পান, সেটা কী? মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন মানুষ কীভাবে তার জীবনকে দেখবে? তার প্রিয়তমা স্ত্রী-ই বা কীভাবে সামলাবে এই মর্মান্তিক পরিণতি?

এটি একটি মানুষের ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধের গল্প নয়, জীবনের অমোঘ সত্য মৃত্যুকে মেনে নেবার পরেও মাথা উঁচু করে, হাসিমুখে বিদায় নেবার গল্প।  বইটির প্রথম ভাগে পলের ছেলেবেলার এ্যাডভেঞ্চার, সেই সাথে একজন নিউরোসার্জনের প্রচন্ড কঠিন জীবন সম্পর্কে একেবারে অপারেটিং রূমের ভেতরে বসে ধারণা করতে পারবেন। দ্বিতীয় অংশে জানবেন কীভাবে ক্যান্সার একটা মানুষের স্বপ্নকে তছনছ করে দেয়। কীভাবে একজন ডাক্তার পেশেন্ট হয়ে যান - সব অর্থে।

এই বইটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, লেখকের পরিমিতিবোধ। গোটা বইটি  লেখা হয়েছে যখন পল ক্যান্সারে তাঁর বেঁচে থাকার সময় সীমিত, এটা নিশ্চিত ভাবে জানতে পারেন। একটা লাইনকেও নাটকীয় মনে হয়নি, কোথাও মনে হয়নি লেখক কারো সহানুভূতি চাইছেন। অথচ এই সাদামাটা ভাষায় লেখা বইটি শেষ করার পর টের পেয়েছি, অজান্তেই দুচোখ দিয়ে নেমে এসেছে জলের ধারা।  আর পলকে মনে হয়েছে, তিনি আমার খুব কাছের মানুষ।  

পল কোথাও “আরে ধুর, এই ক্যান্সার আমি হজম করে ফেলব” বা “হে ভগবান আমার ক্যান্সার হয়েছে, আমি শেষ” – এমন অবাস্তব আশাবাদ বা হতাশা,  দুটোর কোনটাকেই তিনি আঁকড়ে ধরেননি। জীবনের মত মৃত্যুকেও তিনি নিয়েছেন একটা প্রক্রিয়া হিসেবে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের আত্মসম্মান ধরে রেখেছেন। একদম শেষে ভেন্টিলেটর থেকে তিনি বলছেন, আই অ্যাম রেডি।  মানে শেষের শুরু। ভেন্টিলেটর প্রসেস থেকে বের করে তাঁকে মরফিন দেওয়া শুরু হয়। স্ত্রী, বাচ্চা, বাবা-মা-ভাই, চিকিৎসকদের টিম সব পরিবৃত হয়ে পল  পাড়ি দিলেন অন্য জীবনে। বইয়ের এই ভাগটা লিখেছেন তাঁর স্ত্রী।



বইটির সবচাইতে আকর্ষণীয় এবং হৃদয়বিদারক অংশ হচ্ছে এর এপিলোগ বা উপসংহার - যেটি প্রয়াত পল কালানিথির স্ত্রী লুসি কালানিথির লেখা। সেইসঙ্গে বইটির মুখবন্ধও সমান সুলিখিত।

‘When Breath Becomes Air’ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনের গল্প,  পরিবারের অমূল্য বন্ধনের গল্প, অজানাকে আপন করে নেওয়ার গল্প। এখন চারপাশে মৃত্যুর  পদক্ষেপ, আর আমি যেন পল কালানিথির মৃত্যুশয্যায় পাশে  দাঁড়িয়ে আছি… শুনতে পাচ্ছি, I am ready! মৃত্যুর কিছুদিন আগে বলা চিকিৎসকের কণ্ঠও শুনতে পাচ্ছি, this is not the end... or even the beginning of the end. This is just the end of the beginning.

আর এই কথা শোনার পরে পল লিখছেন, And I felt better...

মৃত্যুর রথ আসাতে পল সকলের কাছে বিদায় নিয়ে সসম্মানে পাড়ি দিচ্ছেন মৃত্যু পরবর্তী জীবনে।

 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন