কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৭


সার্কুলার

ছেলেটা আর পারছিল না। ওর লম্বা লম্বা শ্বাস উঠছিল। আমি ক্লান্তিতে হাঁপাচ্ছিলাম! ড্রাইভারকে বললাম, এখানেও কিছু হলো না। চলো তিন নম্বর হাসপাতালে।

গাড়ির সীটে বসে আকাশটা দেখা যাচ্ছিল। মনে হলো, সাংবাদিক প্রতিনিধিরা খবর কাগজ নয়, ওই আকাশের হাল্কা হাল্কা মেঘের সাথেই চিপকে দিয়েছে সংবাদ, না কি সার্কুলারটা!

আমি ভীষণ ক্লান্ত। শরীরটা আর টানছিল না। আমার ছেলে হাঁটতে পারছে না। ওর শরীরটা এলিয়ে পড়েছে। তিন নম্বর হাসপাতাল। স্ট্রেচার বা হুইল চেয়ার নিয়ে আসবে এমন কেউ আমার কাছে নেই। ও আমার কাঁধে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। জ্বরে গাটা পুড়ে যাচ্ছে! কোনমতে হাসপাতালের অ্যাডমিট কাউন্টারে এসে পৌছালাম। বললাম, আমার ছেলেটাকে নিয়ে এসেছি। খুব জ্বর। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে! ভর্তি করাতে চাই।

কাউন্টারের লোকটা বললো, টেষ্ট রিপোর্ট আছে? পজেটিভ না হলে এখানে ভর্তি হবে না!

-পজেটিভ না নেগেটিভ, সেটা টেষ্ট করানোর সময় পাই নি! আপনারাই আমার  ছেলেটাকে বাঁচাতে পারবেন। একটু দয়া করে দেখুন না! দয়া করে ছেলেটাকে ভর্তি করিয়ে নিন না!

আমার পাশের আরেক ভদ্রলোক তার বউকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। মনে হলো, অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এবারে সেই দীর্ঘ-অপেক্ষমান লোকটা রাগে ফেটে পড়লো। সে অ্যাডমিট কাউন্টারে বসা লোকটার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলো। ‘কেন? কেন আপনারা ভর্তি নেবেন না? আপনি পেশেণ্টকে ফেরাতে  পারেন না! গভার্মেন্টের সারকুলারে বেরিয়ে গেছে, অসুস্থ রোগীকে যে কোন  হাসপাতালে ভর্তির জন্যে পজিটিভ / নেগেটিভ রিপোর্ট জরুরী না!’

এরপরে এই নাটকই চলল। কোন লাভই হলো না! আধা ঘন্টা অপেক্ষা করে তিন নম্বর হাসপাতালের থেকে বেরিয়ে এলাম। ড্রাইভারকে বললাম, চলো চার নম্বর হাসপাতাল।

ছেলেটা গাড়ির সিটে শরীর এলিয়ে দিয়েছে। চারপাশে এতো অক্সিজেন, অথচ  ওর ফুসফুসে অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে। বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে! জানি না, চার নম্বর হাসপাতাল পর্যন্ত পৌছাতে পারবো কিনা!

দুদিন ধরে ফলাও করে খবর কাগজে লেখা হচ্ছে, সরকার আদেশ দিয়েছে,  কোন হাসপাতালই রোগীকে ফেরাতে পারবে না। হাসপাতালে ভর্তির জন্যে  পজেটিভ বা নেগেটিভ রিপোর্ট জরুরী না! আমি নিজের চোখে একটা মেসেজে সেই সার্কুলারটা দেখেছি।

গাড়িটা চার নম্বর হাসপাতালের দিকে এগোচ্ছে। চলতে চলতে গাড়ির উইন্ড স্ক্রিনের মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছিল অনেক কিছুই। দোকানপত্র, বাড়িঘর, ল্যাম্পপোষ্ট, ফেস্টুন, পার্টির পতকা, আকাশের টুকরো টুকরো ভাসমান মেঘ। দেখলাম, সব কিছুর মধ্যেই সাদা সাদা কাগজে বড়ো বড়ো হরফে সাঁটা রয়েছে নানা সরকারী বিজ্ঞাপন ও সার্কুলার!

আমি আমার সন্তানের বুকে হাত ডলতে ডলতে বললাম, জোরে, আরেকটু জোরে শ্বাস নে বাবা! এই তো, এই তো, এক্ষুনি আমরা পোঁছে যাবো!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন