কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

অচিন্ত্য দাস

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৩


নিজের নিজের গান

সে অনেকদিনের কথা। গান-পাগল এক রাজার সভায় রোজ আসর বসত। সেদিন রবাব বাজালেন এক শিল্পী, রাজার ভালো লাগেনি।  বললেন, “কবে থেকে সেই একই সুর বাজাচ্ছ, নতুন কিছু শোনাও এবার!”

শিল্পী মনের দুঃখে ফিরে চললেন। নতুন সুর কোথায় পাবেন? ফেরার পথে তিলকগাঁও পড়ে, সেখানে দেখলেন কয়েকজন গাঁয়ের মেয়ে গান গাইতে গাইতে যাঁতায় যব পিষছে। আরে গানটা তো বেশ নতুন ধরনের! শিল্পী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সুরটা তুলে নিলেন। নাম দিলেন ‘তিলক কামোদ’। সেই রাজা, সে শিল্পীকে  লোকে কবে ভুলে গেছে, রয়ে গেছে শুধু সুরটা। এখনো লোকে শোনে। একমনে শুনলে কতযুগের ওপার থেকে গ্রামের মেয়েদের গান আবছা ভেসে আসে।

মাঝি নৌকা বাইতে বাইতে যোগাড়েকে বলে, ক্লান্তি লাগে, গান ধর দিকি একটা! সে ভাটিয়ালি ধরে, গানের টানে নৌকো চলে ওপারে।  

তাঁতি তার কিশোর ছেলেকে নিয়ে নকশা-কাটা কাপড় বুনছে। ছেলে দেখে দেখে শিখছে আর গান গাইছে। গানের তালে মাকু চলছে। জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির মেয়েটিকে এক ঝলক দেখতে পেয়ে ছেলের তাল কেটে গেল। তাঁতি হায় হায় করে উঠল, গেল রে নকশাটা ভুল হয়ে গেল। তাঁতবোনার গানটাও গাইতে  শিখলি না!

একশো-তিরিশ বছর। আর কত টিকবে বাড়ি! করপোরেশন লিখে দিয়েছে ‘বিপজ্জনক’। দেয়ালগুলো ভেঙে পড়ছে, ছাদটা কিন্তু এখনো শক্ত। সেই কবে  মেয়ে-মজুররা দুরমুশের তালে তালে গান গেয়ে ছাদ পিটেছিলো। চূন-সুড়কি আর সুর, তিনে মিলে ছাদ এত মজবুত।

কেয়া ভালোবাসে রবীন্দ্রসঙ্গীত, তার স্বামী প্রভাত পঞ্চাশ-ষাটের দশকের আধুনিক। রাগারাগি হলে শোবার ঘরে শোনা যায় সুচিত্রা, কণিকা, দেবব্রত আর বাইরের ঘরে মানবেন্দ্র, প্রতিমা, শ্যামল। ওদের বারান্দার গ্রিল রং হচ্ছে। একটা বছর সতেরো-আঠারোর আদিবাসি ছেলে, রঙের টিন আর বুরুশ নিয়ে কাজ করছে দুপুরবেলা। ভাতঘুমের সময়। প্রভাত ছেলেটাকে ধমক দিয়ে বললেন,  এই, তোর মোবাইলের গানটা বন্ধ কর তো!   

কী একটা সাঁওতালি-ভোজপুরি মেশানো ঝপর-ঝপর গান, টানা চালিয়ে রাখে ছেলেটা। বিরক্তিকর!

পরের দিন রং দেখে প্রভাত খাপ্পা। একদিকটা ঠিক আছে, অন্যদিকটায় এলোমেলো বুরুশ টানার ছোপছোপ দাগ। ঠিকেদারকে তলব করতে সে ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে এল।

ঠিকেদার বলল, একি করেছিস? কাজে মন দে নয়তো বসিয়ে দেব।

সরল নিষ্পাপ মুখে ছেলেটা বলল, ঠিক তো করছিলাম। তারপর গানটা চালাতে  দিলনি, গান ছাড়া কাজ পারি না যে…

যত্তসব! কথাটা ঠিকেদার উড়িয়ে দিল, কিন্তু প্রভাতকে যেন একটু আনমনা দেখাল।

সকলেরই নিজের গান থাকে। দিনের শেষে কে থাকবে, কী থাকবে তা কেউ  জানে না। নিজের গান কিন্তু ছেড়ে যায় না, সুখে-দুঃখে-কাজে-অকাজে পাশে রয়ে যায়। এতকিছু বুঝুক না বুঝুক, ছেলেটা তার নিজের গানটুকু মোবাইলে ভরে সঙ্গে রেখেছে। ঠিকেদারের কথায় দুপুরে রং-বুরুশ নিয়ে ছেলেটা আবার যখন এলো, প্রভাতকে বলতে শোনা গেল, তোর গানটা চালিয়ে রাখতে পারিস রে…

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন