কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

০৬) ভূদেব ভকত

আগুনের পরশমনি


একটি ছবি, একটি গল্প বা একটি গান বোধহয় অপেক্ষা করে থাকে কোনো এক শিল্পীর দেহ-মন থেকে পৃথিবীর আলোতে আসার জন্য। তারা কেমন করে আসে, কেন আসে, কেউ জানে না। অশরীরী শরীর খুঁজে ফেরে। প্রথমে থাকে স্বপ্নে বা ভাবনায়। কেমন চেহারা পাবে, তা তারা নিজেরাও হয়তো জানে না। অবচেতনে কোনো অস্পষ্ট রূপ হয়ে কোথাও লুকিয়ে থাকে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করলে তিনিও হয়তো বলতেন, এত গান, এত কবিতা, এত লেখা – এ আমার নয়, কেউ লিখিয়ে নিয়েছে। আমার ভেতর দিয়ে তারা এসেছে এই পৃথিবীতে। যখন তিনি ছবি আঁকতেন, তখনও বোধহয় ঐরকম কিছু একটা ঘটত। অশান্ত ক্যানভাস থেকে, মনের ঝড় ঝঞ্জা থেকে, দুঃখ থেকে, বিরহ থেকে আঘাত ফুঁড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করত। ছবিগুলো একখানা ঔরস খুঁজতো, ভ্রূণও খুঁজতো হয়তো। তিনি যখন ছবি আঁকতেন তখন হয়তো নন্দলাল কিংবা শান্তিদেব অথবা দিনেন্দ্রনাথ বা রানী চন্দ কেউ যদি ঐ ছবি দেখে বলতেন, ‘বাঃ, বেশ হয়েছে’, রবীন্দ্রনাথ সেই ছবি নষ্ট করে ফেলতে চাইতেন। রানী চন্দের মুখে এ কাহিনী শোনা গেছে। কখনও তিনি ছিঁড়ে ফেলতেন ছবি, আবার কখনও ঘষতে শুরু করতেন, যতক্ষণ না মনের বিরক্তি শান্ত হয়। এত সহজে ভালো বললে চলবে না! রবীন্দ্রনাথের অদৃশ্য ক্রোধ ছবিটিকে ধ্বংস করতে উদ্যত হতো। কিন্তু তার ফলে জন্ম নিতো এক নতুন ছবি। প্রকারান্তরে হয়তো তিনি প্রাণটাই খুঁজে ফিরতেন ছবির ভেতরে। সেই চক্ষুদান না হওয়া পর্যন্ত তিনি স্থির হতে পারতেন না। তাই তাঁর ছবিগুলি এত বেশি ঘষামাজা। এত অন্যরকম। আর কেউ এত সহজে বলতে পারবে না যে, ‘বাঃ, বেশ হয়েছে’! তাকে অবাক হতে হবে। ভাবতে হবে। ‘বাঃ’ বলার আগে থামতে হবে। চির সুন্দর কি এত সহজে হয়? ঐ ছবি যেন আর কোনো একজনের মুখ নয়, কোনো একখানি দৃশ্য নয়; বরং ঐ ছবি জগতের সবার, সব মানুষের, সব নারীর মনের চেতনার। সমস্ত পৃথিবীর আনন্দের বা শান্তির বা বিরহের। যখন সেই অনাবিল রূপ ধারণ করতো ছবিগুলি, তখনই তিনি থামতেন। মনখারাপ থেকে ছবি। মনের অশান্তি থেকে শান্তি। অস্থিরতা থেকে স্থিরচিত্র। বিরক্তি থেকে শুক্তি। শুক্তির ভেতর মুক্তো। এই তো সৃষ্টি!




এই সৃষ্টিসুখ বা সৃষ্টিরহস্য একদিন আমাকেও স্পর্শ করেছিল। কিছু স্বপ্নিল চেহারা ভেসে এসেছিল মনে। কিছু ছবি করেছিলাম। কিন্তু মন বলছিল, ‘নাঃ! হয়নি’। অশান্ত মন বলছিল, ছবিগুলি নষ্ট করে ফেলতে। হঠাৎ দেখলাম, ঘরের কোণে একটা প্রদীপ জ্বলছে। এখুনি কেউ সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে গেছে। কী যে হলো, কোনো এক তাড়নায় পোড়াতে শুরু করলাম ছবিগুলিকে। অশান্ত মন অতৃপ্ত হাতে ছবিগুলিকে ধরে রাখে প্রদীপ শিখার ওপরে। উত্তপ্ত শিখার আঁচে যেন আর্তনাদ করে ওঠে। কেঁদে ওঠে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলি ছবিগুলিকে। এ আমি কী করছি? ছবি যে কাঁদছে! কিন্তু একি আশ্চর্য! অবাক চোখ মেলে দেখি, অপূর্ব সব চেহারা ধারণ করেছে ছবিগুলি। এখন আর কেউ সহজে বলতে পারবে না, ‘বাঃ, বেশ হয়েছে’! তাকে ভাবতে হবে। থমকে যেতে হবে। ভালো বলার আগে অবাক হতে হবে। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ যেন আমাকে অজান্তে শিখিয়ে দিয়েছেন ঐ অবাক হওয়ার মন্ত্ররহস্য। কিন্ত কার আঁকা ঐ ছবিগুলি? কোন্‌ মহাশিল্পী আমার ভেতর দিয়ে কাজটা করিয়ে নিয়েছেন? জানি না আমি। পোড়া ছবিগুলির কালি মুছে নিয়ে ছবিগুলিকে নতুন করে ভালোবাসি। নতুন করে সৃষ্টি করি। কিন্তু এই ছবিগুলি প্রকৃতপক্ষে কার সৃষ্টি? আমার, না আগুনের? না, আজও আমি তার সঠিক উত্তর জানি না।



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন