কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২২

চিরশ্রী দেবনাথ

 

সমকালীন ছোটগল্প


কয়েক বছর পর

কে বলছেন?

আমি বলছি, চিনতে পারছিস না? আমি অবশ্য গরিব লোক, তাই আমার সঙ্গে তোর কথা বলার ইচ্ছে নাও হতে পারে।

দেবদত্ত থমকে গেলো। মনে হয় ছোটবেলার কোনো বন্ধু, আজ সে বড়লোক হয়েছে বলে, যোগাযোগ পুনরুদ্ধার করতে চাইছে। ধাঁ করে একজন বিখ্যাত লেখকের এরকম একটি গল্পের কথা মনে হলো দেবদত্তের। কে লিখেছিলেন, সুনীল গাঙ্গুলী? সমরেশ বসু না শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়? ছোটবেলার বন্ধু বড়লোক  বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, উদ্দেশ্য ধার চাওয়া।

গরিব শব্দটি শুনলেই আজকাল দেবদত্তের খুব ভয় হয়, বিশেষ করে পেনডেমিকের সময় তার মতো সেমি বড়লোকদের খুব অসুবিধেয় পড়তে হয়েছে, অনবরত

এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সাহায্য করো তো পাড়ার ক্লাবে পথবাসীদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে ওখানে টাকা দাও, এতো মহা জ্বালা। কষ্ট করে

টাকাপয়সা পরিশ্রমী মানুষ রোজগার করে, নিজে যাতে ভালো থাকতে পারে তাই, সব কি অন্যকে বিলিয়ে দেবার জন্য নাকি? কেন তারা রোজগার করতে পারে না? অলস লোক সব। মাত্র আধমিনিটের মতো এতোসব চিন্তা করে ফেলল দেবদত্ত। তবুও অনিচ্ছাকৃত হলেও কন্ঠ যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে দেবদত্ত বলল, আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না, নামটা বলুন প্লিজ, আমার তাড়া আছে।

আমি, হিমাংশু, মনে করতে পারলি দেবু?

দেবু মানে দেবদত্ত আধসেকেন্ডের মধ্যেই মনে করতে পেরেছে, হিমাংশু  প্রাইমারি স্কুলের ক্লাসমেট, তারপর স্কুল বদলে হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তির সময়ও সে আর হিমাংশু ক্লাস এইট পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছে, তারপর দেবদত্তকে ওর বাবা শহরের স্কুলে ভর্তি করে দেন, ওর বাবাও ট্রান্সফার হয়ে চলে চলে আসে শহরের খুব কাছে একটি স্কুলে। ব্যস গ্রামের পাট চুকে গেলো প্রায় সবসময়ের মতো। একটি ক্ষীণ যোগাযোগ ছিল দাদু ঠাকুমা থাকা অব্দি, তারপর  তারাও মারা গেলেন, গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে বাবা শহরে জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করলেন, আস্তে আস্তে যেন স্মৃতি থেকেও মুছে গেছে জন্মগ্রামের নাম।

তবে খুব সাবধানে এবং ভয়ে ভয়ে কথা বলে দেবদত্ত, হ্যাঁ আবছামতো মনে পড়ছে, পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারল না, বিবেক বলে কিছু একটা তো আছে!

এতটুকুতেই হইহই করে উঠল হিমাংশু, খুব খুশি হলাম তুই আমাকে মনে করতে পারলি বলে। তা কেমন আছিস বল?

না মানে বুঝতেই পারছিস করোনার জন্য সবদিক দিয়ে খুব ব্যতিব্যস্ত আছি, ব্যবসার হাল খারাপ, টাকাপয়সা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কী করে যে সামলাচ্ছি আমিই জানি। প্রথমেই দেবদত্ত নিজেকে একটু নিরাপদ অবস্থানে এনে রাখতে চাইল, যাতে টাকাপয়সা না চেয়ে বসে,  হিমাংশু অবশ্য স্বাভাবিক গলায় বলল, ও আচ্ছা, তবে  তোকে যে কারণে ফোন করেছি তা হলো, এখন তো লকডাউন একটু ঢিলেঢালা হয়েছে, একটু আয় না গ্রামে, দুটোদিন থেকে যা, গল্পটল্প করবো। তোর ফোন নং খুব কষ্ট করে জোগাড় করেছি রে। জীবনটা কিছুদিন ধরে ভীষণ বোর লাগছে দেবু।

দেবদত্তের অস্বস্তি এক লহমায় কেটে গেলো। এই অসময়ে একজন দরিদ্র বন্ধু তাকে নিছক গল্প করার জন্য নেমতন্ন করছে, যাহ্ তাও আবার হয় নাকি! এ যে বিস্ময়। তবুও বিচক্ষণ দেবদত্ত খুব একটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো না, একটু গম্ভীর হয়ে বলল আচ্ছা চিন্তা করে দেখি। তারপর হিমাংশু অবশ্য আরো প্রায় দশমিনিটের মতো নানা কথাবার্তা বললো, সেগুলো খুব একটা মন দিয়ে শুনল না দেবদত্ত।

হিমাংশুর ঠিকানা তো জানাই আছে। বহুদিন ধরে ঘরে থাকতে থাকতে সত্যিই জীবনটা একদম নিরানন্দ ও একঘেয়ে লাগছে। কিন্তু স্ত্রী পুত্রকে বাড়িতে রেখে এভাবে একা একা বেড়াতে যাওয়াটা কি ঠিক? ওরাও তো দীর্ঘদিন গৃহবন্দী। তারপর মনে হলো, এইমুহূর্তে এতো ভেবে লাভ নেই, একদিনের জন্য ব্যবসার    কাজ বলে ঘুরে আসাই যায়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সবাই মিলে বেড়াতে যাওয়া যেতেই পারে হইহই করে, এতো অনুশোচনার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আবার মানিক বন্দোপাধ্যায়েরই তো, ঠিক শিওর হতে পারছে না দেবদত্ত, একটি গল্প ছিল নিজের দারিদ্র দেখানোর জন্য কায়দা করে অফিসের বসকে নেমতন্ন করে আনা।

ধুর ছাই, কী যে ভেজাল লাগল মনে, না ভালো লাগলে না গেলেই হয়। আবার  কেন যেন খুব যেতে ইচ্ছে করছে ছোটবেলার গ্রামে। সেই স্কুল, আবৃত্তি কম্পিটিশন, হাততালি, প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সেকেন্ড হয়ে স্টিলের বাটি পাওয়া। তবে হিমাংশু পড়াশোনায় দেবদত্তের থেকে অনেক ভালো ছিল। প্রথম তিনজনের মধ্যে হিমাংশুর নাম ছিল মাস্ট। সে ছেলে জীবনে কিছুই করতে পারল না! গ্রামে পচছে বসে বসে। আশ্চর্য! অথচ দেবদত্ত পড়াশোনার কোয়ালিটিতে অনেকটাই হিমাংশুর থেকে খারাপ ছিল, তবে আউট নলেজে তারা সবাই একজন আর একজনের কম্পিটিটর ছিল। গ্রামের স্কুল হলেও নিয়মিত ক্যুইজ, বিতর্কসভা স্কুলের শিক্ষকরা স্টুডেন্টদের জন্য করতেন, তাদের সময় হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন রমাকান্ত সরকার। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ইংলিশে এম এ, খুব হাসিখুশি ছাত্রবৎসল, কিন্তু প্রশাসক হিসেবে কড়া। তার কাছে আদর ও ধমক দুটোই খেয়েছে ওরা নিয়মিত।

অনেকদিন পর স্কুলের উষ্ণ দিনগুলোর কথা যেন শ্রাবণের বৃষ্টির মতো দেবদত্তকে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো। সবসময় ব্যবসা আর টাকার কথা ভাবতে ভাবতে কোনোদিন যে দেবদত্ত একজন উচ্ছল কিশোর ছিল একথাই ভুলে গিয়েছিল বেমালুম। মনের এককোণায় একটি সবুজ মাঠ পরে আছে অবহেলায়, আশ্চর্য, আস্তে আস্তে অদ্ভুত আনন্দ আর উত্তাজনায় দেবদত্ত জেগে উঠল যেন বহুদিন পর। পরদিন সকালেই হিমাংশুকে ফোন করল, শোন আমি শনিবার সকাল সকাল আসব, রবিবার থেকে সোমবার সকালে চলে আসব।

তা কী করে হয়? অন্তত দুদিন তো থাকতেই হবে।

হিমাংশু খুব আন্তরিক হয়ে বলল, তাছাড়া একটি বিরাট সারপ্রাইজ আছে, একদিনে সব হবে না দেবু।

দেবদত্ত অবাক হয়ে বলল কী সারপ্রাইজ রে?

সারপ্রাইজ কি কেউ বলে গাধা?

হুম।

অপেক্ষায় আছি রে বন্ধু।

দেবদত্ত মনে মনে ভাবল, কতদিন হয়ে গেলো ব্যবসার বিষয় ছাড়া লোকজনের সঙ্গে আর কোনোরকম আলোচনাই সে করেনি। তবে আনন্দের অনুভূতি মানুষকে একটু ভালো করে দেয় বোধহয়। তাই সে স্ত্রী এবং ছেলেকে আর মিথ্যে বলল না, সহজভাবেই বলল, দুদিনের জন্য পুরনো গ্রামে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি, তুমিও না হয় বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে এসো। স্ত্রী তো একবাক্যে রাজি, ছেলে নাইনে পড়ছে, ক্লাশ তো ল্যাপটপে অনলাইনে, কোনো সমস্যাই না, সব ঠিকঠাক হয়ে গেলো মসৃণভাবে।

করোনাকালে নিজের গাড়িই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ।

অনেকদিন পর একটু পরিপাটি করলো দেবদত্ত নিজেকেও, বয়স যাতে চল্লিশ ক্রস করেছে কোনোভাবেই না বোঝা যায়। হিমাংশুর স্ত্রী বোধহয় গ্রামেরই কোনো মেয়ে হবে, আর ছেলেমেয়ে, ওখানেই পড়ছে নিশ্চয়ই।

হিমাংশুর পরিবারের জন্য কী নেওয়া যায়? এখান থেকেই কিনবে না ওখানে গিয়ে, একবারে নিয়ে যাওয়াই ভালো, খুব বেশি দেখনদারি করবে না দেবদত্ত, দুবেলা চারাপোনার ঝোল খাইয়ে, বন্ধুত্বের ন্যাকামি করে তারপর না পঁচিশ হাজার ধার চেয়ে বসে। গাড়িটাও নিজের একথা বলবে না, ভাড়ার গাড়ি বলবে। দু বাক্স মিষ্টি আর কিছু ফল কিনে নিয়ে নিল দেবদত্ত।

পিচ ঢালা রাস্তা, দারুণ আবহাওয়া, প্রাণের ফুর্তিতে গাড়ি চালিয়ে দেবদত্ত গ্রামের ভেতর এসে পড়ল একঘন্টার মধ্যেই। তবে পরিবর্তন ঘটেছে ব্যাপক এই ক’বছরে। হিমাংশুকে ফোন করতে হবে, ওর বাড়ির রাস্তাটা পাল্টে গেছে মনে  হচ্ছে, নিজেদের বাড়ি যেখানে ছিল, সে জায়গাটায় আপাতত যেতে চাইছে না  দেবদত্ত, হালকা একটি ব্যথা অনুভূত হচ্ছে যেন, তাই রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে হিমাংশুকে ফোন করল। চারদিকে ঝিরঝিরে বাতাস আর সোনারোদ। আশেপাশে যতগুলো বাড়ি দেখা যাচ্ছে পুরোপুরি কুঁড়েঘর নয়, দিব্যি দালানকোঠা, টিনের ঘর, বাঁশের বেড়ার ঘর সব মিলেমিশে আছে। একটি বাইক আসছে দূর থেকে, দেবদত্তের গাড়ির কাছে এসেই থামল। বাইক থেকে যে নামল, সে দীর্ঘকায়, মেদহীন শরীর, হেলমেট খুলতেই বহুকাল আগের  চেনামুখ ভেসে উঠল, হিমাংশু।

আরে শালা তুই তো দেখি পটলের মতো হয়ে গেছিস, এসব কী? শহরে থাকিস, আমি তো ভাবলাম তোর জিম করা পেটানো চেহারা দেখব!

হিমাংশুকে দেখে দেবদত্তের একটু হিংসে হলো, একদম যুবক লাগছে, মোটেই আনস্মার্ট চেহারা নয়। মাথার চুলও পড়েনি, দেবদত্তের হাত হালকা করে নিজের কপালের পাতলা চুলে চলে গেলো।

বাড়ি চল। গাড়ি এনেছিস আবার, ঠিক আছে তোর গাড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চালাচ্ছি বাইক।

দেবদত্ত ভাবছে, হিমাংশু কী করে আসলে!

একটি বড় গেটের সামনে হিমাংশু বাইক থামালো। গাড়ি ঢুকে পড়ল সেই গেট দিয়ে সহজেই। সাধারণভাবে বানানো পাকা ঘরদুয়ার, বারান্দা, চারদিকে অজস্র গাছপালা, ফুলের বাগান, ফলের গাছ, পুকুরও আছে নিশ্চয়ই বাড়ির পেছনে। দুটি কিশোর কিশোরী বেরিয়ে এলো।  হিমাংশুর ছেলেমেয়ে নিশ্চয়ই, হিমাংশু বলল মাকে ডাক। ডাকতে হলো না, হাসিমুখে যিনি সামনে এসে দাঁড়ালেন তার চোখে মুখে এবং পোশাক আশাকে গ্রাম্যতা নেই মোটেও। মুখখানাও খুব চেনা মনে হলো দেবদত্তের। ফর্সার দিকে গায়ের রঙ, ঘাড়ের কাছে খোঁপা, কপালে  ছোট খয়েরি টিপ, সুতির শাড়ি আর হালকা সোনার গয়নায় এই তরুণীকে পুরোপুরি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের নায়িকা মনে হচ্ছে। এইসব মারাত্মক পরস্ত্রীরাই মাঝবয়সী পুরুষদের পরকীয়ার একমাত্র কারণ। এরা সিনেমাটিক নয়, কিন্তু অন্তর্ভেদী। দেবদত্ত সঙ্গে সঙ্গে কুচিন্তার জন্য নিজেকে একটু অভিশাপও দিয়ে দিল।

হিমাংশু বলল, আমার স্ত্রী, চন্দ্রা, চিনতে পেরেছিস নাকি?

দেবদত্ত বাধ্য হয়ে স্মৃতি হাতরাতে লাগল, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি মনে হলো ওদের থেকে চারবছরের ছোট চন্দ্রাকে, শ্যামাপদ স্যারের মেয়ে, অংক করাতেন প্রাইমারি স্কুলে।

আর আমি আমাদের স্কুলেরই টিচার হয়েছি রে। বাংলা পড়াই, গ্রামেই আছি, এখানেই থাকব, শহরে যাওয়ার প্ল্যান এখন পর্যন্ত নেই। হিমাংশু এতক্ষণে নিজেকে খোলসা করল।

দুপুরে খাওয়াদাওয়া হলো জম্পেশ, তবে হিমাংশু চারাপোনার ঝোল খাওয়ালো না, ইলিশ মাছ খাওয়ালো। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সারপ্রাইজের দেখা নেই, হিমাংশুকে জিজ্ঞেস করলেই বলে, তুই কি বাচ্চা নাকি?

ভাতঘুমের একটি অভ্যাস আছে দেবদত্তের, বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছিল, হিমাংশু ধাক্কা মেরে উঠিয়ে দিল, এজন্যই তো পটল হয়েছিস, আর পটল তুলবি কদিন পর, ওঠ। অগত্যা দেবদত্ত উঠে পড়ল, বলল গ্রামে ঘুরে আসি তাহলে।

না সারপ্রাইজ আছে তারপর। পাঁচটা নাগাদ আরোও দুজন ভদ্রলোক এলেন, তাদের দিকে মিনিট দশেক তাকিয়ে দেবদত্ত বুঝতে পারল, তারা হলো ওদেরই ছোটবেলায় বন্ধু রূপক ও সুভাষ।

এই কদিনে আমি এই চারপাঁচজন পুরনো বন্ধুকে পাকড়াও করেছি, গৌতম, রূপক, সুভাষ, বিক্রম আর তুই। বহুদিন হলো বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ নেই, কবে কে মরে টরে যাই, তাই একটু আনন্দ করা।

হো হো করে হাসল হিমাংশু।

এই প্রথম দেবদত্তের বুক থেকে ভার নেমে গেলো। টাকাপয়সা চাইবে না হিমাংশু, পরিবেশ থেকে মোটামুটি নিশ্চিত হলো দেবদত্ত, এমনিই ফুর্তি করার জন্য এই আমন্ত্রণ।

হিমাংশুদের বাড়িতে উঠোনের ওপর বেশ বড় একটি ঘর, ওদের থাকা খাওয়ার ঘর থেকে আলাদা, সেখানেই তিনটে খাটে ওদের শোওয়ার ব্যবস্থা করেছে হিমাংশু, যাতে প্রাণখুলে  গল্প করা যায়। তবে দেবদত্তের এখন একটু একটু  হিংসে হচ্ছে হিমাংশুকে দেখে, ওর সুন্দর স্বাস্থ্য, হ্যান্ডসাম লুক, অমন লাবণ্যময়ী বউ, দুটো ফুটফুটে ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের এই সাজানো গোছানো বাড়ি, সবকিছুতেই হিমাংশু যেন ওদের অনেককেই ছাপিয়ে গেছে, বড়ো চাকরিবাকরি বা ব্যবসা না করেও ও এখন অন্যদের থেকে ভালো আছে।

দেবদত্তের নিজের ফ্যাটি ও বয়স্ক চেহারা নিয়ে লজ্জা হচ্ছিল, বার বার মনে হচ্ছিল বাড়িতে ওর স্ত্রীও যথেষ্ট মোটা এবং নানা রোগ বাঁধিয়ে বসেছে শরীরে, ছেলেও ওবেসিটিতে ভুগছে। এতোদিনে এই প্রথম দেবদত্ত অনুভব করল শহরবাসী হয়ে তার কোনও লাভ হয়নি। আর বাকি বন্ধুদেরও কী চেহারা হয়েছে, চল্লিশ সবে পেরিয়েছে ওরা, এখনই সার দিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা কুমড়োর মতো ভুঁড়ি। চোখের নিচে কালি প্রত্যেকের, কপালের ওপর চুল পাতলা হয়ে টাক পড়া শুরু হয়েছে, যৌবনকে একদম বাই বাই করে দিয়েছে সবাই। কিন্তু হিমাংশু  তেমন নয়, ওকে দেখে মনে হচ্ছে চল্লিশ পেরোয়নি, একে বলে সুস্বাস্থ্যের দীপ্তি। আসলে কে জীবনে কী পেলো তা নির্ধারিত হয় দুটো বয়সে এসে, প্রথম চল্লিশের  পর, তারপর ষাটবছর বয়সের পর।

সবাই হাবিজাবি গল্প করছিল, হঠাৎ দেবদত্তকে ঠেলা মেরে হিমাংশু বলল, এতোক্ষণ ধরে কী ভাবছিস? চল, বেরোব।

মোট তিনটে বাইকে, ছয়জন।

কোথায়?

জটা খালের কাছে।

সেই খালে এখনো জল আছে? সবাই প্রায় সমস্বরে বলে উঠল।

হিমাংশু বলল, হ্যাঁ আছে, ভালোই আছে, সংস্কার হয়েছে কয়েকবছর আগে। কাঠের ব্রিজের বদলে পাকা ব্রিজও হয়েছে। চল।

জটা খাল বেশ কিছুটা দূরেই। জটা খাল প্রাকৃতিক না বহু বছর আগে মানুষ তৈরি করেছিল কেউ জানে না, তবে খালটির একটি অংশ বেশ বড়, সেখান থেকে সরু সরু কিছু ধারা বেরিয়ে গেছে, যেগুলো গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে। কৃষি খেতগুলো এই সব নালার  জল সারা বছর ব্যবহার করে। কৈশোরের দামাল দিনগুলোতে জটা খাল ছিল তাদের অ্যাডভেঞ্চারের জায়গা। সেখানে বটগাছের তলায় বসে সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে, ভীষণ স্পিডে  সাইকেল চালিয়ে ঘরে ফেরা। সে জায়গার আরোও একটি নিষিদ্ধ আকর্ষণ ছিল, সেটা হলো শ্যামা ভৈরবী। শ্যামা  ভৈরবীর আস্তানা ছিল জটা খালের পাশে। একটি শিব মন্দির, বহু পুরনো, ইটের তৈরি, শুধু মাত্র শিবরাত্রি বা কোনো মানসী থাকলেই এখানে গ্রামের মহিলারা ভিড় করে পুজো দিতে আসত। বাকি দিন ভৈরবী একা, বিশুদ্ধ একা, শোনা যায় তার স্বামী ছিল, মাঝে মাঝে আসত, তবে সে নিয়ে কেউ  মাথা ঘামাতো না। ভৈরবী দীর্ঘকায়া, গায়ের রঙ  মিশমিশে  কালো, শরীরী  প্রাচুর্যে   ভরা, তার ওপর ব্লাউজহীন পাতলা সুতির শাড়ি, সেই শাড়ি ভেদ  করে দেহবিভঙ্গ ঠিকরে বেরিয়ে আসত। শিব মন্দিরের বারান্দায় বসে থাকত সে, পাশে একখানি ত্রিশুল, কপালে মেটে সিঁদুর, ভাগ্য বলার চেষ্টা করত, সেই লোভে কেউ কেউ আসত, সামান্য দক্ষিণাও পেতো।

পাঁচ ছয়টি কিশোর যে তার শরীরকে দূর থেকে গিলে খাচ্ছে প্রায়, শ্যামা ভৈরবী যেন সেটা বুঝতে পারত, সে আরোও খোলামেলাভাবে বসত, তাদের পাশ দিয়ে শিবের মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে ঘোরাফেরা করত।

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, হিমাংশুরা কেউ এই ব্যাপারটি নিজেদের মধ্যে শেয়ার  করতে পারেনি সেইসময়, প্রত্যেকে নিজের করে  ভেবেছে শুধু। আজ হঠাৎ জটা খালের কথা ওঠায় পুরনো দিনের কথা মনে হলো সবার।

দুপুরের পর রোদ মরে এসেছে, তিনখানা বাইক ছুটে চলেছে জটা খালের দিকে। পাকা ব্রিজের ওপরে এসে থামল সবাই। ওপাশে চা বাগান রয়েছে, অনেক আগে বাঁশের সাঁকো ছিল, তারপর হলো কাঠের সেতু, এখন ব্রিজ, শিবমন্দিরটি তেমনই আছে।

সুভাষ বলল, হিমু সেই শ্যামা ভৈরবী আছে?

হিমাংশু বলল, চল শিব মন্দিরে। আমি প্রায়ই আসি এদিকে, কখনো ছেলে মেয়েকে নিয়েও আসি।

ব্রিজ হওয়ায় একটু ঘুরে খালের পাড় দিয়ে হেঁটে মন্দিরে ঢুকতে হয়, মন্দিরের আগে সমাধির মতো কিছু একটা।

এটা কি?

দেবদত্তের প্রশ্নের উত্তর দিল হিমাংশু, এটা শ্যামা ভৈরবীর সমাধি, পাঁচবছর হলো। আমি তৈরি করিয়ে দিয়েছি।

বাপরে! ও কি সত্যই ভৈরবী ছিল নাকি? ভণ্ড একটা!

তুই শিওর হলি কী করে?

যেভাবে ভৈরবী বলে তুই শিওর হয়েছিস, সেভাবে। তা  মরল কী করে?

বন্ধূদের থেকে আসা এই প্রশ্নগুলোকে হিমাংশু হেসে হেসে উত্তর দিচ্ছিল।

তা এখন এই মন্দির চলে কী করে?

দেখবি চল।

মন্দিরের সামনে গিয়ে বোঝা গেলো, উন্নতি হয়েছে। পাকা চাতাল, চালাঘর, বারান্দা। ছোট বাগান, পরিষ্কার উঠোন, চারপাশে বাঁশের বেড়াও  রয়েছে।

বেশ পেশাদারি মন্দির, আগের মতো ছন্নছাড়া ভাব নেই।

কিন্তু থাকে কে? ভৈরবী তো মারা গেছে? তবে কি নতুন ভৈরবী এলো? না এবার স্বয়ং ভৈরব?

ধূমা, ধূমা, হিমাংশু ডাক দিলো।

ভেতর থেকে যে বেরিয়ে এলো, সামনে অত লোক দেখে একটু বিস্মিত হলো, তবে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

কচি মুখ, কিন্তু চুলে জটা রেখেছে, কপালে একইরকম মেটে সিঁদুর, দীর্ঘকায়া, তবে ফর্সা এবং খুব সোজাকথায় সুস্বাস্থ্য রয়েছে, উদ্ভিন্ন যৌবনা যাকে বলে।

শ্যামা ভৈরবীর কন্যা। এখন এখানেই ওর সংসার। আমি একটু সব ঠিকঠাক করে ব্যবস্থা করে দিলাম। গ্রামে একজন ভৈরবী না থাকলে চলে, বল্?

এই প্রথম হিমাংশুর কন্ঠস্বরে একটু অহংকার ও আত্মতৃপ্তি ঝরে পড়ল।

দেবদত্তের মনে হলো এখানে হিমাংশুর অন্য রঙ আছে। ঘরে সুন্দরী স্ত্রী থাকলেও নিচু শ্রেণির মহিলাদের প্রতি সম্ভ্রান্ত পুরুষদের একটু বেশি আকর্ষণ থাকে, একথা কি ফ্রয়েড বলেছিলেন? নাকি কোনোও গল্প উপন্যাসে পড়েছিল? দেবদত্ত মনে  করার চেষ্টা করল।

ধূমা সরবত আনো, গরমে ঘামে সবাই ভিজে গিয়েছি, দেখছ তো! আমার ছোট্ট বেলার বন্ধু গো সব।

হিমাংশুর গলার স্বরে বেশ অধিকার ভাব।

সবাই এ ওর দিকে চাইছে। করোনা পিরিয়ডে এভাবে যেখানে সেখানে সরবত খাওয়া কি ঠিক?

হিমাংশু একটু হেসে বলল, ভয় নেই, এখানে করোনা নেই, বিশুদ্ধ সুস্বাদু ঐশ্বরিক সরবত। ধূমা এ ব্যাপারে পারদর্শী। খেয়ে দেখ।

ছোট ছোট কাচের ক্লাসে সরবত এলো, সঙ্গে একটি জগ। তাতে আরো আছে।

একটু দ্বিধা রেখে সবাই খেতে শুরু করল।

বাহ্! চমৎকার, ধূমা ভালো বানিয়েছে তো!

তিন জগ সরবত শেষ হয়ে গেলো। দেবদত্তের মাথাটা ঝিমঝিম করছে, তবু সে ভাবতে পারছে, এভাবে সরবত খাওয়া ঠিক হয়নি, এটা ভাং জাতীয় কিছু হবে, কারণ উঠোনের এক কোণায় সে ভাংগাছের ঝোপ দেখতে পাচ্ছে।

এরকম সন্ধ্যা বহুদিন পরে এলো জীবনে। থ্যাংঙ্কস হিমু।

শ্যামা দারুণ ছিল দেখতে। কী ফিগার ছিল! এখন পর্যন্ত এরকম ফিগারের মেয়ে দেখিনি।

ধূমাও বেশ সুন্দর। তবে শ্যামার মতো নয়।

না, ওর চেয়েও বেশি, শুধু ডিফারেন্স হলো ব্লাউজ পরেছে, এতে একটু ঢেকে গেছে।

শ্যামা প্রায় খোলা গায় আমাদের সামনে ঘুরত। আসলে মেয়েছেলেটার স্বভাব খারাপ ছিল। নাহলে ওভাবে ঘুরত কেন? দেখিয়ে দেখিয়ে?

তোরা দেখতি কেন? দেখতেই তো আসতিস?

ও তুই বুঝি দেখতিস না?

নাহ্ সবাই দেখতাম।

তোরা একটু চুপ করবি, ধূমার মা শ্যামা, দেবদত্ত হিসহিস করে বলল।

বাহ্ তাতে কি বন্ধু। তুমি তো গ্রামে বসে বেশ মজা লুটছ। ঘরেও সুন্দরী বউ, এখানেও ভৈরবী একজন।

তুইই আসলে সেরা ভৈরব।

বিক্রমের এসব কথায় দেবদত্ত বুঝতে পারছে হিমাংশু এবার রাগবে।

তাই ঈষৎ জড়ানো গলায় সে বলল, এই চাতালটাতে শুয়ে জটা খালের হাওয়া খেতে খেতে আকাশে চাঁদ উঠছে, জীবনে এই দৃশ্য আবার উপহার দেওয়ার জন্য তোকে অনেক ধন্যবাদ হিমাংশু।

হিমাংশু কিন্তু এখনও রাগেনি, খুব ঠাণ্ডা চোখে বিক্রমের দিকে তাকাল শুধু।

চাঁদনি রাতেই বুঝি তোদের অভিসার হয়?

না না, ঘোর অমাবস্যায়। শ্যামা ভৈরবীকেও কি তখন মনে পড়ে রে? আমরা তো এখনো ভুলতে পারি না!

মাইরি আবার গ্রামে চলে আসতে ইচ্ছে করছে। তোর মতো জমিদার হতে মন চায়, নাকি ভৈরব, হি হি, এজন্যই গুরু তোমার চেহারায় এতো চেকনাই, দ্বিতীয় নারী থাকলেই এতো ফুর্তি আসে রে, তুই সবাইকে ছাড়িয়ে গেলি হিমু।

চারপাশে এখন বেশ অন্ধকার। ধূমাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ধূমা কি শিবের মন্দিরে সন্ধ্যা জ্বালাতে আসবে না?

দেবদত্তের গা শিরশির করে উঠল, কারণ হিমাংশু দুই হাতে বিক্রমের কলার টেনে ধরেছে। আশ্চর্য, এতোদিন পর কি আবার ওরা স্কুলের মতো ঝগড়া করবে? এতো তুচ্ছ কারণে?

ধূমাকে খুব দরকার এখন, দেবদত্ত গলা ফাটিয়ে ডাক দিলো, 'ধূমা, ধূমা!’

চালাঘরের দরজা ঠেলে একটি বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে ধূমা বেরিয়ে এলো। হাতে ধূপ ধুনো, প্রদীপ, লম্বা আঁচল লুটিয়ে পড়ছে, কারোর দিকে না তাকিয়ে শিব মন্দিরের দিকে যাচ্ছে সে, যেন কত দেখা এসব, কারা ঝগড়া করছে, কেনই বা করছে! অদ্ভুত মাটির দেহ ধূমার, বৃষ্টি এলে গলে যায়, নতুন ভৈরব আবার সারারাত তাকে তৈরি করে।

রূপক, গৌতম, দেবদত্ত, সুভাষ, বিক্রম, হিমাংশু পাঁচ বন্ধুর মনে হলো, শ্যামা বা ধূমা, তাদের আসলে স্পর্শ করেনি কেউ, হয়তো তাদের স্পর্শ করা যায় না...

অবশ্য এটাও তারা আলাদা আলাদা করে ভেবেছিল, শেয়ার করতে পারেনি, শেয়ার করা যায় না।

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন