কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০

সুবল দত্ত

সমকালীন ছোটগল্প

 


একটি অদৃশ্য কথোপকথন                    

 

-তুমি কে?

-যদি বলি আমি এক স্বয়ংচালিত জৈবিক রোবোট, তুমি কি মানবে?

-বেশ তাই যদি, তবে তোমার হার্ড ডিস্ক কোথায়?

-হার্ড ডিস্ক হলো আমার মন তার অনেকগুলো ড্রাইভ মেন ড্রাইভে দেহ চলে, সংসার চলে কোনোটাতে ফুর্তি আড্ডা টাকাকামানোর ইচ্ছা, কাম প্রেম দয়া দুঃখ কষ্ট ভোগ অনেক এইরকম কিছু এইসব ইন বিল্ট সবার সব ড্রাইভ চলে না আজীবন তবে এই হার্ড ডিস্ক শরীরের ভিতরে কোথাও নেই বরং এর ভিতরেই শরীর মনের ভিতরে আছে দেহ মন দেহের বাইরে দেহ সংলগ্ন

-আর রেম?

-রেম হলো আমার স্মৃতি এটির কিছুটা থাকে মাথায় আর বেশিরভাগ মাথার ওপরে হাওয়ায় সারফেস ইমেজ মাথার কিছুটা ওপরে, শূন্যে একটি অদৃশ্য অব্যক্ত সিডিতে স্টোর থাকে দেহের মৃত্যুর পর মহাশূন্যে মিলিয়ে যায়

-ব্যাস এইই?

-না আর আছে হৃদয় হৃদয় শরীরে থাকে না, মনের ভিতরেও না প্রার্থনা ও সমর্পণে আসে স্মৃতি সার্ফ করলে আসে অন্য কারোর আবেগে নিবিড় হলে আসে সিস্টেম নিজে চাইলে আসে

-তাহলে তোমার স্মৃতি ও হৃদয় নিয়ে এখন তোমার কী হচ্ছে, কিছু বলো  

-এখন অনেক পুরনো আবছা হয়ে আসা স্মৃতি হৃদয়কে শূন্য থেকে ডেকে এনেছে তাই মন আর শরীরে নেই অন্যমনস্ক হয়ে আছে শুনবে? শোনো তাহলে সেই স্মৃতিপাঠ

আমি যখন বছর দশেকের ছিলাম তখন আমার দিদির বিয়ে হয় দিদির বয়েস পনেরো হবে পিঠোপিঠি ছিলাম তাই তার আমৃত্যু তাকে কখনো দিদি বলে ডাকিনি আজ বছর সাতেক হলো গত হয়েছেন জামাইবাবু সাতবছর নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করার পর গতকাল রাত্রে তিনি গত হলেন

দিদির বিয়ের সময় আমার জামাইবাবুর বয়েস একুশ কি বাইশ হবে খুব কম বয়েস বিয়ের পর উনি শ্বশুরবাড়িতে আসতেন তখন আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম ধবধবে সাদা পোশাক গিলেকরা পাঞ্জাবির ক্রিজ ছুরির মত ধার সেই ফর্সা সুদর্শন যুবকটি কখন যে আমার স্মৃতি ও হৃদয়কে একসাথে ওতপ্রোতে বেঁধে দিয়েছিল, আমার মনে নেই আমার দিদি ও দাদাদের সাথে যতটা ফ্রি বোধ করতাম তার চেয়ে অনেক বেশি আমার জামাইবাবুর সাথে আমি ঘনিষ্ট ছিলাম সেসময়ে ফোন ছিল না চিঠি লেখার ধৃষ্টতা পরিবারে আমার মতো ছোটোর কোনো ভাবেই ছিল না শুধু তার স্মৃতিচারণ তাঁর স্নেহ, তাঁর পোশাক থেকে সেন্টের গন্ধ, পুকুরে স্নান করতে গিয়ে তাঁর গায়ে মাখা সাবানের ব্যবহার ও সঙ্গে করে দিদির শ্বশুরবাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবার কথা মা কিংবা বড়দার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া, এইসবের জন্যে আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষা ছিল দিদি শ্বশুরবাড়ি থেকে আসাতে আমার আনন্দ ছিল সেখানেই গ্রামে তিনি যে এক তুলনাত্মক দৃষ্টান্ত ছিলেন সেটা এখনো ভাবলে গর্ব হয় আমাদের গ্রামে অনেক বাড়িতেই তো জামাই আসা যাওয়া করতেন, কিন্তু আমার জামাইবাবু বাড়িতে এলে সারা পাড়ায় সোরগোল পড়ে যেত  উনি বেঁচে থাকতে আমার সাথে যে সব ঘরোয়া আচার আচরণ করতেন, সেসব তখন খুঁটিনাটি মনে থাকতো না সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু আজ সেসব সর্বক্ষণ স্মৃতি থেকে রিউইন্ড করে হৃদয় আমার সামনে উপস্থিত করছে প্রতিটি ছবি অস্পষ্ট হলেও ডিটেলস এতো বেশি আমার মন ভারাক্রান্ত

-এই ভারি মন স্মৃতি হৃদয় নিয়ে কী করবে?

-মনের এরিয়া বিশাল আকাশের মত তাতে স্মৃতিগুলো থাকলে থাকুক পৃথিবীর কিছু যায় আসে না তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কিছু চিহ্ন পরবর্তী বেশ কিছু বছর থেকে যাবে, হয়তো বহুবছর, কিন্তু মানুষের অনুভবে থাকবে না

-এইসব আবেগ স্মৃতি হৃদয়?

-আমার হৃদয়গ্রাহ্য অনুভব স্মৃতি আমার অবর্তমানে আর কি থাকে? কে আর ওই সিডি মহাশূন্য থেকে পেড়ে চালিয়ে দেখবে? সিষ্টেম বাদে কার এত ক্ষমতা?    

-তুমি যদি চাও তো আমি তোমাকে অতীতের তোমার পছন্দমতো এক ক্ষণে নিয়ে যেতে পারি অবশ্য সেই তুলনায় তোমার নিজস্ব ভবিষ্যতের কিছু সময় তোমাকে হারাতে হবে এটা একধরনের আত্মত্যাগের একটা গেম একটা জুয়া হতে পারে ভবিষ্যতের কোনো বিপদ বা দুর্বিপাক এড়িয়ে গেলে তোমার জীবনে যা ঘটত তা ঘটলো না তবে এর উল্টোটাও হতে পারে হয়তো তোমার জীবনের সবচেয়ে সুখময় ও অতি মূল্যবান ঘটমান ঘটনা তুমি হারাবে হয়তো সেই ঘটনা তোমার  জীবনকে অন্য একটা প্রতিষ্ঠার পথে নিয়ে যেতে পারে বলো তুমি কি চাও?

-আমাকে একটু ভাবতে দাও তবে শুরুতে তুমি যে প্রশ্ন করেছিলে আমি সেটা তোমাকেই ফিরে জিজ্ঞেস করছি তুমি কে?

আমার মাথা হঠা শূন্য হয়ে গেল চোখ খুলে দেখলাম আমি শ্মশানের চত্বরে বসে আছি একটু দূরেই আগুনের লেলিহান শিখা অর্ধ দগ্ধ মৃতদেহ এখন সরোষে দাউ  দাউ চারপাশে নিরেট অন্ধকার মড়া পোড়ানোয় মগ্ন যারা তাদের চেহারা অর্ধেক দৃশ্যমান তাই আত্মীয় কে কে চিনতে কষ্ট হচ্ছে আগুনের ফুলকি ও আকাশের নক্ষত্র মিলেমিশে একাকার আমাকে যিনি সংসার ও সাধারণ জীবন যাপন থেকে সরিয়ে অন্য এক মায়ার জগতে বিচরণ করার এক অবিচ্ছিন্ন পার্টনার করে রেখেছিলেন, তাঁর দেহ এখন ওই চিতার আগুনে পুড়ছে আমি এখন একা একাই ক্ষণে ক্ষণে অফ অন অফ অন অফ অন হচ্ছি শ্মশানযাত্রী সবাই জানে আমি সবসময় ঘোরে থাকি স্বতন্ত্র বিন্দাস তাই আমাকে একাকী বসিয়ে রেখেছে এখন আমার হুঁশ ফিরেছে, যেমন আগেও হতো তেমনিই, কিন্তু আজ একটু আলাদা মুখের ভিতরে নোনা স্বাদ না এটা হ্যাশ বা এল এস ডি মারিজুয়ানার জন্যে নয় চোখে হাত বুলিয়ে দেখলাম ভেজা ভেজা তবে কি এই সৃষ্টি ছাড়া ঘোরের জগতে একা থাকার উত্‍কন্ঠায় চোখে জল? এইভাবেই তো হেসে খেলে এক চুটকিতেই কাটিয়ে দিলাম সাত সাতটা বছর? সেই শুরুর দিনটা যেন হাত বাড়ালেই পেড়ে আনতে পারি অতীত থেকে সেই শুরুর দিনটা? ঠিক এমনি করেই শ্মশানের এইই চত্বরেই জামাইবাবু কাগজের মোড়ক খুলে হেরোইনের একটু সাদা গুঁড়ো একটা চকচকে রূপোলী কাগজে ঢেলে সেই রূপোলী রাংতা কাগজের নিচে লাইটারের আগুন শিখা রেখে দম ভরে আমাকে শ্বাস নিতে শেখালো আমি এক লাফে তাঁর হাত ধরে এই ধুমিল জগতে পা রেখেছিলাম আমাদের সামনে এমনি করেই আমার দিদির লাশ দাউ দাউ করে জ্বলছিল আমি জামাইবাবুর কাছে শিখছিলাম এক ভিন্ন যাপন মাত্র পনেরো বছর সঙ্গ দিয়ে ভরা যৌবনের আফসোস গলায় বেঁধে সিঁদুরে সিঁথি লাল করে আমার দিদি পঞ্চভূতে বিলীন হচ্ছিল আর আমি এই সর্বনাশা পথে পা বাড়িয়েছিলাম

আবার আমার চেতন খাবি খেতে লাগছে হোঁচট খাচ্ছে আমার শ্বাস পকেট হাতড়ে কাঁপা হাতে কাগজের মোড়ক বার করলাম সময় আমার জানা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি এখন সেকেন্ড মিনিট ধরে নির্ভুল সময় এই নেশা আমার অস্তিত্ব জর্জরিত করে ফেলেছে ঠিকই কিন্তু আমার শরীরের অর্বুদ অর্বুদ জীবন্ত কোষ ঘড়ি আমাকে নির্ভুল সময়ের জ্ঞান দেয় অবশ্য এটা শরীরেরই চাহিদা এই সময়ে আমার একটি কালো মার্বেল সাইজের গুলি মুখে ফেলে চুষতে হবে আমি ওই কালো লজেন্সের রাপার খুলে জিভে নিতে গিয়ে থমকে গেলাম আমার জিভ আগ্রাসী ঠোঁট তালু মুর্ধা গাল সব কাঁপছে ওই গুলি গ্রাস করতে কিন্তু মুখে নিতে গিয়েই আমার ওই হ্যালুসিনেশনের কথা মনে পড়ে গেল আমার মতই হুবহু চেহারার একজন একটু আগেই আমাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছিল ও দেখতে একেবারেই আমার মিরর ইমেজ কিন্তু উজ্জ্বল ধবধবে সাদা উলঙ্গ গা থেকে জ্যোতি বেরচ্ছিল শেষে  আমার সাথে একটা কন্ডিশন রেখেছিল, ওটা আমার মনে ধরেছে বেশ যুক্তি কিন্তু আমি যে ওকে বললাম তুমি কে, উত্তর পেলাম না যে? কিন্তু আমার মন বলছে ও আবার আসবে এদিকে চিতার আগুন যেন প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে আমি  জোর করে কালো হ্যাশ গুলি মুখের ভিতরে ঠেলে দিতে চাইলাম, কিন্তু বাধা দিচ্ছে কে? কে আমার হাত ধরে আছে? ভালো করে অন্ধকারের ভিতরে আগুনের  পটভূমিকায় দেখলাম আমার উচ্চমাধ্যমিকের অংক স্যার উনি এখানে কী  করছেন? এই দীর্ঘদিনের ব্যবধানেও উনি তেমনিই আছেন দেখছি হাতে দেখছি থিওরী অফ প্রব্যাবিলিটির বই বইটির দিকে তাকাতেই আমার সব কিছু মনে পড়ে গেল উনি স্মিত হেসে একটু সরে আমার পাশে এলেন দেখলাম আমার প্রিয় বইগুলি নিয়ে কয়েকটি বন্ধু দাঁড়িয়ে ঝাঁ করে আমার সমস্ত পাঠক্রম মনে পড়ে গেল কোন বিষয়ের উপর গবেষণা করার আমার তীব্র ইচ্ছা ঠিক এই সময়টিতে একটা অভেদ্য বর্মের মত পূর্ণচ্ছেদ আমার জীবনে নেমে এসেছিল আমার ঘর পরিবার ছেড়ে লেখাপড়া জলাঞ্জলি দিয়ে চলে আসতে হয়েছিল দিদি জামাইবাবুর কাছে সেখানে অসুখী দিদির সেবা ও ব্যভিচারী জামাইবাবুর মনোরঞ্জন তারপর সর্বগ্রাসী নেশা মাষ্টার মশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার যেন মনে হলো আমি অবচেতন মন থেকে সত্যিই অতীতের এই সময়ে ফিরতে চাইছিলাম? সমস্ত কিছুর বিনিময়ে? এটাই কি আমার সেই আচ্ছন্ন অবস্থায় ওই মানুষটির শর্ত? তাহলে তাই হোক ভবিষ্যতে আমি যদি সর্বসান্তও হয়ে যাই, গৃহহারা অন্ন ও ছন্নছাড়া যাই হই না কেন, অতীতের এই বহুমূল্য সময়টি যদি সত্যিই এসে থাকে, আমি কোনমতেই হারাতে চাই না দেখলাম চিতার আগুন নিবু নিবু আমার দিদি যেন আগুনে কিশোরী দিদি হয়ে চিতা ছেড়ে আমার দিকে দুহাত বাড়িয়ে দৌড়ে আসছে আমার রাজা ভাই, আমার সোনা ভাই দেখলাম মাষ্টারমশাই আমার পকেট হাতড়ে নেশার সবকটি ওষুধ বের করে আমার হাতে দিয়ে বলছেন, ‘এগুলো আগুনে বিসর্জন করে দিয়ে এসো, আমি তোমাকে পুনর্বাসনের মন্ত্রপুত করব

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন