কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০

ময়ূরিকা মুখোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প



লাল রেডিও     


বছর তিনেক হলো অনিমেষ চাকরি জীবন থেকে অবসর নিয়েছে। ভয় ছিল,  তারপর থেকে হয়তো বাড়িত বসে থাকতে থাকতে খিটখিটে বুড়ো হয়ে যাবে… সেই আশঙ্কা করেই, পরিচিত একজনের রেফেরেন্সে একটা প্রাইভেট ফার্ম-এর অ্যাকাউন্টস্ সামলাচ্ছিল ইদানিং কালে।

কিন্তু… তাতে ছেদ পড়লো। এ যাবৎ অচল অবস্থায়। চারপাশ বুঝে শুনে, বুড়ো হাড়ের ভেল্কি দেখার রিস্ক আর কম্পানি নিল না। তা বাঁচা গেছে একদিকে…

ভাগ্যিস… ওরা জবাব দিয়ে দিয়েছে, নয়তো এতগুলো বছর ট্রেন বাসের ভিড় ঠেলে এই শেষ বয়সে এসে ওয়ার্ক ফর্ম হোমের জঘন্য ফাঁদে পড়তে হতো! মনে মনে ভাবে অনিমেষ।

চাকরিটা নেহাৎ শখেই করতো অনিমেষ। অবশ্য যদি কারণ কিছু দেখাতেই হয়   তাহলে অবশ্যই প্রথমে আসবে রোজকার অফিস যাওয়ার পথে ট্রেনের আড্ডাটা। ওই একটা টানের কাছে, নটা-ছটা-র অফিস টাইম আদপে কিছুই ছিল না।

জীবনে কোনওদিন এত অবসর আসবে সম্ভবত ভাবেনি অনিমেষ। ইদানিং, কিছু অদ্ভুত অনুভূতি হয় অনিমেষের। এই জীবনে কোনওদিন নিজের হাতে ভাতের  ফ্যান গালতে হবে, একা হাতে বেড়ে খেতে হবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি সে।

প্রথমদিকে মা, আর তারপরে আবীরা… 

সারাজীবন হাতে হাতে সব কিছু এগিয়ে দিয়ে গেছে।

আবীরা…

অনিমেষের স্ত্রী। এই, মে মাসের আঠেরো তারিখ ওদের পঁয়ত্রিশ বছর পূর্ণ হবে।

দুপুরে শোয়ার অভ্যাস কোনোদিনও ছিল না অনিমেষের। ছুটিছাটার দিনে পেপার  পড়েই কেটে যেত বেশীরভাগ সময়। আর এখন তো…

এখন, সবে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়েছে। আজ কীভাবে যেন দুপুরের দিকে একটু চোখ লেগে গেছিলো আনিমেষের। তাই ছাদে উঠতে একটু দেরীই হলো।  অবশ্য, তাতে কারোর খুব একটা কিছু যায় আসে না। এ ছাদ থেকে ও ছাদের বৈকালিক আড্ডাটা শুধু বাদ পড়ে গেলো। এই বন্দীদশায় এইটুকুই সম্ব্ল।

পঁয়ষট্টি বছরের এই জীবনে বোধহয় এই প্রথম, ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হলো অনিমেষের…

এতদিন… নাহ্ সময় হয়নি তা নয়! আসল কথাটা হলো প্রয়োজন পড়েনি।

বিকেলের দিকটায় হাঁটতে এসে অনিমেষ খেয়াল করেছে যে, সূর্যাস্ত হওয়ার আগে হঠাৎ করে চারপাশটা কেমন অদ্ভুত আলোময় হয়ে ওঠে। এ যেন সেই প্রদীপের নিভে যাওয়ার আগে হঠাৎ করে জ্বলে ওঠা। আর সেই অদ্ভুত আলোর মায়ায় ছাদ থেকে নীচে নেমে আসে অনিমেষ। ডাইনিং হলের আলো না জ্বালিয়ে চুপচাপ আবীরার ছবির সামনে এসে দাঁড়ায়। বাইরের নিভে যাওয়া গোধূলিতে অনিমেষের হাল্কা একটা প্রতিচ্ছবি এসে পড়ে, সামনের বাঁধানো ছবির ওপর।  

ভেতরে একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা অনুভব করে অনিমেষ। কোনওদিন এরকম হয়নি ওর। আবীরা চলে যাবার পরেও হয়নি…

একটা মানুষের থাকাটাকে যেমন এতদিন অভ্যাস করে এসেছে, সেরকমভাবে না থাকাটাকেও অভ্যাস করে নিতে শিখছিল একটু একটু করে।

সামনের রাখা সোফাতে খানিক বসলো অনিমেষ। বাইরের অন্ধকার আস্তে আস্তে ভেতরের অন্ধকারকে বাড়িয়ে তুলছে। আজ নিজের অজান্তেই কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছে অনিমেষ।

বাইরের স্তব্ধ শহরটার সঙ্গে নিজের বড় মিল খুঁজে পেল অনিমেষ। অবশেষে, এই সব অবিন্যস্ত ভাবনার অবসান ঘটলো, ফোন-এর রিংটোনে। এই সময়ে  প্রতিদিনই প্রায়, অভ্র ফোন করে, পুনে থেকে। অভ্র, অনিমেষ আর আবীরার একমাত্র ছেলে। পুনেতে আপাতত সস্ত্রীক পাকাপাকি বাস। সন্ধ্যের দিকগুলোতে প্রায়ই কথা হয়। ছেলের শাসন, বারণ শুনতে বেশ লাগে তার। তবে তা প্রকাশ করে না। এই ছেলের তত্ত্বাবধানেই এই কঠিন সময়দগুলোতে বাজার-হাট, দোকান পাতি সবই পৌঁছে যায় দোরগোড়ায়। কিন্তু, এই সন্ধ্যে র সময়টা কিছুতেই যেন  কাটতে চায় না অনিমেষের। সারাজীবন, সন্ধ্যেবেলা কাটিয়েছে নিতাইয়ের চা-এর দোকানে, কিংবা ক্লাবে তাসের গোছায়। এখন সে সবও বন্ধ।  কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে খবরের চ্যানেল ঘোরাচ্ছিল অনিমেষ। হঠাৎ চোখ চলে গেল দেওয়ালের ঝুলগুলোয়। স্থিরভাবে একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে মনে হল, এই ধূলোর আস্তরণ গুলো কীভাবে যে ঘ্যাঁট হয়ে বসে থাকে একটা সাজানো সংসারের আনাচে-কানাচে!

একসময়, রবিবার, বাজার করা ছিল, অনিমেষের কাছে নেহাৎই শখের। ফিরে এসে প্রায়ই দিন দেখতো, খাটের ওপর উঁচু টুলে উঠে আবীরা ঝুল ঝাড়ছে। রেডিও বা ক্যাসেটে হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত, নয় সন্ধ্যা অথবা আরতি। আচ্ছা, একবারের জন্যও অনিমেষ তো বলতে পারতো যে, তুমি বাজার যাও, বাকি ঝাড়াঝুড়ি, আমি করছি… কই, বলেনি তো কোনওদিন!

অর্ধেক পড়া কাগজে মুখ ঢুকিয়ে হয়তো প্রকাশ্যেই সে সব এড়িয়ে চলেছে।

কিন্তু, কেন? নিজের মনকে প্রশ্ন করলো অনিমেষ।

আকাশ-কুসুম ভাবতে ভাবতে কখন যে শোকেস-টার কাছে চলে এসেছে, নিজেও টের পায়নি। ইচ্ছে হলো, কাচের পাল্লাটা একবার খুলে দেখে। দীর্ঘদিন, অব্যবহারের ফলে, বেশ জোর খাটিয়ে খুলতে হল। ওপরে আর নীচে ভর্তি আবীরার বই। শাড়ি-গয়নার থেকেও, আবীরার বইয়ের নেশা ছিল বেশী। মাঝের  তাকটাতে মাঝ বরাবর রাখা আবীরার সেই লাল রেডিওটা। ছেলের প্রথম মাইনেতে মা’কে কিনে দেওয়া প্রথম উপহার। বড় ভালো গান গাইতো আবীরা। বিয়ের পর, অষ্টমঙ্গলার সময়, জেনেছিল সে কথা। কিন্তু কোনোদিনও শুনতে চাওয়া হয়নি সে গান। তাই হয়তো সেই গান সুর তালেদের অনিমেষের রান্নাঘর ছাড়া আর কোথাও ঠাঁই হলো না। রেডিওটা হাতে নিয়ে নড়াচড়া করে দেখছিল অনিমেষ। এটার বয়স প্রায় বছর ছয়-সাতেক হবেই। যত্নের অভাব স্পষ্ট। এ ভারী পছন্দের জিনিস ছিল আবীরার। ভারী খুশি হয়েছিল এটা পেয়ে।  কিন্তু অনিমেষের মনে হল, এই রেডিওটা যেন হঠাৎশ অভিযোগের আঙ্গুল তুলছে তার  দিকে। সে জানতো, গান নিয়ে আবীরার এগোনোর ইচ্ছের কথা… কিন্তু তাও, একবারও অনিমেষ এ ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন করেনি এতগুলো বছরে। একবার, একবার অন্তত জিজ্ঞেস করাই যেত…

নিজের প্রশ্নের জালে নিজেকেই খুব অসহায় মনে হচ্ছিল অনিমেষের। সত্যিই  তো মাসের পাঁচ-ছয় তারিখে, মাইনেটা হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া আর করেছেই বা কী? এতদিন, এতগুলো বছর, শুধু নিয়মের বেড়াজালে নিজেকে আটকে রাখা ছাড়া, আর সেরকম কিছুই করা হল না। দু’বছর বা বছরে একবার ঘুরতে যাওয়া, ছেলের জন্মদিনে, ভাল-মন্দ খাওয়া, পুজোর সময় একটু হাত খুলে খরচ, এই সব কিছু বোধহয়, সেই নিয়মেরই অংশ। অথচ… অথচ, কিছু প্রশ্ন করার দরকার ছিল… সেই মানুষ টা কে, যার, ফোন বুক খুঁজলে, জল এর প্লাম্বার থেকে শুরু করে, পুরোহিত পর্যন্ত, সবার নাম্বার পাওয়া যাবে। প্রশ্ন করা উচিৎ ছিল, যে, তুমি ভালো আছো তো?

রেডিওটাকে টেবিলে রেখে মাঝের তাকটার এদিক ওদিক দেখছিল অনিমেষ।  ছেলের ছোটবেলার মাদুলি থেকে শুরু করে অভ্রর উচ্চমাধ্যমিকের পর ঘুরতে যাওয়া সিমলার ছবি… সবকিছুই খুব যত্ন করে রাখা। কেন এগুলো এভাবে বাঁচিয়ে রেখেছিলে আবীরা? আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য বুঝি? নিজের মনেই প্রশ্ন-উত্তরের খেলা চলে অনিমেষের।

কিছুটা শান্ত হয়ে ধীর পায়ে রেডিওটা প্লাগ ইন করলো। হয়তো অন্য কিছুই আশা করেছিল। কিন্তু খানিক বাদে ওদিক থেকে ভেসে এল আবীরার কন্ঠস্বর। আবীরার গলার গান।

গলা ধরে এল অনিমেষের। যে কন্ঠস্বর একসময় দাপিয়ে বেড়াতো সমস্ত বাড়ি…  স্রেফ সময়ের খেলায় সেটা এ ভাবে অতীত হয়ে যায়? এভাবে? একটা আদ্যপান্ত গোটা মানুষ চলে যায় তাহলে? ভারী কষ্ট হল অনিমেষের। হঠাৎ মনে হল, মানুষের মৃত্যুর পর ওই ছবি কেন্দ্রিক হয়ে যাওয়াটা যেন একটা দায়। জোর করে মনে রাখার একটা খুব সাবধানী পরিকল্পনা।

আবীরা, এত ভালো গান গাইতো বুঝি…

এলোমেলো ভাবতে ভাবতে অনিমেষের একবার হঠাৎ মনে পড়লো যে, অভ্র একবার গীটার বাজিয়ে ওর মা’কে নিয়ে কয়েকটা গান রেকর্ড করিয়েছিল। তাহলে এইগুলোই কি সেই…

আস্তে করে উঠে এবার অনিমেষ, ধীর পায়ে, আবীরার ছবির দিকে এগোলো। বাইরের হাহাকার অন্ধকার যেন অনিমেষের চোখে-মুখে জোর করে চেপে বসছে। বুকের বাঁ দিকের কিন্-কিনে যন্ত্রণাটা যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে বুক ঠেলে…

আবীরার ছবির কাছে পৌঁছোনোর আগেই নিজেকে আর সামলাতে পারলো না অনিমষ। সোফার বাঁ দিকের হাতলটা ধরতে যাওয়ার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো অচেতন হয়ে।  

ওদিকে লাল রেডিওটাতে ক্লান্তিহীন ভাবে বেজে চলেছে আবীরার গান। অনিমেষ ধূসর ভাবে কল্পনা করলো, ওদের রবিবারের রান্নাঘর। বিড়বিড় করে বলতে চেষ্টা করলো, ‘কই গো! চা টা দাও!’ বলা হল না অনিমেষের। আবীরাও গান থামালো না।

 


2 কমেন্টস্: