কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬

তমাল রায়

দু:সময়

মতিউর রহমান ওরফে অরুদ্ধ আর নেই। খবরটা এসেছে একটু আগেই। লোকাল পোলিস স্টেশন থেকে খবরটা জানানোর আগেই জেনে গেছিল সবাই টিভির দৌলতে। বড় ভাইসামিউর রহমান ওরফে অতন্দ্র খবরটা দিয়েছিল তার স্ত্রী নাফিসাকে। নাফিসা কী বলবে কিছু বুঝে না পেয়ে চুপচাপ বসেছিল অনেকক্ষণ। কেবল একবার সে এই বিষয়টা বলব কি বলব না ভেবে আব্বুকে জানালো। এখন আব্বুর ফোন করার ঘটা। নাফিসা আর ফোন ধরছে না, কারণ সামনে শাশুড়ি বসে এখন রমজান  মাস। ইফতার রেডি করে টেবিলে রাখা মাগরিবের আজান হয়ে গেল। লেবুর শরবত আর খেজুর খেয়ে নামাজে দাঁড়াবেন মতিউর-এর আব্বু, জিয়া হায়দার, ইতিমধ্যে পুলিশের লোক হাজির     

সন্ধ্যে সাতটা:-

নামাজ পড়া আজ হয়নি জিয়া হায়দারের। অতন্দ্রর ছেলেটা, ছমাস বয়স, অন্যদিন কেঁদে ককিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে, আজ সেও চুপ। এ বাড়িতে এখন কোনো শব্দ নেই আর। দু’ একজন অত্যুৎসাহী উঁকি ঝুঁকি মারেনি তা নয়, তবে দূর থেকেই। রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা। টিভির দিকে তাকিয়ে লোকজন খুব সিরিয়াসলি কিছু আলোচনা করছে। কিন্তু সেও নিচু গলায়। একেবারে নতুন বাড়ি না, আবার খুব পুরনোও না। তবে টিকটিকি আরশোলার আর নতুন বা পুরনো! দুটো টিকটিকি মারামারি করতে পড়ল বাসনের র‍্যাকে, কেটলিটা ঝোলানো ছিল, সেটা পড়ল মেঝেতে। কাঁই কাঁই করে একটা আওয়াজ খানিকটা অনুরণন ছড়িয়ে থেমে গেল, আবার সব চুপ।

রাত আটটা:-

মতিউরের মা, সেন্সলেস। নাফিসা চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে। এখনো চোখ  খোলেনি। বাড়ির সামনে টিভি ক্যামেরার ভীড়, বুম হাতে দাঁড়ানো রিপোর্টাররা ঠেলাঠেলি করছে। পুলিশ আপাতত এ বাড়ির দখল নিয়েছে। ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া যাবে কিনা সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি, ওপর মহল থেকে। অতন্দ্র এখন রওয়ানা দিল পুলিশ জিপেই লোকাল থানায়। নাফিসার চোখের নিচে ভাঁজ, অতন্দ্র বেরোনোর আগে কী যেন বলতে গেল, কিন্তু স্বর বেরোলো না।

রাত নটা:-
টিভি চ্যানেলগুলো বাড়িতে এখনো এন্ট্রি পায়নি। তাই প্রতিবেশীদেরই ফুটেজ নিচ্ছে। এমনিতে টিভি ক্যামেরায় মুখ দেখাতে পারার জন্য যারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তারাও অধিকাংশই এড়িয়ে যাচ্ছে। যারা বাইট দিচ্ছেন তারাও খুব সতর্ক। সকলেই বলছে মতিউর ভদ্র সভ্য উচ্চশিক্ষিত বলেই তারা জানতো। অতন্দ্রর ছ’মাসের ছেলেটা কাঁদছে, কিন্তু গলা খুব ক্ষীণ। এখন এ বাড়িতে রাতের খাবার সময়। রাত থাকতে উঠতে হয়। রাত তিনটের মধ্যে সব খাওয়া দাওয়া শেষ করতে হবে। তারপর আবার নামাজের প্রস্তুতি। আজ সন্ধ্যেতে শেষ রান্না হচ্ছিল চিকেন কষা, সেটা পুড়তে পুড়তে যখন পুরো খাক, নাফিসা গিয়ে গ্যাস নিভিয়ে আসে। টিভি ও বেতারে স্বরাষ্টমন্ত্রী দু:খ প্রকাশ করেছেন নিহতদের জন্য। জানিয়েছেন, মার্কিন কনসাল  জেনারেলের সাথে তাঁর কথা হয়েছে। তাঁরা সর্বত ভাবেই মার্কিন প্রশাসনের পাশেই আছেন। তদন্তে সবরকম সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। 
রাত দশটা:-

অতন্দ্র ফেরেনি এখনো জিয়া হায়দারকেও পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে, কেবল ওই সময়টাতেই মতিউরের মার জ্ঞান ফিরেছিলো। তিনি বহুবার আছাড়ি পিছাড়ি খেয়েছেন পুলিশকর্তার পায়ে, কেন অহেতুক বুড়ো মানুষটাকে কষ্ট দিচ্ছেন? পুলিশ ছিল কর্তব্যে নিষ্ঠাবান দৃকপাত না করেই বেরিয়ে গেছেন জিয়া হায়দার কেবল বেরুনোর সময় মাথায় ফেজ টুপিটা পরে নিয়েছেন কাঁধে ঝোলাব্যাগে হাদিস কাজে লাগে অসময়ে টিভি চ্যানেলের লোকগুলোর সংখ্যা কমেছে ভাবলে ভুল তারা আশপাশের বাড়ির দোতলার জানালা বা ব্যালকনিতে ক্যামেরা সেট করে রেখেছে মুশকিল হলো  এ বাড়িতে ঘরের বাইরে আসার তেমন আর কেউ নেই কেবল পোষা বেড়াল লাভলিন নিশ্চিন্তে হাঁটছে বারান্দায়, হাই তুলছে বসে পা তুলে জিভ ঘষছে

রাত এগারোটা:-

টুইট করেছে সি আই আই এসের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। পুরো ঘটনার দায় তারা নিয়েছে। সতর্কতা জারি হলো সমস্ত সেনসিটিভ স্থানে, মায় শপিং মল, স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড আরও কিছু ভি ভি আই পি এলাকায়। রাস্তা শুনসান। মতিউরের মা’র জ্ঞান একবার ফিরলে তিনি বার বার বলছিলেন – ‘বুড়া মানুষটাকে এবার ছাইড়া  দাও প্লিজ! ও কিছু করে নাই’বাইরে বৃষ্টি এলো। টিভি ক্যামেরার ওপর ছাতা  ধরল ক্যামেরাম্যানের সহকারী। নাফিসার মা চারবার ফোন করে না পেয়ে, অতন্দ্রকে ফোন করেছিলেন। অতন্দ্রর ফোন সুইচড অফ। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। গুটিকয় কোলা ব্যাংও। কদিন ধরে একনাগাড়ে বৃষ্টি হওয়ায় পাশের পুকুরে পানি জমেছে যে! টিভিতে  বারবার ভেসে উঠছে স্পেশাল বুলেটিন। বিশেষজ্ঞের মতামত দিচ্ছেন র‍্যাব-এর  প্রশিক্ষক ও সেনাবাহিনীর কমান্ডাররা। বাড়িতে সার্চিং শুরু করল এবার পুলিশ, সাথে যোগ দিয়েছে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম। লাভলিনের এত অপরিচিত লোক অপছন্দ। সে চোখ বড় করে খুব বিরক্তিতে দেখছে ওদের মতিউরের মা’র পাশে শুয়ে।

রাত বারোটা:-

জিয়া হায়দার, অতন্দ্র ফেরেনি, চিকিৎসক নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় পুলিশ, ওনার জ্ঞান ফেরাতে হবেই যে কোনো ভাবে, জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করতে দেরী হয়ে যাচ্ছে। পুলিশের বড় কর্তারা দু’ভাগে বিভক্ত। একভাগ থানায়, একভাগ এ বাড়ির দালানে চেয়ার পেতে বসে। টিভি চ্যানেল ওনাদেরই একবার ক্লোজ ও একবার লং শটে ধরছে। গলির মোড়ে শেষ দোকানটা বন্ধ করার মুখে পান খাচ্ছিলো যে লোকটা, সে একবার বলার চেষ্টা করল - আমেরিকাই কালপ্রিট! পুলিশ টহল দিচ্ছে, চুপ করিয়ে দিল দোকানী। আসলামভাই বাসায় যায়েন। রাত হইসে অনেক। অতন্দ্রর  ছেলেটা মার কোলে ঘুমাতে ঘুমাতেই চমকে উঠছে। কে জানে কেন! আবার বাসনের আওয়াজ। টহলদার পুলিশ এলার্ট হলোকে জানে কী আছে ভেতরে!

রাত একটা:-

জিয়া হায়দার, অতন্দ্র ফেরেনি। মতিউরের মার জ্ঞান ফিরেছে। মার্কিন কনসাল  জেনারেল প্রেস কনফারেন্স করছেন। টিভি ক্যামেরা এবার মতিউরদের জানালায় মা কাঁদছেন আর বলছেন - জীবনে একখান লাঠিও ধরেন নাই অরুদ্ধর আব্বু। প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টার ছিলেন তো! এই ছেলে যখন আমেরিকা গেল, কী গর্ব আমাগো! বিক্রমপুরের, এই ব্রজযোগিনীর আরেক পোলা বাইরে গেসিল, অতীশ দীপঙ্কর আমাগো অরুদ্ধ তেলাপোকা দেখলে ভয় পাইতো, আল্লাহ কেন  এমন হইল? কী গুনাহ করছিলাম আমি? পুলিশ অফিসারের দৃষ্টি স্থির, রেকর্ডার  অন বাইরে বৃষ্টি এলো ক্যামেরার ওপর ছাতা ধরছে সহকারী নাফিসার ওয়াশরুম যাওয়া দরকার অনেকক্ষণ, কিন্তু প্রবল ভয়ে পা সরছে না কথাও
     
নিউ অর্লান্ডোতে তখন রাত একটা হবে চার্চের স্পেশাল প্রেয়ার শেষে ছিল ডিনার।  গাড়িগুলো একে একে বেরুচ্ছিলো। নিউক্লিয়ার সায়েন্সের রিসার্চ ফেলোশিপ করা বিক্রমপুরের মতিউর সে পার্টিতে নিমন্ত্রিত কিনা, জানা যায় না তবে তার এলোপাথাড়ি গুলিতে প্রায় ৭০জন মার্কিন নাগরিক নিহত আর হাইওয়ে পেট্রোলে থাকা মার্কিন পুলিশের হাতে নিহত মতিউর
     
জিয়া হায়দার, অতন্দ্র ফেরেনি ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে মতিউরের মা আবার জ্ঞান হারিয়েছেন, নাফিসার ওয়াশরুম যাওয়া হয়নি, অতন্দ্রর ছেলেটা চোখ পিট পিট করে দেখছে
লাভলিন দালানে এসে এক পা তুলে পেচ্ছাব করল কার দিকে, কে জানে!



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন