জুতোবদল
ছোটবেলায় একটা দুষ্টুখেলা ছিল আমাদের। মন্দিরে
গিয়ে দরজার বাইরে খুলে রাখা চটি জুতোর মধ্যে নিজেরটা খুলে রেখে অপর যে কোনো একজোড়া পায়ে গলিয়ে চলে এসে হাসতে থাকা। পরে বড় হয়ে যখন ইংরাজির ‘স্টেপ ইনটু আদার্স সু’-এর
মানে বুঝলাম, ততদিনে একটু আধটু কবিতা চর্চা শুরু হয়েছে আমাদের। প্রথমেই টার্গেট
করলাম রবীন্দ্রনাথের জীবনী, ভাগ্যিস তিনি বেঁচে নেই তখন, ধরা পড়ার ভয়ও নেই! কী জীবন! রূপোর চামচ মুখে জমিদারের ঘরে জন্ম তো আর হলো না, অষ্টম গর্ভে জন্মাইওনি। বরং তাঁর মতো কবিতা লেখা সোজা মনে হলো। নোবেল
প্রাইজ, বিদেশ ভ্রমণ, দেশে কত কাদম্বরী-প্রতিমা-রাণু-মৈত্রেয়ী – আমাদের কিছুই কি হবে না?
ছড়া দিয়ে শুরু করে ক্রমশ ছড়িয়ে যেতে থাকলাম আমরা।
প্রতি রবিবার সবাই এক জায়গায় বসে পড়ি, সবার পিঠ চুলকাই। ধীরে
ধীরে, ওই আর কী, ছন্দ রপ্ত করে, শব্দকে নরম করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বন্ধুরা বলছে দারুণ লিখছিস! সিনিয়াররা বললেন টুকলি করছ! রবীন্দ্র ভক্তরা
দুয়ো দিলেন। মেয়েরাও প্রেমে পড়ল না। আমাদের মধ্যে কমলই ছিল লিডার। শেষে কমল, তখন বছর পঁচিশেক, দাড়ি রাখা
আর গান বাঁধা শুরু করল। সেই গান আমরা সমবেত কন্ঠে নানা জায়গায়। তাও একসময় ছেড়ে গেল
সুরের অভাবে। কিন্তু কমলের দাড়ি আর থামল না। কমসে কম রবীন্দ্রনাথের মতো দাড়িই সই।
সে কী কম বিড়ম্বনা? ভাগ্যিস সে জোব্বাটা ধরেনি!
যাইহোক, তাঁর মতো কবিতা আর গান না হয় হলো না, কিন্তু প্রেমে পড়ার কোনো বয়স হয় নাকি? কীই বা বয়েস আমাদের? এত হতাশ না
হলেও চলবে। চল, শান্তিনিকেতন নাম্বার টু বানানো যাক। খোদ শান্তিনিকেতন ঘুরে এলাম
বার কয়েক। সেই ভাবনা পুষে রাখলাম দীর্ঘকাল। মনস্থির করে অতীতের ভুবনডাঙ্গার মাঠের
মতো পাথুরে নির্জলা টাঁড় জমি সংগ্রহ করলাম পুরুলিয়া জেলায়। গাছ পুঁতলাম, গাছের পর
গাছ। ক্রমশ আশ্রম, স্কুল, বনসৃজন, মেলা, পশুপালন, দাতব্য চিকিৎসালয়, লাইব্রেরি,
মেডিকাল ক্যাম্প, বাসস্থান, বাচ্চাদের আদিবাসী সংস্কৃতির শিক্ষা, সব হয়েছে সেখানে।
নাম দিয়েছি ‘ভালোপাহাড়’। সব মানুষের দানে, মানুষের ভালবাসায়। কমল আজ বুড়ো হয়েছে, দাড়ি পেকেছে। রবীন্দ্রনাথের জুতোটা তার পায়েই টিকে আছে
আজও।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন