কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৩

০১ সুজিৎ মুখোপাধ্যায়

কানাই রহস্য
সুজিৎ মুখোপাধ্যায়




(চরিত্র : কয়েকজন গ্রামবাসী, পাগলা নিতাই, মোড়ল, ননী দারোগা, কনস্টেবল রামশরণ)


(সকালবেলা। গ্রামের চায়ের দোকানে কয়েকজন গ্রামবাসী চা খেতে খেতে কথা বলছে। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে আর এক গ্রামবাসীর প্রবেশ)

প্রথম দৃশ্য

প্রথম :
তোমরা শুনেছ, গতকাল রাত্তিরে মদন চক্কোত্তির বাড়িতে চোর এসেছিল?

দ্বিতীয় : সব নিয়েছে ঝেড়েপুঁছে, নাকি পরের বারের জন্য কিছু রেখেছে?

তৃতীয় : যা বলেছো, এতো দেখছি নিত্য দিনের খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে!

দ্বিতীয় : এই নিয়ে পরপর তিনদিন চুরি হলো। প্রথম দিন কুমোর পাড়ায় দিনুর বাড়িতে, তারপর শম্ভুদের বাড়িতে, আর কাল হলো মদনের বাড়ি।

প্রথম : ওঃ বেচারা দিনুর সে কী কান্না! মেয়ের বিয়ের জন্য সব কেনাকাটা করে রেখেছিল, সকালে উঠে দেখে সব পরিষ্কার।

দ্বিতীয় : আমার কী মনে হয় জানো, এ কম্মো কোনো একজনের নয়। এত ঘন ঘন একটা চোর চুরি করতে পারে না। হজম করতেও তো সময় দরকার!

তৃতীয় : কেন? কেন পারে না? বেশ পারে। এসব হলো গিয়ে কানাইয়ের কাজ!

প্রথম : ঠিক বলেছ। এমন বুকের পাটা কোনো সাধারণ চোরের হবে না।

দ্বিতীয় : এই শুরু হলো! যত্তোসব গাঁজাখুরি গল্প!

তৃতীয় : চুপ করো তো পরেশ! তোমার ঐ নাস্তিকদের মতো সবজান্তা ভাব আমার একটুও ভালো লাগে না।

দ্বিতীয় : (হেসে) আহা চটছো কেন? সত্যি করে বলো তো, এই গ্রামে কেউ কোনোদিন কানাই বলে কাউকে ধরেছে বলে শুনেছো? এতদিন ধরে আশ-পাশের দশ-বিশটা গ্রামে চুরি হচ্ছে, কত চোর ধরা পড়লো, কিন্তু কানাই বলে কেউ ধরা পড়লো না, তা কি হয়?

তৃতীয় : কাল সকালে বাজার যাবার পথে দেখা যোগেশ গয়লার সাথে। দেখি হন্তদন্ত হয়ে উদভ্রান্তের মতো কোথায় চলেছে। আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো, আজ্ঞে আমার উমা-গৌরীকে দেখেছেন? আমি বললাম, কই না তো! কেন, ওদের আবার কী হলো? ও কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, সকাল থেকে ওর দুটো গরুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

দ্বিতীয় : নাঃ, এর একটা বিহিত করতে হবে। চলো, আজ সন্ধ্যেবেলা মোড়ল মশাইয়ের বাড়ি। একটা কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে।

প্রথম : হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ভালো।



দ্বিতীয় দৃশ্য



(মোড়লের বাড়ি। বৈঠকখানা ঘর। কয়েকটি চেয়ার, কাঠের টুল ইত্যাদি। মোড়ল খবরের কাগজ পড়ছেন)

নেপথ্যে : মোড়লমশাই, বাড়ি আছেন?

মোড়ল : কে? ভেতরে এসো।

(তিনজন গ্রামবাসী ও নিতাইয়ের প্রবেশ)

মোড়ল : কিরে, হঠাৎ কী মনে করে! সবাই ভালো আছিস তো?

প্রথম : আজ্ঞে, ভালো কেমন করে থাকব বলুন! গ্রামের সবাই ধনে প্রাণে মরতে বসেছি।

মোড়ল : কী হয়েছে, সব ভালো করে খুলে বল তো! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!

দ্বিতীয় : আজ্ঞে কানাইয়ের চেলাদের জ্বালায় আর তো বেঁচে থাকা যায় না দেখছি! গত তিন রাতে তিনজনের বাড়িতে সর্বস্ব চুরি হয়ে গেছে।

তৃতীয় : আজ্ঞে মোড়লমশাই, আপনি দয়া করে কিছু একটা বিহিত করুন! এভাবে আর থাকা যায় না।

মোড়ল : তাই তো! এতো দেখছি ভারি মুশকিল হলো। তা কী করা যায় বল তো?

দ্বিতীয় : আজ্ঞে আমরা রাতের পর রাত দল বেঁধে পাহারা দিয়ে দেখলাম। তাতেও বিশেষ ফল পাওয়া গেল না।



প্রথম : হয়তো দু-চারদিন বন্ধ থাকল, তারপর যেই একদিন ক্লান্ত হয়ে শেষরাতে একটু ঝিমোতে লেগেছি, ব্যাস ওমনি ঝাঁ করে কারও বাড়িতে চুরি হয়ে গেল।

দ্বিতীয় : চোরদের সঙ্গে চোর-চোর খেলতে খেলতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আর পুলিশগুলোও হয়েছে তেমন, নড়তে চড়তে বারোমাস।

পাগলা নিতাই : ‘কানাইরে ধরবে এমন সাধ্যি আছে কার? / সে দিন দুপুরে চুরি করে / দেয় যে পগার পার। / হাজার হাতির বল দেহে তার / দেখতে যেন দত্যি / বলছি যা তা নয়কো মাতা / এক্কেবারে সত্যি’।

মোড়ল : কত লোক যে কত কথা বলে! কেউ বলে কানাই নাকি অমর। কেউ বলে কানাই এক অশরীরী আত্মা। আবার কেউ বলে ওসব বাজে কথা, কানাই হচ্ছে মানুষের নিছক কল্পনা। আসলে কানাই বলে কেউ নেই।

দ্বিতীয় : আমিও তো তাই বলি। যত সব আজগুবি গল্প।

পাগলা নিতাই : আরে রাম রাম! চুপ কর! চুপ কর! তোমরা কি তবে কানাইকে কানা-ই ভেবেছো নাকি? নাকি ভেবেছো তার কান নেই? কানাইঠাকুর সব দেখতে পায় সব শুনতে পায় গো! ওনাকে অবিশ্বাস করনি, বেপদ হবে।

প্রথম : তুই চুপ করবি? তোর আর কী, চাল নেই চুলো নেই, ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াস। তুই কি বুঝবি? এখন এখান থেকে বিদেয় হও দিকিনি!

পাগলা নিতাই : তবে যাই গো, তোমরা যখন বিরক্ত হচ্ছো!

মোড়ল : না না, যাবি কেন? একটু শান্ত হয়ে বোস তো!

তৃতীয় : মোড়লমশাই, একটা কাজ করতে পারেন?

মোড়ল : কি বল্‌।

তৃতীয় : সরকারের কাছে আবেদন করে দেখুন না, যদি ননী দারোগাকে কিছুদিনের জন্য হলেও এখানে বদলি করিয়ে আনতে পারেন। শুনেছি ওনার মতো কড়া এবং ধুরন্ধর পুলিশ অফিসার সারা রাজ্যে আর নেই।

মোড়ল : ভালো কথা বলেছিস। দেখি, একখানা দরখাস্ত লিখে ওনাকে আনতে পারি কিনা!

দ্বিতীয় : তাই করুন মোড়লমশাই, যত শিগগির সম্ভব। (প্রণাম জানিয়ে সবার প্রস্থান)



তৃতীয় দৃশ্য



(থানার দৃশ্য। একটি টেবিল, দুটি চেয়ার, দুটি বেঞ্চ ইত্যাদি। ননী দারোগা চেয়ারে বসে আছেন। বেঞ্চে কনস্টেবল রামশরণ)


ননী দারোগা : রামশরণ বাইরে গিয়ে দেখো তো, কেউ আসছে কিনা।

রামশরণ : (বাইরে থেকে ঘুরে এসে) জী সাব! মোড়লমশাই আর গ্রামের কয়েকজন আসছেন।

ননী দারোগা : ভালো কথা। আর কোনো খবর আছে?

রামশরণ : জী সাব! খবর পেলাম, আপনি আসছেন শুনে সব ব্যাটা চোর লোটাকম্বল নিয়ে পালিয়েছে।

ননী দারোগা : হাঃ হাঃ হাঃ! তাই নাকি?

রামশরণ : আজ্ঞে, গত দশদিনে অগল বগল গাঁয়ে কোনো চুরি হয়নি।(একটু হেসে) তবে সেই বিখ্যাত চোর কানাই পালিয়েছে কিনা, তা বলতে পারব না।

ননী দারোগা :
কানাই! সে আবার কে?

(মোড়ল ও গ্রামবাসীদের প্রবেশ)


মোড়ল : নমস্কার ননীবাবু!

ননী দারোগা : নমস্কার! বসুন! (গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে) আপনারাও বসুন! বলুন, কিছু জরুরি কথা আছে?

মোড়ল : (বক্তৃতার সুরে) প্রিয় গ্রামবাসীগণ, আমাদের সবার অনুরোধে, চোরেদের উৎপাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে, ভারতবর্ষের বিখ্যাত, স্বয়ং রাষ্ট্রপতি দ্বারা প্রশংসিত ননীগোপালবাবু আমাদের গ্রামে দারোগা হয়ে এসেছেন। আমরা গ্রামবাসীরা তাঁকে স্বাগত জানাই। তোমরা সবাই শান্ত হয়ে বসো। দারোগাবাবু তোমাদের কিছু বলবেন।

ননী দারোগা : হ্যাঁ ঠিক কথা, সরকার আমাকে সাময়িক ভাবে আপনাদের গ্রামে পাঠিয়েছেন চোরদের নির্মূল করার জন্য। আমি খবর পেয়েছি, চোরেরা আমার আসার খবর পেয়ে ইতিমধ্যে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। আমি আরও কিছুদিন দেখব। এর মধ্যে যদি আর কোনো চুরির ঘটনা না ঘটে, তাহলে কয়েকদিন পর আমার পুরনো জায়গায় ফিরে যাব।

পাগলা নিতাই : (হাত জোড় করে) তা যা বলেছো গো দারোগাবাবু, তোমার নাম শুনে চোরেরা বোধহয় এ মুলুক ছেড়ে পালিয়েছে। শুধু কানাইঠাকুর ছাড়া! (কপালে হাত ঠেকিয়ে)

মোড়ল : আজ্ঞে, ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। একটু খ্যাপাটে গোছের। তবে বড্ড ভালো মানুষ।

ননী দারোগা :
আচ্ছা আপনারা কেউ বলুন তো, এই কানাইঠাকুরটি কে?

দ্বিতীয় : আজ্ঞে একজন খুব পুরনো আর অতি বুদ্ধিমান চোর। ছোটবেলা থেকে আমরা কানাইয়ের নাম শুনে আসছি, তবে সে কখনও ধরা পড়েনি। তাই সে দেখতে কেমন, কেউ তা জানে না। বরং কেউ কেউ খানিকটা শ্রদ্ধা করে কানাইঠাকুর বলে।

ননী দারোগা : দেখুন এসব হলো গিয়ে মানুষের দুর্বল মনের কল্পনা। গাঁজাখুরি।

পাগলা নিতাই : না গো দারোগামশাই! কানাই মিথ্যে নয় গো!

মোড়ল : নিতাই – তুই একটু চুপ করে বোস তো! দারোগাবাবু কী বলছেন, শোন্‌।

ননী দারোগা :
আমি সারা গ্রামের সবাইকে শুনিয়ে বলছি, যদি কানাই বলে কেউ থাকে, তবে সে যেন সাতদিনের মধ্যে এই গ্রামের কারও বাড়ি থেকে চুরি করে দেখায়। যদি করতে পারে, তাহলে বুঝবো, সে সত্যিই চোরেদের রাজা। যদি না পারে, তাহলে বুঝবো, কানাই বলে অন্তত এখন আর কেউ নেই।

(গ্রামবাসীদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন)

তৃতীয় : আজ্ঞে দারোগাবাবু, একটা পুরস্কার টুরস্কার ঘোষণা করলে হয় না!

প্রথম : হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভালো হয়, বেশ হয়!

ননী দারোগা : কী? পুরস্কার! হাঃ হাঃ হাঃ! চুরি করার জন্য পুরস্কার! তা আবার হয় নাকি?

তৃতীয় : আজ্ঞে তাতে কী হয়েছে! এটা তো ঠিক চুরি নয়, এটা তো একটা প্রতিযোগিতা!

ননী দারোগা : না না, এটা সম্ভব নয়। মোড়লমশাই আপনি কী বলেন?

মোড়ল :
একটা কাজ করলে হয়!

ননী দারোগা :
বলুন!

প্রথম :
আমার কাছে খাঁটি সোনার তৈরি একটা দামি মেডেল আছে। যদি সাত দিনের মধ্যে কারোর বাড়িতে চুরি না হয়, তাহলে বুঝবো, কানাই বলে কেউ নেই। আর সে ক্ষেত্রে এই মেডেলটি আপনার প্রাপ্য হবে। মেডেলটা কাল সকালে আমি আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব। ওটা থানায় থাকবে, কেমন?

ননী দারোগা :
(হেসে)আচ্ছা বেশ। শুনুন, আজ রাত থেকে আপনারা সবাই পালা করে দল বেঁধে রাত-পাহারার ব্যবস্থা করুন। আমি ও আমার পুলিশ সতর্ক থাকব। সন্দেহজনক কিছু দেখলে, আমাকে জানাতে দ্বিধা করবেন না। সাতদিন পর এই সময় আপনারা সবাই আবার থানায় আসবেন। কেমন? নমস্কার! (সবার প্রস্থান)



চতুর্থ দৃশ্য



(ষষ্ঠদিন। সন্ধ্যেবেলা। চায়ের দোকান)

প্রথম : কি হে, কোনো খবর টবর কিছু পেলে?

দ্বিতীয় : কই, আমি তো কোনো খবর পাইনি!

তৃতীয় : আমিও না।

দ্বিতীয় : আমি তো আগেই বলেছি, ওসব বাজে কথা। গাঁজাখুরি।

প্রথম : এখনও একটা রাত পুরো বাকি। কিছুই বলা যায় না।

তৃতীয় : আজকে রাতটা কাটলে বাঁচি। ছ’রাত না ঘুমিয়ে শরীর আর চলছে না হে!

প্রথম : যা বলেছো। আমার তো সব সময় মাথা ঘুরছে, হাত পা টলমল করছে।

দ্বিতীয় :
(হাই তুলে)কোনো রকমে আজ রাতটা কাটলে যা একখানা ঘুম দেব না...

(নিতাইয়ের প্রবেশ)


পাগলা নিতাই : পেন্নাম ভায়ারা! বলি কোনো খবর টবর কিছু পেয়েছ?

প্রথম : কিসের খবর?

পাগলা নিতাই : কিসের আবার – বলি চুরি টুরি কিছু হলো?

দ্বিতীয় : কেন রে নিতাই, চুরি হলে তুই খুব খুশি হবি, তাই না...

পাগলা নিতাই : আরে না না, তা হবো কেন? আমি কি পাগল? তবে এটা হলো গিয়ে গ্রামের সম্মানের ব্যাপার।

তৃতীয় : হাঃ হাঃ হাঃ! তা যা বলেছ, এখন দেখছি চুরি হলেই গ্রামের সম্মান থাকবে।

প্রথম : চলো হে, বাড়ি চলো। একটু গড়িয়ে নেওয়া যাক। না হলে আজ আর রাত জাগা যাবে না।

দ্বিতীয় : হ্যাঁ হ্যাঁ, চলো হে। এবার ওঠা যাক।

(সবার প্রস্থান)

(পরের দিন সকালে সবাই উপস্থিত। নিজেদের মধ্যে কথা-বার্তা চলছে। একটু পরেই দারোগা আর মোড়লের প্রবেশ। পেছনে পেছনে রামশরণ)


ননী দারোগা : এই যে আপনারা সবাই এসে গেছেন দেখছি! বসুন মোড়লমশাই, বসুন। (মোড়ল ও দারোগা চেয়ারে বসলেন) নিতাই, নিতাই কোথায়?

পাগলা নিতাই : আজ্ঞে, এই যে আমি এখানে।

ননী দারোগা : কই তুমি কিছু খবর টবর রাখো নাকি? কোথাও কোনো চুরি টুরি হয়েছে কি?

পাগলা নিতাই : (আমতা আমতা করে)আজ্ঞে না, আমি তো তেমন কিছু শুনিনি।

ননী দারোগা : কি হলো, আপনারা কেউ কিছু শুনেছেন? এই সাত দিনে আশপাশের গ্রামে বা এই গ্রামে কি কোনো চুরি হয়েছে? (সবাই চুপ)তাহলে দেখলেন তো, কানাই টানাই ওসব বাজে কথা। আজগুবি গল্প।

দ্বিতীয় : আজ্ঞে দারোগামশাই, আমি তো আগেই বলেছিলাম এসব একদম বাজে কথা, তা এরা তো কেউ শুনলোই না!

ননী দারোগা : যাইহোক, আজ থেকে আপনাদের আর রাত জেগে পাহারা দিতে হবে না। তবে সবাই সতর্ক থাকবেন। আগামী পরশুদিন রবিবার আমি আমার পুরনো থানায় ফিরে যাব।

প্রথম : মোড়লমশাই, তাহলে মেডেলটা তো দারোগাবাবুর প্রাপ্য। আপনি দারোগাবাবুকে আমাদের সবার সামনে মেডেলটা দিন।

মোড়ল : হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। রামশরণজী, আপনি ভেতর থেকে মেডেলটা একটু নিয়ে আসবেন! (রামশরণ মেডেল আনতে ভেতরে গেল) ননীবাবু, এই ক’দিন তো খুব ধকল গেছে আপনার। কাল রাত্তিরে আমার বাড়িতে আপনার নেমন্তন্ন রইল।

ননী দারোগা : আবার ওসব ঝামেলা কেন করছেন?

(হন্তদন্ত হয়ে রামশরণের প্রবেশ)

রামশরণ : আজ্ঞে দারোগাসাব, মেডেলটা তো বাক্সে নেই! খালি বাক্স পড়ে আছে।

ননী দারোগা :
(চমকে উঠে) তার মানে? বাক্সে মেডেল নেই! কিন্তু তা কী করে সম্ভব! থানার আলমারির ভেতর থেকে মেডেল উধাও?

মোড়ল : এ তো অসম্ভব ব্যাপার!

পাগলা নিতাই : 
কেমন, এবার বুঝুন! আমি তখনই বলেছিলাম, কানাই ঠাকুরকে অবহেলা করবেন না, তা আপনারা তো আর শুনবেন না!

(সবাই ঘাবড়ে গিয়ে তাকিয়ে থাকলো দারোগাবাবু আর নিতাইয়ের দিকে)




পঞ্চম দৃশ্য



(মোড়লের বাড়ি)

মোড়ল : ননীবাবু তৃপ্তি করে খেয়েছেন তো?

ননী দারোগা :
ওরে ব্বাবা, সে আর বলতে! প্রতিটি রান্নাই চমৎকার হয়েছে। তাই আর লোভ সামলাতে পারিনি।

মোড়ল : ট্রেন তো আপনার কাল ভোরবেলায়। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব খন। (একটু থেমে) আচ্ছা ননীবাবু, কানাই রহস্যের তাহলে সমাধান করা গেল না, কী বলেন!

ননী দারোগা :
(একটু হেসে) মোড়লমশাই, সমাধান যে একেবারে হয়নি, তা নয়। কিন্তু কয়েকটা ব্যাপারে আমার খটকা আছে। আমি দু’য়ে দু’য়ে চার মেলাতে পারছি না।

মোড়ল :
(অবাক হয়ে) তার মানে! আপনি জানেন কানাই কে?

ননী দারোগা :
(হেসে) আজ্ঞে হ্যাঁ। অকাট্য প্রমাণ সহ। মোড়লমশাই, মেডেলটা দিয়ে আমি একটা ফাঁদ পেতেছিলাম। ওটা কোথায় আছে, সেটা তো শুধু তিনজন জানতাম – আমি, রামশরণ আর কানাই। আলমারির সামনে আমি ভিজে মাটি ছড়িয়ে রাখতাম, তাতে কানাইয়ের পায়ের ছাপও ধরা আছে। কিন্তু সে কথা থাক, মোড়লমশাই, আমার একটা নিতান্তই ব্যক্তিগত প্রশ্ন ছিল আপনার কাছে। যদি আপত্তি না থাকে, বলতে পারেন।

মোড়ল : হ্যাঁ বলুন! আপত্তি কিসের!

ননী দারোগা :
মোড়লমশাই, আপনার এত বিপুল সম্পত্তি, কিন্তু তবু আপনি অবিবাহিত কেন? আপনার অবর্তমানে এই সম্পত্তির কী হবে?

মোড়ল : (হেসে) ননীবাবু, আপনি যে অত্যন্ত বুদ্ধিমান, এতে কোনোই সন্দেহ নেই। (একটু থেমে) আসলে আমি ইচ্ছে করেই বিয়ে করিনি। মা আমাকে অনেক অনুরোধ করেছিল, বুঝিয়েছিল, কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্ত বদল করিনি।

ননী দারোগা : কিন্তু কেন?

মোড়ল : (ধীরে ধীরে) আমি চেয়েছিলাম, আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমার বংশ যেন লোপ পায়। আমি ইতিমধ্যে একটা ট্রাস্ট গঠন করেছি। আমার অবর্তমানে আমার সমস্ত সম্পত্তি সেই ট্রাস্টের হাতে যাবে।

ননী দারোগা : আপনার উদ্দেশ্যটা অত্যন্ত মহৎ, কিন্তু কারণটা পরিষ্কার হলো না।

মোড়ল : আমার প্রপিতামহ অত্যন্ত অসৎ ও দুর্বিনীত ছিলেন। মানুষকে ঠকিয়ে এবং আরও অনেক অসদুপায়ে তিনি এই বিশাল সম্পত্তি করেছিলেন। হয়তো সেই জেনেটিক কারণেই আমি কৈশোর থেকেই নিজের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলাম। হঠাৎ কোনো কোনোদিন গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে যেত। আমি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতাম। তারপর কারও বাড়ির সর্বস্ব অপহরণ করে নিঃশব্দে ফিরে আসতাম। কেউ কোনোদিন কিছুই টের পায়নি। কিন্তু তারপর আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুতাপ ও অনুশোচনা হতো। আমি পরদিন সেই গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে তার ক্ষয়ক্ষতি এমন ভাবে মিটিয়ে দিয়ে আসতাম, যাতে কেউ কোনো সন্দেহ করতে না পারে। এর ফলে গ্রামের সবার কাছে আমি প্রায় দেবতার সম্মান পেতে শুরু করলাম। আপনি হয়তো বিশ্বাস করতে পারবেন না, এই মানসিক ব্যধি থেকে মুক্তি পেতে আমি বহু সৎকাজে নিজেকে যুক্ত করেছিলাম। এবং অবশেষে প্রায় কুড়ি বছর হলো, আমি এই ব্যধি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পেরেছি। কিন্তু আমি আর বিয়ে করিনি, যাতে এই ধরনের জিন্‌ বৈকল্য নিয়ে কেউ যেন আর পৃথিবীতে না আসে।

ননী দারোগা :
কিন্তু আপনার এই মেডেল চুরিটা!

মোড়ল : (একটু হেসে) ননীবাবু, এটা মজা, নিছকই মজা।

ননী দারোগা : অনেক রাত হলো, উঠি। কাল আবার খুব সকালে ট্রেন ধরতে হবে। তবে যাবার আগে দুটো কথা বলে যাই।

মোড়ল :
বলুন!

ননী দারোগা :
এই গ্রামের অভিভাবক আপনি। আপনার ওপর সবার অগাধ বিশ্বাস। আপনি এদের সবাইকে দেখবেন। আর শেষ কথা, মেডেলটা বোধহয় একমাত্র আমারই প্রাপ্য, কী বলেন?

মোড়ল :
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, সে আর বলতে... (দু’জনেই হেসে ওঠেন)



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন