কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৩

০৪ অপরাহ্ন সুসমিতো

সার্কাসের মেয়েটি
অপরাহ্ন সুসমিতো



মেয়েটি মঞ্চে উঠেছে আজ লাল জিন্স পরে। তার উপর লাল টপস। আচমকা মনে হলো আগুন লেগেছে বুঝি মঞ্চে। এতক্ষণ দর্শকরা উসখুস করছিল। মেয়েটি দর্শকদের সামনে হেলেদুলে কুর্ণিশ করতেই সবাই নড়েচড়ে বসল। অভাবী দর্শকদের কেউ কেউ তীব্র শিস দিয়ে উঠল। পেটে খিদে থাকলেও শিস দেবার শক্তি অফুরাণ। কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়।

আগুনরঙা মেয়েটি ঘুরে ঘুরে উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে দেয় দর্শকদের। মাতোয়ারা হয়ে ওঠে চারপাশ। সোরগোল দেখে বোঝা গেল, সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল আকর্ষণীয়া এই মেয়েটির জন্য। সার্কাসে নানা ধরনের খেলার মধ্যে ইতিমধ্যে এই খেলাটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মেয়েটি আকর্ষণীয় ভঙ্গিমায় একটা বৃত্তাকার ডায়াসে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। মাঝে মাঝে মুখ গোল করে একটা আঙুল ঢুকিয়ে অশ্লীল ইশারা করে, দর্শকরা উত্তেজনায় আরও ফেটে পড়ে। মেয়েটি আবার কোমর দুলিয়ে স্টেজ ঘুরে আসে। আগুন নেমে যায়...

জাদুকর কালো আলখাল্লা ড্রেসে মঞ্চে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে অনুমান করে নেয়, আজ কত টিকেট বিক্রি হয়েছে। আনন্দে একটা মৃদু ঢেকুর ওঠে। গলা খাঁকারি দিয়ে সিরাজউদ্দৌলা’র কন্ঠ নকল করে শুরু করে—

“হিন্দু ভাইবোনদের আদাব, মুসলমান ভাইবোনদের আসসালামুআলাইকুম ,খ্রীষ্টান ভাই বেরাদার গুড ইভিনিং। ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোকেরা নিজ নিজ আসনে সোজা হইয়া বসেন। হাতের মুঠি খুইলা বসেন। হাত মুঠি কইরা বসলে এই মেয়েটির ক্ষতি হইতে পারে, তার বুক ছুরির আঘাতে রক্তাক্ত হইয়া যাইতে পারে। আমি এখন খেলব পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন খেলা। মেয়েটিকে আমি চাকু ছুঁড়ে মারবো...

পেছনের সারির দর্শকরা জাদুকরের কথা স্পষ্ট শুনতে পারে না। অধীর উত্তেজনায় টানটান হয়ে আসে শরীর। টাইট প্যান্টের মেয়েটি এখনও হেলেদুলে হাঁটছে। কোনো কোনো অতি আগ্রহী দর্শক আসন ছেড়ে মঞ্চের দিকে ছুটে যেতে চেষ্টা করে। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রস্তুত, লাঠিসোটা নিয়ে আছে। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। শুধু যে সব দর্শকের হাতে টাকা দেখা যায়, তাদেরকেই ছাড় দেয়। টাকা হাতে উন্মত্ত দর্শক মেয়েটির দিকে টাকা বাড়িয়ে দেয়। মেয়েটি ঝুঁকে দর্শকের সামনে দাঁড়ায়। আহা, ওরা সুযোগ পাচ্ছ্‌ টাকাটা মেয়েটির টপসের ভেতর গুঁজে দিতে। মঞ্চের আলো কখনও নিভে আসে। উল্লসিত দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়ে।

জাদুকর শান দেওয়া ছুরির ডালা নিয়ে আবার সামনে দাঁড়ায়। দর্শকদের ভেতর নেমে আসে পিন পতন নিস্তব্ধতা... খেলা শুরু হচ্ছে।

মেয়েটির বুক ধক ধক করে ওঠে অজানা ভয়ে। লাল লিপস্টিক মাখানো ঠোঁট শুকিয়ে আসে। অজান্তে জিভ দিয়ে খানিক ভেজানোর চেষ্টা করে। তবু হাসিমুখটা ধরে রাখে। দর্শক আসনের আলো নিভে যায়... মঞ্চের সমস্ত আলো মেয়েটিরর ওপর এসে পড়ে... মেয়ে্টি নিজের জায়গায় গিয়ে পজিশন নেয়। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে... এক পলক অভাবী মায়ের মুখটা মনে পড়ে যায়...

অনুষ্ঠান প্যান্ডেলের বাইরে স্থানীয় সাংসদের অনুগত এক মাস্তান মোটর সাইকেলে বসে ঘনঘন সিগারেট ফুঁকছে। অপেক্ষায় আছে, কখন এই ছুরিখেলা শেষ হবে, আর আগুনে মেয়েটিকে নিয়ে সে উড়াল দেবে। মেয়েটিকে তার চাইই...

অপেক্ষার সময় খুব সমুদ্র দীর্ঘ, কাটে না যেন! সিগারেট জ্বলে নেভে অন্ধকারে তারাবাতির মতো। রাতের আকাশে মেঘ মাঝে মাঝে চাঁদটাকে লজ্জায় লুকিয়ে রেখে আবার ছেড়ে দেয়। আলোর টানটান প্রভা নামে গোটা প্যান্ডেল জুড়ে।

প্রথম চাকুটা মেয়েটির প্রায় গালের কাছে দিয়ে সাঁ করে ছুটে গিয়ে ডায়াসে খচ করে বেঁধে। মেয়েটি ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল, তবু হাসি নামে না ঠোঁট থেকে। অস্ফুট একটা নীরব কান্নার ধ্বনি ভেতরে মুচড়ে ওঠে...

‘মা গো, আমারে বাঁচাও...’


1 কমেন্টস্: