কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

মলয় রায়চৌধুরী

 

আভাঁগার্দ সাহিত্য কাকে বলে?

আভাঁগার্দ মানে 'অ্যাডভান্স গার্ড' বা 'ভ্যানগার্ড', আক্ষরিক অর্থে 'ফোর-গার্ড', ভাবকল্পটি এমন একজন ব্যক্তি বা কাজ যা শিল্প, সংস্কৃতি বা সমাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় যা পরীক্ষামূলক, নতুন বা অপ্রথাগত। কাজগুলো প্রথমদিকে নান্দনিক উদ্ভাবন এবং প্রাথমিক অগ্রহণযোগ্যতা দ্বারা চিহ্নিত করা হতো। আভাঁগার্দ শব্দটা, মূলত ফরাসি সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত একটি শব্দ ছিল। এই সামরিক রূপকটি সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োগ আরম্ভ হলো, বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক, প্রথানুগত লেখালিখি থেকে পার্থক্য চিহ্ণিত করার জন্য। শব্দটি সেনাবাহিনীর সামনের জওয়ানদের নির্দেশ করে, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথমে শত্রুদের মুখোমুখি হয় এবং যারা পরে আসে তাদের জন্য পথ প্রশস্ত করে। অর্থাৎ আভাঁগার্দ বলতে বোঝায়, সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে, যাঁরা সমসাময়িক কালখণ্ড থেকে এগিয়ে। বলা বাহুল্য যে তাঁরা আক্রান্ত হবেন এবং তার জন্য  তাঁরা নিজেদের সেইমতো প্রস্তুত করেন, এরকম মনে করা হয়। তবে বিবর্তনমূলক অর্থে নয়। কারণ এটি বুর্জোয়া সমাজে সাহিত্য-শিল্পের মূল নীতি সম্পর্কে আমূল প্রশ্ন তোলে, যে বক্তব্যটি হলো এই যে, ব্যক্তি-একক বিশেষ সাহিত্য-শিল্পের কাজের স্রষ্টা বা ব্র্যাণ্ড, পুঁজিবাদী কাঠামোয় বিক্রয়যোগ্য। আভাঁগার্দ ভাবকল্পটি সর্বদা প্রয়োগ করা হয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে যাঁরা বুর্জোয়া এস্টাব্লিশমেন্টের স্থিতাবস্থাকে চুরমার করে এগিয়ে যাবার কথা বলেন। কবি বা শিল্পী কী বলিতেছেন নয়, কবিতা বা শিল্পটি কী করিতেছে, এটাই হলো আভাঁগার্দের নবায়ন। স্বদেশ সেন লিখিত ‘জাদু’ কবিতাটা পড়লে টের পাওয়া যাবে আমি কী বলতে চাইছি :

একটা কি চাঁদ উঠেছে না বৃষ্টিতে ভিজেছে অর্জুন গাছ

সেই অর্জুন গাছে বসেছে পায়রা

লাল পা, শাদা গা, নীল ঘুম?

ও জাদুবাজ তামাড়িয়া, সিল্ক, গরদ আর টায়রা

একটা কি সূর্য উঠেছে না আগুনের ব্লুম?

আভাঁগার্দ কবিতা তার আগেকার অন্যান্য কবিদের কাব্যাদর্শ প্রত্যাখ্যান করে এগোয় এবং পরিবর্তে নতুন এবং উত্তেজনাপূর্ণ বাকপথের সন্ধান করে। অর্থাৎ আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্পের মনোবিজ্ঞান এবং আদর্শে, ঐতিহাসিকভাবে বিবেচনা করা হয় যে (হেগেলীয় এবং মার্কসবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি যাকে ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতা বলবেন) ভবিষ্যতবাদী প্রকাশের প্রতিনিধিত্ব করে, তাই বলতে গেলে, একটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক এবং ইউটোপিয়ান পর্যায়, আভাঁগার্দের বিচরণক্ষেত্র। ব্যাপারটাকে অনেকে মনে করেন, আভাঁগার্দ নিজেই বিপ্লব না হলেও তা ঘোষণা এবং বিপ্লবের জন্য একটি প্রস্তুতি। একইভাবে ছবি আঁকা আর ভাস্কর্যের নবায়ন করে আভাঁগার্দ। উদ্ভাবন ব্যাপারটা আভাঁগার্দ কাজের কেন্দ্র । ফলত, অনেক সময়ে, আভাঁগার্দ লেখা সম্পূর্ণ নতুন, দুর্বোধ্য, দুরূহ, মজার এবং প্রায়শই সমসাময়িক পাঠকদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। কবি বা শিল্পী তার ফলে হতাশ হন না, ঠিক যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটে, পেছিয়ে আসার প্রশ্ন ওঠে না। মরে যাবে জেনেই  আভাঁগার্দ জওয়ানরা শত্রুনিধনে বেরোয়। কখনও কখনও কবি বা শিল্পীরা, যাঁরা আভাঁগার্দ  থিমের সাথে জড়িত, তাঁদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি পেতে কয়েক দশক লেগে যায় কিংবা শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি নাও পেতে পারেন। ক্রমশ আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্প মূলধারার অংশ হয়ে যায় এবং অবিশ্বাস্যভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায়, একদা যে ডাডাবাদী কাজগুলো আভাঁগার্দ হইচই হিসাবে নিন্দিত হয়েছিল, তা প্রয়োগ করছে বিজ্ঞাপনের এজেন্সিগুলো। প্রাথমিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যা আদর্শ বা স্থিতাবস্থা হিসেবে বহুকাল যাবত গ্রাহ্য, তার সীমানা অতিক্রম করে আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্প। আভাঁগার্দকে কেউ কেউ আধুনিকতার শেষ বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন যার হাত ধরে উত্তরাধুনিকতা প্রবেশ করেছে। অনেক শিল্পী আভাঁগার্দ আন্দোলনের সাথে যুক্ত করে নিজেদের কাজকে উত্তরাধুনিক হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন। ‘শ্রুতি আন্দোলনের কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায় আমেরিকার ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েটদের বহু আগে উত্তরাধুনিক কবিতা লিখেছিলেন; যেমন ‘আমি সারাদিন আমি’ কবিতাটি :

আমার মা সারাদিন মালা জপেন

আর আমি

আমার বোন সারাদিন উল বোনে

আর আমি

আমার বউ সারাদিন আলনায় জামাকাপড় সাজায়

আর আমি

আমার প্রতিবেশীরা সারাদিন বাড়ি তোলে

আর আমি

আমার বন্ধুরা সারাদিন লিফটে চড়ে

আর আমি

আমি সারাদিন শুধু আমি।

আভাঁগার্দ আমূল সামাজিক সংস্কারও সমর্থন করে।  সেইন্ট সিমোঁর মতাবলম্বী ওলিন্ডে রড্রিগেস তাঁর প্রবন্ধে (‘শিল্পী, বিজ্ঞানী এবং শিল্পপতি’, ১৮২৫)  বলেছিলেন যে, সাহিত্যিক এবং শিল্পীদের উচিত সমাজে আভাঁগার্দ পরিবর্তন আনা। রড্রিগেস বলেছিলেন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য "সাহিত্য ও শিল্পের শক্তি প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং দ্রুততম হতে পারে আভাঁগার্দ কাজের মাধ্যমে"।  ভাবকল্পটি উনিশ শতকে বামপন্থী ফরাসি র‍্যাডিকালদের সাথে যুক্ত হয়েছিল, যাঁরা রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য  আন্দোলন করছিলেন। সেই শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে, শব্দটি সাহিত্য-শিল্পের সাথে যুক্ত হয়, এই ধারণার মাধ্যমে যে সাহিত্য-শিল্প হলো সামাজিক পরিবর্তনের উপকরণ। শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপে আভাঁগার্দ কাজকর্ম সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক বিষয়গুলির সাথে আরও বেশি করে সংযুক্ত হওয়ার দরুন বামপন্থী সামাজিক কারণগুলো থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেছিল। বিশুদ্ধ রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে নান্দনিক বিষয়গুলোর উপর জোর দেওয়ার এই প্রবণতা  অব্যাহত, তার কারণ রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে অসাধু লোকেরা যাদের আসল উদ্দেশ্য টাকা কামানো।

আভাঁগার্দ আজ সাধারণত বুদ্ধিজীবী, লেখক এবং শিল্পীদের গোষ্ঠীকে বোঝায়, যার মধ্যে ভাস্কর আর  স্থপতিও রয়েছেন, যাঁরা বর্তমান সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করে শৈল্পিক পদ্ধতির নবায়নের চিন্তাভাবনা করেন এবং পরীক্ষা করেন। আভাঁগার্দ কাজগুলো, বিশেষ করে যদি তারা সামাজিক সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে চায়, প্রায়শই এমন সমাজ-কর্তাদের মুখোমুখি হয় যারা সমাধানগুলো  আত্মীকরণ করতে বড়ো বেশি সময় নষ্ট করে। সমস্যা হলো যে গতকালের প্রতিষ্ঠানবিরোধিরা মূলধারায় পরিণত হয়, সরকারে যোগ দেয় বা ক্ষমতাবান মিডিয়ার মুখপত্র হয়ে ওঠে। ফলে আবার নতুন প্রজন্মের বিরোধিদের উদ্ভবের পরিবেশ তৈরি করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ডাডা আন্দোলন গড়ে ওঠে সেইসব শিল্পীদের নিয়ে, যাঁরা পুঁজিবাদী সমাজের যুক্তি, কারণ বা সৌন্দর্যের ধারণা মানতেন না, বরং তাঁদের কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন আপাত-অর্থহীন, উদ্ভট, অযৌক্তিক এবং বুর্জোয়া-বিরোধী প্রতিবাদী বক্তব্য।

আন্দোলনটির কাজ প্রসারিত হয়েছিল দৃশ্যমান, সাহিত্য ও শব্দ মাধ্যমে, যেমন   কোলাজ, শব্দসঙ্গীত, কাট-আপ লেখা, এবং ভাস্কর্যতে। ডাডাবাদীরা হানাহানি, যুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন এবং গোঁড়া বামপন্থীদের সাথে তাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল। সবচেয়ে বিশিষ্ট আভান্ট-গার্ড কবিদের মধ্যে আমরা ভিসেন্তে হুইডোব্রো, নিকোলাস গুইলেন, সেজার ভালেজো, জর্হে লুইস বোর্হেস, অক্টাভিও পাজ, জুয়ান কার্লোস ওনেটি, মারিও বেনেদেত্তি, পাবলো নেরুদা, অলিভেরিও গিরোন্ডো, ভাসকো পোপা এবং আরও অনেককে খুঁজে পেতে পারি। সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণকারী বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমগুলো আভাঁগার্দ প্রবণতাকে সমর্থন করতে পারে এমন পাঠকদের এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। অমন পাঠকদের এলাকা সর্বদা সামাজিক অবস্থার সম্পূর্ণতা দ্বারা সীমাবদ্ধ। আভাঁগার্দ প্রবণতাগুলো সাধারণত স্বতন্ত্র ভিত্তিতে স্বীকার করা হয়, এবং সেই স্বাতন্ত্র্য হল গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যায়তনিক প্রত্যাখ্যানের মূল্যে। বিতর্কের মৌলিক বিষয় হল আভাঁগার্দ লেখক-শিল্পীদের ত্যাগ। তাঁদের কাজকে খণ্ডিত  গ্রহণযোগ্যতায় মাপা হয় যখন কিনা তাঁদের রচনাগুলো খোলা একাধিক গভীর পাঠ দাবি করে। এই বাণিজ্যিক প্রতিরোধ আভাঁগার্দ ভাবকল্পকে পরিসর তৈরি করে দেয়। উদ্ভাবন বিপ্লবের মাধ্যমে শিল্পে নবায়নের জন্য উদ্ভাবনার বিপ্লব জরুরি। বাস্তবতা অনেকটা একইভাবে শিল্পে নিজেকে প্রকাশ করে যেভাবে মাধ্যাকর্ষণ নিজেকে প্রকাশ করে যখন একটি ছাদ তার মালিকের মাথায় ভেঙে পড়ে। নতুন শিল্প-সাহিত্য, নতুন শব্দ, নতুন অভিব্যক্তির জন্য আগেকার ছাদ ভেঙে ফেলে নতুন ছাদ পাততে হয় শিল্পী-সাহিত্যিকদের। ভেঙ্গে পড়ার চেষ্টায় কবি বা শিল্পী কষ্ট পান; শব্দ এবং বাস্তবতার মধ্যে বাধা পান। আমরা ইতিমধ্যে তাঁর কলমে বা তুলিতে নতুনত্ব অনুভব করতে পারি’  বলেছেন ভিক্টর শক্লোভস্কি। এই প্রসঙ্গে বাংলায় সৌমনা দাশগুপ্তর ‘শনির বলয় ভেঙে’ কবিতাটি উল্লেখ্য :

বরং

শূন্যের দিকে উড়ে যাক কসমিক হরিণের ছায়া, প্রেম ও প্রতীতি

নিজেকে সুচের মধ্যে ভরে ক্রসস্টিচ ফোঁড়, ছুরিতে কুড়ুলে শান

বরং

প্ল্যাটফর্মে থইথই করুক আগুন

প্ল্যাটফর্মে হইহই করুক শকুন

ওপাশে সরাইখানা, মেঘের শরীরঠেসে পেরেকের কুচি, ট্যাক্সিডার্মি

যেয়ো না যেয়ো না সখী, শুদ্ধ কল্যাণ-ঠাটে লেগে যাবে মরিচার দাগ

ডাউন-সিনড্রোমের গলি, পিছলা রাস্তায় কত পিতলা-পিরিত নাচে গায়

শনির বলয় ভেঙে ছিটকে ছিটকে পড়ে নিকেলের পাশা, ধুলো ও বরফ

সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতায়, আভাঁগার্দরা তাঁদের লেখার নতুন পদ্ধতিতে উদ্ভাবন করেছেন।  কবিতায় তাঁরা কিছু ব্যাকরণ যেমন সঠিক বানান এবং সংযোগকারী শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করেননি; বা নিয়ম বা কাঠামো যা আগে গ্রাহ্য ছিল তাকে অস্বীকার করেছেন। এই কবিতার বৈশিষ্ট্যগুলি তাঁদের অনন্য করে তুলেছিল, যেহেতু পূর্বোক্তগুলি মেনে চলার পাশাপাশি, তাঁরা সম্পূর্ণ মুক্ত উপায়ে কবিতা চর্চার ঝুঁকিও নিয়েছিলেন; তাঁরা নতুন শব্দ উদ্ভাবন করতেন, নতুন হরফ ব্যবহার করতেন, এমনকি একই টেক্সট (ক্যালিগ্রাম নামে পরিচিত) বা তাদের সাথে ছবি দিতেন পরে। তাঁরা ১) কবিরা ভাবনাকে উপস্থাপন করতে  ছবি ব্যবহার করতেন। ২) পুরনো কবিতার প্রতি কবির অসন্তোষ প্রকাশ করতেন এবং নতুন কিছুর সন্ধান করতেন। ৩) কাব্যিক ভাষা আমূল পরিবর্তন করতেন। ৪ ) আলোচিত বিষয়গুলি খুব বৈচিত্র্যময়, অস্বাভাবিক এবং উদ্ভাবনী হিসাবে উপস্হাপন করতেন। ৫) নতুন পাঠকের কাছে যা অর্থহীন ছিল তা পিছনে ফেলে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। এই প্রসঙ্গে শম্ভু রক্ষিত-এর ‘মুক্তিবাদ’ কবিতাটি উল্লেখ্য:

যারা আমাকে ডিগডিগে

আমার রুহকে যুদ্ধের হিরো

আমার ঈশ্বরকে অনিষ্টজনক

আমার কবিতাকে

চাকচিক্যময় আভিজাত্য বা বিক্ষিপ্ত প্রলাপ মনে করে

 

আহ ভাইরে

তারা বাণিজ্যের অযথার্থ ক্ষমতা দিয়ে

তাদের নাক মুখ কান দখল করে

এই শক্তিশালী প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের

অস্তিত্ব রক্ষা করুক

 

যারা বালি ফুঁড়ে

আমাকে বাল্যপাঠ শেখাচ্ছে

আহ ভাইরে

তারা মেকি সুন্দরের মিথ্যে সীমারেখা প্রত্যাখ্যান করে

অন্তত্ব একটা ছোটখাটো দেবদূতের সন্ধান করুক

 

অকেজো জ্যুকবক্সে স্থির ডিস্ক

জীবনের আর ভাঙা ইঁটের

অশুভ যুদ্ধপরা যন্ত্রণায় আন্তর্জাতিক কোরাস

আহ ভাইরে

কবরখানা আর টাউনশিপের সুড়ঙ্গের মধ্যে গুঞ্জন করা

আস্তাবলের ধূর্ত পিটপিটে মায়া

মধ্যে মধ্যে ফ্যাঁকড়া

আহ ভাইরে


কাঁধে অগ্নিবর্ণের ক্যামেরা

হাতে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ট্রানজিস্টর

অন্য সম্রাটের দায় যাতে মেটে

মাংস ভেদ করে সচল ফ্রেস্কোর মত

এইসব রেডিয়ো-টিভি-অ্যাকটিভ যুবশক্তি

মুক্তিবাদ এবং জাঁকজমক খুঁড়ে নৈশস্তব্ধতা

আহ ভাইরে

ইউরোপ থেকে আনা সাহিত্য-সংরূপগুলোর সংজ্ঞার স্বামীত্ব, তাদের ব্যাখ্যা করার অধিকার, দেশীয়করণের বৈধতা, সেসব বিধিবিধান তত্ত্বায়নের মালিকানা,  কথাবস্তুটির উদ্দেশ্যমূলক স্বীকৃতি, চিন্তনতন্ত্রটির অন্তর্গত সংশ্লেষে স্বতঃঅনুমিত ছিল যে, অনির্মিত লেখকপ্রতিস্বের পক্ষে তা অসম্ভব, নিষিদ্ধ, অপ্রবেশ্য, অনধিকার চর্চা। ব্যাপারটা স্বাভাবিক, কেননা যাঁরা সংজ্ঞাগুলো সরবরাহ করছেন, তাঁরাই তো জানবেন যে সেসব সংজ্ঞার মধ্যে কী মালমশলা আছে, আর তলে-তলে কীইবা তাদের ধান্দা। ফলে, কোনও কথাবস্তু যে সংরূপহীন হতে পারে, লেখক-এককটি চিন্তনতন্ত্রে অনির্মিত হতে পারে, রচনাকার তাঁর পাঠবস্তুকে স্হানাংকমুক্ত সমাজপ্রক্রিয়া মনে করতে পারেন, বা নিজেকে বাংলা সাহিত্যের কালরেখার বাইরে মনে করতে পারেন, এই ধরনের ধারণাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেয়নি ওই চিন্তনতন্ত্রটি। এই কারণেই হাংরি আন্দোলনকে বুঝতে পারেন না  অনেকে, হাংরিদের কবিতা ও গদ্যকে পূর্বের কবি ও লেখকদের কাজের পাশে রেখে তুলনা করতে চান। বর্তমান কালখণ্ডে, আমরা জানি, একজন লোক লেখেন তার কারণ তিনি ‘লেখক হতে চান’। অথচ লেখক হতে চান না এরকম  লোকও তো লেখালিখি করতে পারেন! তাঁরা সাহিত্যসেবক অর্থে লেখক নন,  আবার সাহিত্যচর্চাকারী বিশেষ স্হানাংক নির্ণয়-প্রয়াসী না-লেখকও নন। তাঁদের মনে লেখক হওয়া-হওয়ি বলে কোনও সাহিত্য-প্রক্রিয়া থাকে না। হাংরি আন্দোলনকারীদের, ডাডাবাদীদের মতনই, এই প্রেক্ষিতে গ্রহণ করতে হবে।

 


1 কমেন্টস্:

  1. দুর্দান্ত প্রতিবেদন।
    মাননীয় মলয় রায়চৌধুরী , আমাদের পথ প্রদর্শক সেই সাহিত্যশ্রমিক হওয়ার হাতেখড়ি থেকেই। তাঁকে ফলো করি। নকল নিকেল সাহিত্যের বল্কল ছাড়িয়ে তাঁকে চিনি, তিনি এভাবেই চিনিয়েছেন নিজেকে। প্রণাম নেবেন _@মৌ_২০২২

    উত্তরমুছুন