ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(২৭)
মধুর
সতেজ উষ্ণ সুবাসে ঘর এখনো ভরে আছে।
মামপি
দেবার্ঘ্যকে নিয়ে এসেছিল, চলে গেছে খানিক আগে। আশা করেনি লিপিকা, অবাক হয়েছিল। টেবিল
থেকে কাচের গ্লাস, কাপ, প্লেট সরাতে সরাতে ভ্রূ কুঁচকে ভাবে,
--ভালো
ছেলেটি, কিন্তু...
সন্ধ্যবেলা
ওরা এসেছিল। দরজা খুলে দেখে শ্রুতির পেছনে সলজ্জমুখে দাঁড়িয়ে দেবার্ঘ্য। উচ্চতা বেশী
নয়, মাথায় মাথায় না হলেও শ্রুতির চেয়ে অল্পই লম্বা। কী বলবে ভেবে পায়নি লিপিকা। বলেছিল,
--বন্ধু?
শ্রুতি
চট করে জবাব না দিয়ে পেছন ঘুরে বলেছিল,
--আসুন।
দেবার্ঘ্যর বদভ্যেস আছে বিব্রত হলে ঘাড় নীচু করে মাথা চুলকানো। বিশ্রী লাগছিল মামপির, চোখ দিয়ে বারণ করার চেষ্টা করছিল, দেবার্ঘ্য তাকায়নি। সমস্ত খুঁটিয়ে দেখেছে লিপিকা, চোখের শাসন, ভদ্র লাজুক যুবকের সমর্পণ, বেশ লেগেছিল। ঘরে ঢুকে ঝুপঝুপ করে প্রণাম করল দু-জনে। প্রথম নজরে মনে হল, বিয়ের ব্যাপারে যত নির্লিপ্তি দেখাক মামপি, অগোচরে সুতো বাঁধা হয়ে গেছে। ‘ম্যারেজেস্ আর মেড ইন হেভেন’ বা ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’—প্রবাদগুলো কখনো কখনো উদাহরণ হয়ে উপস্থিত হয়। দেবিকার হবু-জামাতা, মনে-মনে হাসে লিপিকা। মামপিকে বিয়ের জন্য ভালো একখানা গয়না দিতে হবে।
আলাপী
ছেলে দেবার্ঘ্য। কথাপ্রসঙ্গে অবধারিত চাকরি ও হায়দরাবাদে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠে আসে। দ্বিধা
কাটিয়ে নম্রভাবে বলে,
--ডিসিশন
কি বদল হয় না?
প্রশ্ন
সে হাওয়াতে ছেড়ে দেয়, যে জবাব দেওয়ার দিক। মামপি বেশ খানিকটা চুপ করে থেকে শান্তভাবে
বলে,
--কোনো
কারণ বা চান্সও নেই। এমন অফার চট্ করে আমার ভাগ্যে অন্তত আর জুটবে না।
লিপিকা
নীরব দর্শক এবং শ্রোতা, দেবার্ঘ্য তার দিকে তাকিয়ে অসহিষ্ণুভাবে জানতে চায়,
--আপনার
কী মনে হয় আন্টি?
লিপিকা
চট করে উত্তর দেয় না। বিষয়টা তত সহজ নয়, কোনদিকের পাল্লা ভারী বোঝা যাচ্ছে না। কিছু
পরে নৈর্ব্যক্তিকভাবে বলে,
--মামপি
কিন্তু ভুল বলছে না, কলকাতায় বসে এমন চাকরি হয়ত পেত না।
--কিন্তু—এদিকটা, মানে,
এই ভাইটাল স্টেজে এসে ডিসিশন—অ্যাবাউট টার্ন!
আমার মা-বোন জানলে ভীষণ আপসেট হবে।
দেবার্ঘ্যর
স্বরে উষ্মা-মিশ্রিত হতাশা। লিপিকা পরিস্থিতি সহজ করতে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে,
--তাই!
আর তুমি?
--আপাতত
ওটা থাক—। কিন্তু ফাইন্যালাইজ হয়ে যাওয়ার পরে
এটা কি ঠিক ডিসিশন?
মামপি
নির্বাক হয়ে শুনছিল, দেবার্ঘ্যর দিকে সোজাসুজি তাকাল, শ্যামল গালে উষ্ণতার রঙ। ধীরে-ধীরে
মাথা দোলায়,
--কী
ফাইনালাইজ? কোনো কমিটমেন্ট তো হয়নি! আমার আপত্তি নেই, এটুকুই আপনাকে জানিয়েছিলাম।
--আমার মা জানলে ক্যান্সেল করে দিতে বলবেন।
রূঢ় স্পষ্ট কথায় থমকায় মামপি, বুকের মধ্যে আন্দোলনের ছোটো ছোটো ঘূর্ণি। লিপিকাও চমকে দেবার্ঘ্যর দিকে তাকায়, আন্দাজ করার চেষ্টা করে প্রতিক্রিয়া। পরিবেশ থমথমে আকাশের মতো ভার। মামপি অন্তরমহলের নতুন ঝড় সামলে কেটে-কেটে বলে,
--কোয়াইট ন্যাচারাল। কিন্তু তাতে আমার করণীয় কিছু নেই।
ইগোর লড়াই—! ছেলেটিকে যেমন দেখায় তত নরমধাতের নয়, লিপিকা ভাবে। সম্বন্ধটা ভেঙে গেলে দেবিকা তুলকালাম করবে। অবশ্য মামপি কলকাতা ছেড়ে চলে গেলে তাকে বিশেষ স্পর্শ করবে না। লিপিকাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে যা-তা বলতে পারে। সে-সব বাদ দিলেও মামপির পক্ষে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার আঘাত কতটা? মেয়েটার চোখ নীচু, চোয়াল শক্ত—প্রকাণ্ড দ্বিধার ফাটলে পড়ে থই পাচ্ছে না। লিপিকা মামপির কাছে সরে বসে মাথায় আলতো হাত রাখে, গভীর নিঃশ্বাস নির্গত হওয়ার শব্দ পায়। কষ্ট হয়, কী বলবে ভেবে মুখ খোলে না। দেবার্ঘ্যর পাশে শোভন বসেছিল। ওদের কথোপকথন শুনেছে, মাঝে-মাঝে উঠে ঘরে গেছে, আবার এসে বসেছে। স্বভাবজ সহজ গলায় বলে,
--দেবার্ঘ্যকে একটা কথা বলি? তোমার যদি অন্য শহরে ভালো জব অফার আসত, মামপির কাজ থাকত কলকাতায়? তেমন হলে যা করতে মামপিকে বলো, ও সেটা করতে পারে।
দেবার্ঘ্য মুখ ঘুরিয়ে শোভনকে দেখে, অবাক লাগে। শোভন অবিকল অবলীলায় বলে,
--আমি রিটায়ার করলাম বলে মামপির মাসিকে জব ছেড়ে আসতে হল। এখানে চেষ্টা করলে কতটা কী হত আই ডাউট, তবু এক্সপিরিয়েন্সের দাম আছে। মামপির টানা এক্সপিরিয়েন্সও নেই। এখন আমার মনে হয়, আমি ঠিক কাজ করি নি।
সোফা
ছেড়ে সে উঠে পড়ে, অস্থির লাগছে শরীর। গভীর করে ভাবলে মাথায় কষ্ট হতে থাকে। লিপিকা উদ্বিগ্ন,
--আঃ কীযে বলতে থাকো! শরীর খারাপ লাগছে? ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও।
আলতো করে শোভনকে জড়িয়ে ধরে মামপি ঘরের দিকে যায়। বাবা-মা কাউকে নিজের এত কাছে সে আসতে দেয়না। বিরক্তি, বিতৃষ্ণার মোটা দেওয়াল খাড়া করে রাখে। আগে বাবাকে সত্যি ভালোবাসত, কবে যেন শীতল হয়ে গেছে। তার মা আড়ে-ঠারে কথা শোনায় মাসী-মেসোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া নিয়ে। তবে ইদানিং বেশী ঘাঁটায় না, ভয় পায়। অনেক কারণে সে কলকাতা ছাড়ার জন্য পা বাড়িয়ে আছে, একবার চলে গেলে ফেরার নাম করবে না।
লিপিকা
দেবার্ঘ্যকে জিজ্ঞেস করে,
--তোমার
মা-কে জানিয়েছ শ্রুতির চাকরির কথা?
--না
আন্টি। চাকরিতে মা-র তো বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, অন্য শহরে থাকা-টাকা...।
--বুঝতে
পারছি। তুমি বরং ওনার সঙ্গে কথা বলে দ্যাখো।
--আমার
মা রীতিমতো আপ-ডেটেড, শেষ অবধি মেনে নেবেন হয়তো, বাট্ আমারও নিজস্ব মত আছে।
--নিশ্চয়ই।
তবে কী জানো, আমার মনে হয় শ্রুতির চাকরি ওর নিজের মেন্টাল হ্যাপিনেস-এর জন্য দরকার।
দু-জনে আলোচনায় বসো, সল্যুশন বেরিয়ে যাবে।
--দেখি।
ফিরে আসার পর থেকে অদ্ভুত দোলাচল চলছে শ্রুতির মধ্যে। মুক্ত বাতাস, খোলস থেকে বেরিয়ে শ্বাস নেওয়ার পরিবেশের জন্য আকুলি-বিকুলি করে ভেতরটা। বিয়ের তাগিদ অনুভব করে না, না হলে না হোক। কিন্তু একটি বুঝদার সঙ্গীর অভাব বড্ড কষ্ট দেয়। দেবার্ঘ্যকে তেমন মনে হয়েছিল বলে বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিল। মনে হচ্ছে, ভেঙে যাওয়াই শ্রেয়—বেশ গোঁয়ার ছেলে, ইগোও প্রখর। মাসির বাড়ি থেকে আসার পরে আর ফোন করেনি দেবার্ঘ্য, মেসেজও নয়। সে নিজে থেকে এমনিতেও করেনা। হায়দরাবাদ যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছে। সেকেণ্ড এ-সি-র ভাড়া রিইম্বার্স করবে কম্পানি, সে স্বেচ্ছায় ফ্লাইটের টিকিট নিয়েছে। জীবনে প্রথম ফ্লাইট-ট্র্যাভেল, সেটাও নিজের খরচে, ভেতরে উত্তেজনা ফুটফুট করছে। কেমন শহর হায়দরবাদ? কোনোদিন সে কোত্থাও যায়নি বারদুই দীঘা ও একবার পুরী বাদে। প্রয়োজনীয় জিনিস, কাগজপত্র, জামাকাপড় গুছিয়ে রেখেছে নতুন-কেনা স্যুটকেসে। যতবার দেবিকা মেয়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, মুখ খোলার আগে কনকনে ঠাণ্ডা গলায় শ্রুতি বলেছে,
--বলবে কিছু?
থতমত খেয়ে সরে গেছে দেবিকা, ক-দিনে অন্যরকম হয়ে উঠেছে মেয়ে, রোজকার চেনা বৃত্ত থেকে ভীষণ আলাদা—এর ওপরে চেঁচামিচি করা যায় না, মেজাজ করে কথা শোনানো যায়না! কোথায় যেন গায়ত্রীর সঙ্গে বড্ড মিল স্বভাবে, নির্লিপ্তি, গাম্ভীর্য ও পরিমিতিবোধে। দেবিকা গলা চিরে প্রশ্ন করে উঠতে পারছে না, ‘অগরে তা-লে কী বলব বল? জন্ম থেকে জ্বালাইয়া খাচ্ছিস, আর কত বচ্ছর জ্বালাবি? তিরিশবছরের ধাড়ি বাপের ঘাড়ে বইসা আছিস!” স্বভাববিরুদ্ধভাবে সে চেপে রাখছে অনুভূতির দঙ্গল, কৌশিককেও বলছে না কিছু।
যাওয়ার
দিনদুই আগে শ্রুতিকে মেসেজ করল দেবার্ঘ্য,
--কথা ছিল। ফ্লাইট কখন?
দেখেও উত্তর দিল না শ্রুতি, ইচ্ছে করে। যা মরে যাবে তাকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা করল না। দুর্ভাগ্য যে, এতগুলো বছরে তার প্রাপ্তির ঝুলিতে বিশেষ কিছু নেই। ফ্লাইটে যাওয়ার কথা নিশ্চয়ই দেবিকা বলেছে দেবার্ঘ্যকে, শ্রুতি জানতে চাইল না। শ্লেষের হাসিতে ঠোঁট বেঁকে গেল, ‘মা কি ভাবছে এভাবে আটকানো যাবে?’
রাতে খাওয়ার পরে একা ঘরে সিলিং-এ তাকিয়ে নিশ্চুপ শুয়ে থাকে, জানালার পাশের পেয়ারা গাছের একটা পাতা নড়ছে না। ঘুম আসে না, দিদিমার সঙ্গে কাটানো সময় মনে পড়ে, চোখে বাষ্প জমে। হঠাৎ ফোন-এ দেখায়, অর্জুন কলিং। এর মধ্যে ভাসা-ভাসা দু-একটা মেসেজ ছাড়া তার সণ্ণগে যোগাযোগ হয়নি। শ্রুতি খুশীমনে ফোন ধরে, অর্জুন বলে,
--কিরে
কী খবর?
--ভালো।
তোর?
--বিয়ে
করছি বুঝলি?
--দ্যাটস
গ্রেট। কবে? বাড়ি থেকে ঠিক করা?
--ওই
আর কী। দেখা করি চল পরশু, অনেক কথা আছে।
--আর হলো না রে ভাই, পরশু হায়দরাবাদ চলে যাচ্ছি।
চমকে ওঠে অর্জুন, তার গলার ঈর্ষার ঝাঁঝ ধরতে পেরে উতফুল্ল হয় শ্রুতি। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কেটে দেয়, অল্পক্ষণের মধ্যে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে।
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন