সমকালীন ছোটগল্প |
শঙ্খমুদ্রা অথবা আম্রপালি
ডানহাতে সুগন্ধি পরমান্নের পাত্র তুলে ধরেছেন ভগবান বুদ্ধের দিকে। আর বাঁহাতে ধরা থাকলো সমুদ্রের গাম্ভীর্যপূর্ণ কালচক্রের শঙ্খ নিনাদিত মুদ্রায় পার্থিব জগতের মঙ্গলের জন্য অপূর্ব দার্শনিক ভঙ্গিমা! এরপর সমাধিস্থলের শীতল শয্যায় শঙ্খমুদ্রা শেষবারের মতো পাশ ফিরে শুলেন। তাঁর আলুথালু চুল আর পরনের কুন্ডলী পাকিয়ে থাকা চক্রাকার কাপড় যেন মাটির গভীরে থাকা অনন্তনাগ! তাঁর দীপ্তিমতী দুই চোখের তারায় ধীরে ধীরে শীত ঘুমে যাওয়ার আগেই পুনরায় একদিন জেগে ওঠবার সংকল্পের আলোর বলয়। স্থির হয়ে সমাধি স্থলের শীতল দেওয়ালের দিকে চেয়ে রইলেন ভারতীয় নান্দনিক চিত্রকল্পের চমৎকার রূপক চরিত্র শঙ্খমুদ্রা।
এ অঞ্চলে বিবাহ নামক সৌন্দর্য দেখা নিষিদ্ধ একেবারেই। তাই, নৈব নৈব চ করেও এক সময়ে এমন হলো যে, অঞ্চলের নানা জাতির বিবাহ প্রথায় যে যে উপকরণ কাজে লাগে, যেমন হিন্দু বিয়েতে কলাগাছ, মুসলিম বিয়েতে হলুদের গাছ, এসব বনজঙ্গুলে চাষবাস প্রায়-ই বন্ধ হয়ে গেলো একদিন। আদিম যেসব গাছপালা ছিলো, তারাও উৎপাদন করতে করতে ছোটো বড় মাঝারি গাছপালায় জঙ্গলকে ভরিয়ে দিয়ে একসময়ে ক্লান্ত হয়ে বৃন্দাবনের পথে রওনা হলো।
ফলতঃ, এ-সব বলবার মতো বা পারস্পরিক কথোপকথন হওয়ার মতো কোনো কথাকার তৈরি হলো না। কেননা, বিবাহ যেখানে অসৌন্দর্যের বিষয়ের মধ্যে পড়ে, তখন একজন কথাকার কী করে তৈরি হবে? তাই বাধ্যতামূলকভাবে কলা আর হলুদের গাছ বৃন্দাবনের পথে যেতে যেতে মাটির নীচে শিকড়ে শিকড়ে পরস্পর কথা বলা শুরু করলো।
'কথা', এক বিশেষ ধরনের থেরাপি। মস্তিষ্কের ভেতরে থাকে মনোবীক্ষণ যন্ত্র। সেই অনাঘ্রাত জগতে, যেন সমস্ত শব্দ বাইরে বেড়িয়ে আসার জন্য প্রস্তুত হয়েই আছে। টেকনিশিয়ানের কাজ কেবল, মনের ভাব বোঝাতে যে আনন্দ বা দুঃখের অভিব্যক্তিগুলো এক জীবনের কোটোরে ডেরা বেঁধে থাকে, সেইসব পাখিসম অভিব্যক্তিগুলোকে ভাষার ডানায় ভর করিয়ে দিয়ে উন্মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেওয়া।
এসব ওড়াউড়ি খেলায় এখন বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে কলা ও হলুদ গাছ। তাদের আর বৃন্দাবনে পৌঁছানো হয়ে ওঠেনি। শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমির অদূরেই গড়ে ওঠা বৃন্দাবন নামের এক আম্রকাননে তারা ডেরা বেঁধেছে। খায় দায়। আর কীর্তনের লীলাখেলা খেলতে খেলতে একদিন পা পিছলে জন্ম দিয়ে ফেলে নানা রঙের মাধুরী মেশানো অনবদ্য আধুনিক শঙ্খমুদ্রাকে।
শঙ্খমুদ্রা, সে কোনো আশীর্বাদ বা অভিশাপ নয়। অথবা সে কোনোদিন কোনো মানবীয় বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহনকারী জীবও নয়। তবুও সে যেন কলাগাছ আর হলুদের বৈশিষ্ট্যে ভরপুর সমুজ্জল এক সর্পিল চলন্ত মহাকালের গহ্বরে নির্মিত সাবঅলটার্ন সাবওয়ে।
শঙ্খমু্দ্রার আলুথালু চুলে আঁচড় পড়েনি কতদিন। সেই বৌদ্ধ যুগ থেকে, সেই রাজা বিম্বিসারের গোপন প্রেমিকা হয়ে থাকার পর থেকে, তার হলুদ সবুজ চক্রাকার স্বৈরনীতির উদাহরণ দীর্ঘ কুন্ডলী ছাড়িয়ে, যুগান্তরের গ্রীষ্ম পার হয়ে, বর্ষার অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে যেন এখন, একাকার হয়ে গিয়ে মন্থন করছে মাটি। এখন, আর কোনো অজাতশত্রু নামে প্রেমিকরাজা তার পাশে নেই। নেই কোনো প্রতিবেশি যুদ্ধবাজরাজা। তবু, রাজা তো কেউ কেউ থেকেই যায়, যাদের হাতে থাকে তাদের সাম্রাজ্যবিস্তারী অদম্য আগ্রহের শেষ কথা। আর সেইসব কথাগুলোকে মুদ্রায় ধরে রাখবার জন্য একসময়ে নৃত্যপটীয়সী শঙ্খমুদ্রাকে আম্রপালির মতোই নগরবধু হিসেবে নগরের একপ্রান্তে সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা সমাধির নীচে চর্যাপদের ঘাই হরিণীর মতো মাটি কামড়ে ধরে থাকতে হয়।
এই সেই মাটি। মাটি মানে মা। মা মানে জমি। জমি মানে উৎপাদন, শ্রম, মালিকানা, সংগ্রহ, সঞ্চয় আর পরম্পরাগত চলাচল। শঙ্খমুদ্রা এতক্ষণ ধরে মন্থন করছিলো যে মাটি, তার মধ্যে শীৎকার উঠছে। আসলে, শীৎকার হলো একধরনের শানিত শাবল, যা দিয়ে সমাধির মাটি খনন করা হয়।
সমাধি-খানার কলাগাছের পাতাগুলো বারে বারে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে কথা বলছে। ভারিক্কি বাতাসে কেবলই মৃত্যুর খবর। আর এদিকে, হলুদ গাছেরা ইতিবাচক কথা বলে যাচ্ছে। এই যেমন, শঙ্খকে পুনরায় নৃত্যে ফিরিয়ে আনতেই হবে। পুনরায় শঙ্খের জন্ম হবে কোনো আম্রকাননে। অনিন্দ্য সুন্দরী ও অসম্ভব মেধাবী শঙ্খের নৃত্যরত মূর্তি দেখতে আসবে দেশবিদেশ-এর রাজন্যবর্গ। তাদের দেওয়া প্রতিদিনের পঞ্চাশটি কর্ষপান মুদ্রা থেকে যে বিদেশি আয় হবে, তা দিয়ে দেশ আবার নতুনভাবে দাঁড় টানতে টানতে দেশবাসীদেরকে নতুন এক জনপদের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এতক্ষণ পরে সমাধিখানায় যত্ন করে লাগানো লাল সাদা কাগুজে ফুটন্ত ফুলের মধ্যে থেকে সদ্য জন্মানো শিশুর কান্না ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে দমকা বাতাসে মৃতদেহের ওপরে চাপানো একজীবনের শেষ বস্ত্র উড়ে যাচ্ছে। উড়ছে শঙ্খমুদ্রার চুলের রাশি। অবিকৃত মুখের মধ্যে কতদিনের রুটি-রুজির জমানো কটা কর্ষপান পয়সা জ্বলজ্বল করছে।
অদূরে, বৌদ্ধ সহজিয়া চিন্তার জীবক শেষবারের মতো শঙ্খমুদ্রার পদ্ম পুষ্প শোভিত অন্ধ স্তনের ওপর দিয়ে সবুজ বিপ্লবের চাদরটা গলা পর্যন্ত টেনে দিয়ে বললেন – “সি ইজ নো মোর। বাট, সি ইজ লং-টার্ম লিভিং ইন আওয়ার স্পেস”।
আহা! বেচারি শঙ্খমুদ্রা ঘুমোচ্ছে! একমুখ পয়সার ওপরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে একচিলতে রোদ এসে ঝকমক করে গাইছে - বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি...
নির্জন অন্তিমকাল ফিসফিস করে মৃতদেহের কানের কাছে এইমাত্র বলে চলে গেলো, টাকাপয়সা কি কোনো মানুষ বা কীটপতঙ্গ খেতে পারে কোনোদিন, শঙ্খমুদ্রা??
আর কি আশ্চর্য! এই মুহূর্তে শঙ্খমুদ্রা যেন আম্রপালি। তার হাঁ মুখের মধ্যে ইতিহাসের বিম্বিসার থেকে অজাতশত্রু। সম্রাট অশোকের মুদ্রার মধ্য থেকে নৃত্যরত আদিম এক সর্পদেবী মনচাম্মা এবং গৌতমবুদ্ধ যুগ্মভাবে বয়ে চলে যাচ্ছেন লুম্বিনী তোলপাড় করে বৈশালী নগরীর দেয়াল ঘেঁষে, কপিলাবস্তু পেরিয়ে বিস্তীর্ণ এক ইউরেশিয়ান প্লেটের তলায় তলায়...
গল্পের বিষয় নির্বাচনে অভিনবত্ব রয়েছে। আগ্রহীদের পড়তে ভাল লাগবে। গতি রয়েছে। তবে এ ধরনের বিষয়ভিত্তিক লেখার গভীরে প্রবেশ করার মত পাঠকসংখ্যা নগণ্য।
উত্তরমুছুনশুভেচ্ছা রইল।।