কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩

শিবাংশু দে

 

'আয় রে প্রাণের সুবল...'




বারো জুলাই ছিলো ওর জন্মদিন। ফোন করলুম একটু বেলায়। দু-চারবার রিং হবার পরেই ধরলো।

-হঁ রে, ফিরলি?

-না রে, পরের হপ্তায়...

-কোথায় আছিস এখন?

-এই হাসপাতালেই, ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে বসে আছি।

-আবার কী বলছে ডাক্তার?

-বলছে আরেকবার একটা কেমো'র সাইকেল করতে।

-বলিস কী রে? আবার..?

-হঁ…

-তুই কী বললি?

-বললাম, মরে গেলেও আর কেমো করব না!

-হুমম, তবে কী করা যায়?

-এবার বাড়ি যাব। টিকিট হঁই গেছে।

তারপর যথারীতি নানা বিষয় নিয়ে কথা। প্রায় মিনিট চল্লিশ। শেষে ডাক্তারের ডাক আসতে কথা শেষ করতে হলো। আমি এখন কলকাতায় নেই। হায়দরাবাদে আছি। সুবলা জামশেদপুরে ফিরে এলেও দেখা হতে দেরি হবে। দিন হিসেব করে ফোন করলুম। রেবা ফোন ধরলো। খবর পেলুম সুবলা একেবারে শয্যাশায়ী। প্রচণ্ড যন্ত্রণা ভোগ করছে। কথা বলছে না। সাতদিন আগেই এতো কথা হলো। এতো দ্রুত এমন অবনতি? যদিও এই রোগে ব্যাপারটা ঠিক অপ্রত্যাশিত নয়।

সুবল দত্ত আমার বেশ কিছুদিনের বন্ধু। কিছুদিন, মানে ছেচল্লিশ বছর। ওকে চিনি সাতাত্তর সাল থেকে। আমি তখন কুড়ি, ও একুশ।  সেই বয়সে বাঙালিরা প্রথম দিন থেকেই তুই-তোকারি'তে উঠে যায়। এক্ষেত্রেও  ব্যতিক্রম হয়নি। সিংভূমে চলে মানভূমের প্রান্তিক বাঙালি ভাষা, নিয়মকানুন। এর মধ্যে অবশ্য 'জামশেদপুরি' কলচর বাদ যাবে। ওখানে ব্যাপারস্যাপার একটু কলকাত্তাই টাইপ। আমি যদিও আদতে কলকাত্তাই এবং চার পুরুষের 'জামশেদপুরি', তবু সিংভূম আমার জন্য মাটি-পাথর, বন-পাহাড়ের গ্রাম। মানভূমের নিয়ম অনুযায়ী সুবলের নামের শেষে আ-কার যোগ করে সম্বোধনের শুরুও তখন থেকেই। মানে, সুবলা। আমরা নিজেদের মধ্যে মানভূমিয়া ভাষাতেই কথাবার্তা বলতুম। সেই পুরাকালে  প্রথম চাকরি চাইবাসাতে। সিংভূমের 'রাজধানী'। তখনও আমার ভোটাধিকারের বয়স হয়নি। মানে পুরো একুশ। হয়নি। ভারতীয় স্টেট ব্যাংকে। সেখানে তার সঙ্গে দেখা। কারো কাছে খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছিলো। আমি  জামশেদপুর কোঅপারেটিভ কলেজ, সে চাইবাসার টাটা কলেজ। গায়ে পুরো দস্তুর কলেজের গন্ধ। সুবলার মাথায়  কোঁকড়া পপকর্ণ চুল, মোটা গোঁফ আর শ্যামলা চেহারা। মানবাজার থেকে আসা পাক্কা মানভূমিয়া। টাঁড়মাটির ছাপ সারা গায়ে। চরিত্রদোষ বলতে বাংলা সাহিত্যের প্রতি অকারণ বাতিক।  চাইবাসায় সে অর্থে  প্রথম বাংলা লিটল ম্যাগ 'উইঢিবি' নামক একটা কাগজটা প্রকাশ করে। নৈকষ্য 'বেকার'। শুরুটা এমনই ছিলো। তারপর সময়ের  বৃত্তে ঢুকে গেছে নানা প্লাবিত স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, ভালোবাসা, খিস্তি। ঢুকে গেছেন সন্তোষকুমার ঘোষ, সমীর  রায়চৌধুরী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি, সারান্ডা, কুচাই, খিচিং, লুপুংগুটু। চাপে পড়ে একটা ছোটো ইশকুলে 'বিজ্ঞান' পড়াতে ঢোকা। বেতন দিনে দু 'টাকা'। তবু বাঙালিরা তাকে 'চাকরি' বলে। আমার জীবনের প্রথম সৎকর্ম (জানি না শেষও  কি না? ) সুবলাকে রীতিমতো বলপ্রয়োগ করে তিন-চার মাস ধরে প্রতি সন্ধ্যায় ব্যাংকে চাকরি পাবার সুলুকসন্ধান শেখানো। যাকে বাংলায় 'কোচিন' বলে। এসব করে সে  এসবিআই'তে নাম লিখিয়েছিলো। কিছুদিন পরেই  ঝাইলদাতে বিহা।  এবং সিংভূম ছেড়ে  কয়লাকুঠির দেশে  অনিচ্ছার নির্বাসন। সারাজীবন ধানবাদ আর বোকারো নামক দুটি আধা গ্রামে মাথা ঠুকে কাটিয়ে দিলো। জায়গা বদল করতে অদ্ভুত অনীহা তার। বলি, আমাকে দেখ। এই চাকরি নিয়ে সারা দেশ ঘুরেছি। ভারতবর্ষকে চিনেছি। তোর জন্য ভালো পোস্টিং-এর ব্যবস্থা করে দেবো আমি। খুব ভালো থাকবি। দুনিয়াটা একটু বেরিয়ে দেখ। কাকস্য পরিবেদনা!

অবসরের পর জামশেদপুর। তবে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে। কারণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলুম আমিও ফিরে আসবো। আমার গ্রামে। সেখানে থাকবো। নয়তো ওই শহরে সে অর্থে 'নিজের' বলতে সুবলার কেউ নেই।  আমার জামশেদপুর ফেরা হলো না। সেজন্য প্রচুর গালাগালি খেলুম ওর কাছে। শেষে ঠিক হলো সুবলাই কলকাতা চলে আসবে। ব্যাপারটা নিয়ে অনেক দূর এগোনো হয়েছিলো। তাও হলো না। অসুস্থ হয়ে পড়লো। কয়েকটা বই ছাপানোর আগে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে ছিলো। আমার 'মতামত'-এর জন্য। কিন্তু এভাবে হয় না। ওর ভাবনার জগৎ , ক্র্যাফ্ট, আমার সঙ্গে মেলে না। বললুম, তোর ফিজিক্স-মেটাফিজিক্সের টানাপোড়েন, গদ্যনির্মাণ, ক্রিয়াপদ ব্যবহার, স্পেস, পজ, রিদম কিছুই মিলবে না আমার সঙ্গে। শুধুমুদু দ্বিধায় পড়ে যাবি। তুই নিজের আনন্দে লেখ। তার মধ্যে আমি নাক গলাতে চাই না। ভুল বোঝেনি। জানতুম।

ছেচল্লিশ বছর আগে যখন তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো, তখন থেকেই আমার মনে হয়েছে সুবলার গল্পটা ইউনিক। একটা টিভি সোপ অপেরা হয়ে যেতে পারে। কোষ বিবর্তনের সন্ধান যাঁরা করেন, তাঁরা জানেন সেল মিউটেশনের থিওরি দিয়ে ওর মানসিক বিবর্তনটি বোঝা যেতে পারে। এক পুরুষের মধ্যে ওর পূর্বপুরুষদের থেকে নিজেকে কীভাবে আলাদা করেছিলো, সেটা নিঃসন্দেহে মনজাগানি। কোনও রকম পারিবারিক উত্তরাধিকার ব্যতিরেকে ছবি আঁকে, মূর্তি গড়ে, গান গায়, কবিতা লেখে, তুখোড় গদ্যকার, সঙ্গে প্রশ্নহীন গুরুবাদী। জিরাফ ও ধর্ম নিয়ে লোফালুফি করে আরাম পায়। অন্তত পেতো। কোনও এক সময়। মাস তিন-চার আগে ফোন করেছি একদিন সন্ধেবেলা। খুব কষ্ট পাচ্ছে তখন। বলি, হ্যাঁরে তোর ভগবান আর গুরুদেবকে একবার জিগ্যেস করিস, তোর অপরাধটা কী? খবরদার, গীতার কচকচি আওড়াস না আমার কাছে। রক্তমাংসের এই সামান্য শরীরটাকে যে এতো যন্ত্রণা দেয়, সে আবার সর্বশক্তিমান?? গোবিন্দ দাস পড়েছিস তো? এরা সব চিতায় মঠ দেবার দেবতা। সে বলে, জানি। ওসব একেবারে ভাঁওতাবাজি। তুইই ঠিক বলতি। আমি দেরিতে বুঝলম।  একটা অদ্ভুত সারল্য ছিলো ওর মধ্যে। টাকা ধার নেওয়া লোকজন উল্টে ওকেই চোখ রাঙাতো। অথবা উজবুক 'লেখক' জনতা। যাদের নিজেদেরই কোনও আক্কেল নেই, সুবলাকে এগিয়ে এসে জ্ঞান দিতো। কলকেতা শহরে লেখালেখির দুনিয়ার নামী লোকজনের সঙ্গে বাজে অভিজ্ঞতা হলে বলতো। আমার কানে এলে  খুব খারাপ লাগতো। এইসব দুনিয়া আমি খুব চিনি। নিস্পৃহ থাকার জন্য তাকেই বকাবকি করতুম। আমার বকুনি শুনে গোঁফের ফাঁকে তৃপ্তির হাসি ছাড়া আর কোনও প্রতিক্রিয়া দেখিনি কখনও। একবার বোকারোতে ওর বাড়িতে যথারীতি আমার বকুনি বেশ তারিয়ে তারিয়ে  ‘উপভোগ’ করছিলো। ওর মেয়ে, আমাদের আদরের পুঁচকে মামনি, আমায় এসে বকে দেয়। আমার বাবাকে এতো বকবে না তুমি।

আমার  কলকাতায় আসার পর অন্য একটা শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য সুবলা মাঝে মাঝে  আসতো এখানে। আমার বাড়িতেও থেকেছে। ভেবেছিলো আমার পাশেই একটা ফ্ল্যাট নিয়ে কলকাতায় এসে থাকবে। টাকা আগামও দিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু হলো না। ২০১৮-র ঘোর গ্রীষ্মে সুবলা হঠাৎ জানালো বি এম বিড়লাতে ভর্তি হয়েছে। বাইপাস হবে। সেসব হলো কলকাতায়। এক-দেড়মাস ধরে নানা টানাপোড়েন। সেই সময়টায় দেখা হচ্ছিলো নিয়মিত। একটু ভালো হয়ে ফিরে গেলো জামশেদপুর। মাস দেড়েক পরেই ফোন এলো তার। নিস্পৃহ অনাসক্ত কণ্ঠে জানালো তাকে ইমার্জেন্সি অবস্থায় ভেলোরে আসতে হয়েছে। ডাক্তার বলছেন তার বাজে রকম 'কর্কট' রোগ হয়েছে। চিকিৎসকের বিভ্রান্তিজনিত কারণে বেশ ছড়িয়েও গেছে। তখনও বুকের অপারেশনের ঘা-গুলো হয়তো ঠিকঠাক শুকায়ওনি। এই খবরটা কীভাবে নেবো, ভাবতে সময় গেলো  বেশ কিছুটা। নিরুপায় মানুষ যেমন ভাবে। তাদের  মনে হয়, এসব কী হচ্ছে?

কেমোর প্রথম সাইকেল চলছিলো তখন। আঠেরোর ডিসেম্বরে আমার ছোটো মেয়ের  বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।  আসতে পারবে না সেই দুঃখে  সুবলা ফোনেই  কাতর হতাশা জানাচ্ছে। আমি বকাবকি করি। আগে ভালো হয়ে ওঠ। গুরু বলেছেন, 'সত্য যে কঠিন' এবং তাকে ভালোবাসতে হবে। কীভাবে বাসা যায়, তার মেড ইজি তিনি কিছু বলে দিয়ে জাননি। টানা সাতমাস ধরে অসম্ভব একটা যুদ্ধ দিলো সুবলা আর রেবা। অসম লড়াই। কিন্তু ওদের তেজ তাতে কম হয়নি একেবারে। কী ধরনের অসহনীয় শরীরকষ্ট, যাঁরা জানেন তাঁরাই জানেন। ল্যাপটপ সঙ্গে নেই।  মোবাইল ফোনে বড়ো বড়ো লেখা প্রতিশ্রুতি মতো পত্রিকার সম্পাদকদের পাঠিয়ে গিয়েছে ঐ অবস্থায়। অবশেষে বাড়ি ফিরে এলো। এর মধ্যে বিদেশে ছেলের বাড়িও ঘুরেটুরে এলো দুবার। কিন্তু আরোগ্য হলো না। সামলে নিতে চাইছিলো নিজস্ব যাপন, যথাসাধ্য। ভেলোর থেকে মাঝে মাঝে ফোন করে বলছে, বড্ডো কষ্ট রে! আমি ওকে পূর্ণদাস বাউলের লিংক পাঠাই,  'শোনরে  প্রাণের সুবল, হেরি ঐ নয়নযুগল, চল আজ যমুনা পুলিনে যাই।'

দু হাজার ঊনিশে জুন মাসে হঠাৎ দিন দুয়েকের জন্য জামশেদপুর যাওয়া হলো।  সুবলার সঙ্গে দেখা হওয়াটা জরুরি। মারণ রোগের বিরুদ্ধে প্রথম দফায় যুদ্ধজয়ের পর তাকে অভিনন্দন জানানোটা ঠিক 'কর্তব্য' নয়। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ বলাটাই বিধেয়। ওর বাড়ি যাওয়া হয়নি। কদমাতেই একটা অনুষ্ঠানে দেখা হলো। স্বয়ং ডন এবং তার সাংকো পাঞ্জা রেবার সঙ্গে। স্রেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোলা মাঠে আড্ডা হলো কতক্ষণ।  জামশেদপুরে শ্বাসরোধী গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায়। যতক্ষণ না তার শারীর ক্লান্তি ছাপিয়ে যায় মানসিক  আবেগের জলস্তর।

মাঝখানে ফোন করলো। কোনও এক সাহিত্যকর্মী বন্ধু নাকি উদ্যোগ নিয়েছেন তাকে নিয়ে একটা স্মারক সংকলন প্রকাশ করবেন। বলি, অতি উত্তম সংবাদ। তখন বলে, তুই একটা লেখা দিবি? নিশ্চয়ই দেবো। তবে লেখাটার মধ্যে ব্যক্তিগত সন্দর্ভ থাকবে। তোকেই পাঠাবো। দেখে নিস। তা লেখা পড়ে সে উচ্ছ্বসিত। কিছুদিন আগে ভেলোরেই ওকে  জিগ্যেস করলুম, হ্যাঁরে বইটা প্রকাশিত হয়েছে? বললো, তৈরি হচ্ছে। বেরোবে। জানি না, সেই বই সুবলা দেখে যেতে পেরেছে কি না।

ওর সঙ্গে শেষ আড্ডাটা জুলাইয়ের বারো তারিখেই। ‘শুভ জন্মদিন’ বলার জন্য ফোন করেছিলুম। শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে কথাবার্তা হবার সময় আমি বললুম তুই কেন ইমিউনিটি বাড়াবার জন্য নিউক্লিয়ার চিকিৎসাটা করতে গেলি? এক একবার ছুঁচ নিতে সাড়ে তিন লাখ খরচ। তারপর তিনদিন তেজস্ক্রিয় বালক সেজে লোকজনের থেকে দূরে দূরে থাকা। 'মানুষ' থেকে গিনিপিগ হয়ে যাওয়া। সুবলা বলে, ঠিক বলেছিস। দুবার ঐ তেজস্ক্রিয় ছুঁচ খাওয়া একেবারে হিতে বিপরীত হয়ে গেলো। বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। শোন মজার গল্প একটা। বুঝলি, ডাক্তার আমাকে নিউক্লিয়ার রেডিয়েশন, আইসোটোপ, হাফ লাইফ নিয়ে বেশ লেকচার দিচ্ছিলো। আমিও চুপচাপ শুনছি। হঠাৎ এমন একটা কথা বললো যেটা ফিজিক্সে নেই। আমি শুধরে দিতেই বলছে 'বাবা, আপকো ক্যয়সে পতা?' আমি বলি, তুই কি বলে দিলি? ফিজিক্স ব্যাপারটা ডাক্তারের থেকে বেশি বুঝিস? বলে, না রে। এমনিতেই ইংরেজি বলছিলাম দেখে ডাক্তার একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলো।  আরও একটা রগড়ের গপ্পো শোন। ইন্সিওরেন্সের ফর্ম যখন ভরছিলাম, কাউন্টারের মেয়েটা আমাকে শিখিয়ে দিলো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বরটা কীভাবে ভরতে হয়। লম্বা নম্বর তো। আমি বলি, দাড়িটা কেটেছিস, না ওরকমই বাবাজি সেজে রয়েছিস। নারে, কাটা হয়নি। এবার বাড়ি গিয়ে কাটবো। বলি, সে জন্যই তোকে গাঁয়ের বাবাজি ঠাউরেছে ওরা।  চাইবাসার জয়দেব দত্তের কথা ওঠে। অমন বাবাজির মেক আপ নিয়ে তাজ হোটেলে কর্পোরেট শেয়ারহোল্ডার্স এজিএমে ঢুকতে গেলে দ্বারপাল যেভাবে আটকে দিয়েছিলো ওঁকে। খুব খোশমেজাজে ছিলো সুবলা ওই দিন। বললুম, তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যা। একবার তুই আর আমি চাইবাসায় অশোকদার সঙ্গে দেখা করতে যাবো। আবার আড্ডা হবে অনেকক্ষণ। যেমন হতো এককালে। ঘন্টার পর ঘন্টা।

রেবার কাছে শুনলুম আমার সঙ্গে কথা হবার দু-চার ঘন্টার মধ্যেই  নাকি অসম্ভব শরীর কষ্টে এলিয়ে পড়েছিলো। ওর জন্মদিনেই। কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলো। ভাবি, মানুষের জীবনটাই এরকম। পর মুহূর্তটি কোন ইত্তিলা  নিয়ে আসবে, কে জানে?

অভ্যেস বশে রোজ ফোন করি। রেবা'কে, মামনি'কে। কোনদিন ওরা ধরতে পারে। কোনওদিন পারে না। নতুন খবর তো আর কিছু নেই। তিরিশ তারিখে সাঁঝের দিকে মামনির ফোন। খুব কাঁদছে। কাকু, বাবা চলে গেলো। হয়তো মনে মনে চাইছিলুম সুবলা মুক্তি পাক এই অবর্ণনীয় শরীর কষ্ট থেকে। হয়তো সেটাও পুরো সত্য নয়। ছেচল্লিশ বছর ধরে তৈরি হওয়া একটা অতি জীবন্ত সম্পর্ক হঠাৎ 'নেই' হয়ে গেলে নিজস্ব ঐহিক সত্ত্বাটিও খান খান হয়ে যায়। আমরা পরস্পরের অনেক গোপন কথা জানি। 'বন্ধু' হয়ে থাকার মূল্যটি শতকরা একশো ভাগ মিটিয়ে দিতে আমাদের কোনও দ্বিধা ছিলো না।

এই লেখাটি যখন লিখছি, মামনি ফোন করলো। কাকু, ওরা বাবাকে নিয়ে গেলো। মা বলছে, কাকুকে খবরটা দিয়ে দে। আমাদের শহরে মানুষের গঙ্গালাভ হয় না। সুবর্ণরেখা-লাভ হয়। সুবলারও তাই হলো। ও'তো এসব ব্যাপার বিশ্বাস করতো। তাই আর বকবো না ওকে।

চার বছর দেখা হয়নি। কোভিড ইত্যাদির চক্করে আমার জামশেদপুর যাওয়া হয়নি। একবার যখন গেলুম, তখন সুবলা ভেলোরে। শেষবার যখন দেখা হয়েছিলো তার কথা লিখেছিলুম ফেবু'তে একটা পোস্টে। সেটা পড়ে সুবলা লিখলো,

'তুই এতো লম্বা চৌড়া, আমার বহুদিনের বাসনা তোকে জড়িয়ে ধরি, কিন্তু কুন্ঠিত। পারিনি। এখন অদৃশ্য আমার কৃষ্ণ সখাকে তাই করলাম।'

সবই মনে থাকবে রে সুবলা। তুই খুব ভালো থাকিস...


2 কমেন্টস্:

  1. মন ছুঁয়ে গেল... আমাকে কয়েকটা নিজের গানের অডিও পাঠিয়েছিলেন! এত স্পিরিট! চেয়েছিলেন উনার বইয়ের একটা রিভিউ দিই...সেটা দেয়া হয়নি খুব আফসোস!

    উত্তরমুছুন
  2. দেবাশীষ চক্রবর্তী১৭ আগস্ট, ২০২৩ এ ৮:১৫ PM

    মন ছুঁয়ে গেল লেখা টা পড়ে। খুব কাছের ছিল আমার আর চন্দনের, আমাদের সুবলা,আদর করে ডাকতাম সক্রেটিস। কথা হয়েছিল ফিরে এসে জামসেদপুরে দেখা হবে। ফিরল, যখন গেলাম তখন আর নেই।

    উত্তরমুছুন