কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩

মৌ চক্রবর্তী

 

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি # থিয়েটার # ধ্বস # সোহাগ সেন   

 


প্রতি,

এবারের কিস্তির আলোচনায় মনে পড়তে পড়তে গেল পৃথিবীর যুদ্ধ ইতিহাস থেকে মানুষের মৃত্যু, ভয়, আতঙ্ক এবং জন্মতেও যে ভয় থাকে সেরকম কিছু ঘটনা। যা বীভৎস এবং এখন নিয়মমাফিক আন্তর্জাতিক পরিসরে ঘেঁটে বেরানোর ফলে, এক দুঃসহ ইতিহাসের বাহকও বটে। ইতিহাস থেকেই এই নাটকের প্লট বা ঘটনা। যা একুশের দ্বিতীয় দশকে কল্পিত। হলেও, বাস্তবের সঙ্গে মিল নেই এমনও নয়। তাই, সর্বজননী মাধ্যমে নাটকটি নিয়ে লেখা।   কিস্তি লেখার আগে এমন একটি প্রযোজনা দেখা হয়েছিল, যেখানে 'ধ্বস' মানে এক বিশ্বের ভয়ার্ত ইতিহাস। 'ধ্বস' – অনসম্বল-এর নতুন নাটক। বিষয় অভিনব। প্রযোজনায় মেধা ও প্রজ্ঞা, শৈল্পিক নাট্য ভাবনাকে জারিত করে। আসলে, মঞ্চনাটক যে এক ভিন্ন ভাষার অভিব্যক্তি। সম্প্রতি পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ, যা মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রে এক ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ। সেখানে  অনসম্বল নাট্যদল একশোয় একশো পেয়ে উত্তীর্ণ। 

একদিকে তাঁদের সুখ্যাত করছেন একবাক্যে মঞ্চকর্মী এবং নাট্যাননে থাকা দীর্ঘদিনের কর্মীরাও। এই তো পুরস্কার। যেখানে বিজ্ঞাপন করে সর্বজনীন হতে হয়নি। লেখার জন্যেই জিজ্ঞেস করতে হচ্ছিল, আর তাতেই একাডেমির জনৈক কর্মী জানালেন যে, ওদের নাটকের ধরণ একটু আলাদা। দেখুন, তাহলেই বুঝবেন।

প্রথমেই যেখানে যাই আটকে যে, টিকিটের দাম। এখানে সব টিকিটের দাম ২০০ টাকা। দারুণ ব্যাপার।

        তাহলে বক্স আর্ট এবং আর্টিস্ট নেই?

        রয়েছেন তো। অসিত বসু, তাঁকে কে না চেনে!

        রয়েছেন সোহাগ সেনও।

        কিন্তু টিকিটের দাম থেকেই বোঝা যায়, দলটি চায় তাদের নাটক বেশি লোকে দেখুক।

        অর্থাৎ, তারা যে সাধারণ মানুষের জন্যে কাজ করছেন, তাতে ফাঁক নেই।

দ্বিতীয় বিষয়টি হল, দলের অভিনয়। বেশ লাগে কারণ সবাই পরিণত শিল্পী। এবং প্রত্যেকেই নিজের অভিনয়ে উত্তীর্ণ। কিন্তু এরপরেও একটা বিষয় থাকে – বিশেষত নাটকের মতন যৌথ মাধ্যমে। যেখানে ব্যক্তি নয়, দল যৌথভাবে অভিনেয় কলা পরিবেশন করে থাকে। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, নাটকের সূচনা পরিবার পরিসরে হয়ে নাটক পৌঁছে দিচ্ছে দেশ- রাষ্ট্রের সীমানায়। যেখানে এক শিশুর জন্ম, মানুষের আবেগের প্রকাশ – সবই নিয়ন্ত্রিত। মনে পড়ে গেল, স্কুলবেলায় পড়েছিলাম, খ্যাতনামা এক কবির লেখা – তাঁর কবিতার বক্তব্য ছিল এই যে, পৃথিবীতে যুদ্ধ, ধ্বংস প্রলয় যাই ঘটুক না কেন – তিনটি বিষয় থাকে অব্যাহত। জন্ম মৃত্যু ও ভালোবাসা।

বলা যায়, নাটকের অন্দরের কথা এটিই। যেখানে এক শিশুর জন্ম, ভালোবাসার জীবনের আবেগও নিয়ন্ত্রিত করার আদেশ। এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু যেভাবে নাটকের বুননে পরিবেশিত হয়েছে – তা সাধুবাদ যোগ্য।   

শুধু তাই বললেই শেষ হবে না এক্ষেত্রে। বিষয় নির্বাচন নিয়েও যে তাঁদের দক্ষতা অতিশয় চেতনাসম্পন্ন। এসময়ের প্রতিচ্ছবি হল ধ্বস।  – অনসম্বল-এর নতুন নাটক। পোস্টার দেখলেই মনেহচ্ছে আবছা কি যেন।

মূল নাটকের রচনাকার হলেন তুর্কি নাট্যকার Tuncer Cucenoglu ।আমৃত্যু।  তাঁর জন্ম ১০ এপ্রিল, ১৯৪৪। মৃত্যু  ১৬ জুলাই, ২০১৯। Avalanche মূল নাটক। অনুবাদে নাম ধবস।নাটকের অনুবাদক সোহাগ সেন ও কৌশিক বসু যুগ্মভাবে।

Tuncer Cucenoglu একদিকে গল্প এবং অন্যদিকে নাটক --  দুইই লিখেছেন। এবং তিনি এমন এক নাট্যকার যার নাটক বিশ্বের ৩৫টি দেশে মঞ্চস্থ হয়েছে। আমাদের দিক থেকে আনন্দের যে তাঁর নাটকের অনুবাদ করেছেন সোহাগ দেন-কৌশিক সেন। এবং তাঁদের দল অনসম্বল এটি মঞ্চস্থও করেছেন।

নাট্যকার Tuncer Cucenoglu-র নাটকের দ্বারা পুরস্কারের সংখ্যাও কম নয়। দেশে এবং বিদেশে মোট ৩২টি পুরস্কার পেয়েছেন। ফ্রান্স তাঁকে বিশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তিনি তুর্কির চেখভ বা মায়েস্ট্রো বলেও পরিচিত। তাঁর লেখা নাটকের মূল প্লট হল এক স্বৈরাচারী শাসকের শাসনে কীভাবে জন-জীবন নির্ধারিত হচ্ছে, তা দেখানো। আর একটা শব্দ বারবার ফিরে আসছিল সমগ্র নাটকে। তা হল, "কাউন্সিল"।  যার কথায় এলাকায় চলে সম্পূর্ণ স্বৈরশাসন। ক্রমাগত ভয়ের মধ্যে জীবনধারণ করে চলে বাসিন্দারা। তাদের প্রতিবাদহীন করে রাখে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে।এবং একটি হাসির অনুরণনে যে ধ্বস নামতে পারে, সেও সিম্বলিক। যা নিরন্তর নিয়ন্ত্রণ  করছে জনজীবনের সূক্ষ্ম আবেগ অনুভূতি। এখানে তুষারপাত ও বরফ গলে যাওয়া এক প্রাকৃতিক চিহ্নের মধ্যের এক প্রতীক। যারমধ্যে থেমে সমগ্র মানবজীবন।

নাট্যকার শুধুমাত্র যে একটি বিশেষ স্থানের নিরিখে বা ভূগোলে আলোচনা করেছেন, তা নয়। বরং তিনি সমগ্র বিশ্বের নিরিখে প্লট লিখেছেন। যে কারণে পৃথিবীর বহুদেশেই তাঁর নাট্য-অনুবাদ হয়ে মঞ্চস্থ হয়ে থাকে। 'অনসম্বল'-এর  ধ্বস পরিবেশনার পারিপাট্য বেশ লাগল। একটি নাট্যদল যাদের বয়স ৩৮ বছর, তারা যে পরিণত সে নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের এই যে পরিণত-ঘরানা তাতে এমন বিষয়ের উপর কাজ দেখা যায় না। সেদিক থেকে দলের প্রতিষঠাতা সোহাগ সেন যথেষ্ট বিবেচক।

নাট্য-গবেষণার জন্যে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে জেনেছিলাম, থিয়েটারের এই দিকটা তাঁর পছন্দের। যেখানে থিয়েটারের বক্তব্য ছোট এক কেন্দ্রে আটকে থাকবে না। তিনি জানিয়েছিলেন, " থিয়েটার করি কেন, সামাজিক কয়েকটি সমস্যা নিয়ে কথা বলতে নয় শুধু। বিশ্বজুড়ে থিয়েটারের পরিধি। এবং তাই তার বিষয়ও হবে আন্তর্জাতিক। যেই পরিধিতে প্রসব করার সময়, তার অসময় হলে পরীক্ষার জন্যে শাসকের নির্ধারিত ব্যক্তির আসা, তা নিয়ে মতান্তর, ক্রমাগত ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ, ঘোষণায় সামান্য শব্দ করা নিষিদ্ধ। থেকে চলতে থাকে হাসি কান্নার শব্দও চুপচুপে, ফিসফাসে। যেখানে নির্ধারিত সময় ব্যতীত প্রজননও নিষিদ্ধ।

এক পরিবারের ভিত্তিতে প্লট ধরা। যেখানে পারিবারিকভাবে ঘটে চলা ব্যক্তিজীবনের ঝগড়া, তর্ক, ভালোবাসা – সবই ফিসফিস করেই হবে। যেখানে কন্ঠস্বর তুলে কথা বলা এই। আর বললেও পরিবারের লোকেরা চুপ করিয়ে দেয়। একটু বেশি জোর হলেই নাকি ধ্বস নামবে। কিন্তু ধ্বস কাকে বলে, ধ্বস আসলে কি? এই বার্তা কি দিচ্ছে না যে, স্বাভাবিক জীবন যেখানে স্তব্ধ। সেখানে মৃত্যুই বা টিকে থাকবে কতদিন। বা সেখানে উচ্চস্বরে তো দূরের কথা স্বাভাবিক স্বরেও কথা নিষিদ্ধ। এবং শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তা সে গর্ভবতী হলেও। এই শাস্তির বাইরে এমনকি অশীতিপর অসুস্থরাও নন। ফলে, বোঝা যায়, এর অর্থ গভীরে এবং সচেতন করায় স্বাভাবিক জীবন তাহলে এভাবেই আতঙ্কে কাটছে। 

নাটকের অভিনয়ের চরিত্রায়নে অতি বৃদ্ধ ঠাকুরদার ভূমিকায়  অসিত বসু। তিনি মঞ্চে যে অভিনয় করছিলেন তার মধ্যে সিগারেট ধরে রাখা, কাশি আর শেষে বন্দুক বাগিয়ে ধরা পর্যন্ত – সবটাই অনবদ্য। এক প্রবীণ অভিনেতার মঞ্চ অভিনয় যেন মঞ্চ ব্যাকরণ শিক্ষা দিচ্ছিল। কথা বলতে বলতে ঘুম চলে আসা এক অতি সাধারণ বৃদ্ধের ভূমিকায় তিনি অন্যতম।

মঞ্চের পর্দা খোলা থাকাতেই এক মহিলার উঠে এসে লুকিয়ে বিস্কুট জাতীয় খাবার নেওয়া। আধো অন্ধকারের মধ্যে তিনি যে অভিনয় করছেন, সেটাই বুঝতে হয় 'ন্যাচরাল অ্যাকটিং' অর্থাৎ, স্বাভাবিক অভিনয়। বৃদ্ধের স্ত্রী-র চরিত্রে তিনিই, একদিকে নির্দেশক অন্যদিকে অভিনেতা সোহাগ সেন। তিনি প্রথমে সোফা থেকে অভিনয় শুরু করেন। এবং খুঁড়িয়ে চলা এক বয়স্যা হিসেবে। এবং মঞ্চের অনেকটা ব্যবহার করে উন্মুক্ত করলেন নিজের চরিত্রটিও। এবং ঘটল নাটকের – মূল ভাব উন্মোচিত হল। যেখানে দ্বন্দ্ব সমন্বয় ঘটল।

যেখানে বৃদ্ধা চরিত্রে সোহাগ সেনের দুর্দান্ত অভিনয়। একই লয়ে বয়স্য চেতনা, একঘেয়েমির বৃদ্ধ থেকে এক লহমায় ক্রোধের প্রকাশে অভিনেতা অসিত বসু।  

মঞ্চ ভাবনা সাধারণ হলেও, নাটকের নির্মাণে একদিকে উঁচু বিছানার অবস্থান। ঠিক পাশেই ঘরের নির্মাণ বোঝাতে খাবারের টেবিল চেয়ার। তারই সঙ্গে একটা সোফা আর আপ স্টেজে একটা টেবিল-আলমারিতে খাবারের থালা, চায়ের সরঞ্জাম। এক মধ্যবিত্ত জীবন আভাস রেখে দেওয়া। এবং,  দেয়ালে রাইফেল এবং বন্দুক।



শুধু যে ভয়ের কারণে প্রশ্নহীন হয়ে যায় মানুষ, তাই হল নাটকের কেন্দ্র। যখন প্রসব হয়, তখন ধ্বস আসে না। আর শাসক যে প্রতারণা করছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরফলে, নাট্য-ঘটনার মধ্যে দিয়ে এক রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া হয়। যা কালের দাবি। ইতিহাস জানে, হিটলার, মুসোলিনিদের নাম। এবম মৃত্যুর বীভৎসতায় এক কাল্পনিক শুভ্র তুষার যে কত কালো আর ভয়ানক হয়ে যায়। তারজন্যেই নাট্য প্রযোজনার সার্থকতা। নাট্যদলকে বিষয়টি নির্বাচনের জন্যে সাহসী সাধুবাদ জানানোর।

সূত্রে মনে পড়ল, অভিনয় থেকে নির্দেশনা প্রসঙ্গে সোহাগ সেন-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, কেন তিনি নাট্য-নির্দেশনায় এলেন?

তিনি বলেছিলেন যে, নিজের মতন বিষয় নিয়ে নাটক করা যায়।

 বুঝি তাই। তিনি সার্থক রূপকার।  

নাট্যের আবহ - শব্দ রূপায়নে কৌশিক বোস এবং কৌশিক সজ্জন বিশেষ উল্লেখের। আলোচ্য নাট্যে শব্দের বিশেষ ভূমিকা চলেছে জলের ফোঁটা গর্তের মধ্যে পড়ার শব্দ। যা একদিকে নাট্যের মূল আবহ। আলোচ্যের যে আলোর ব্যবহার যথাযথ ও স্বাভাবিক। এবং প্রায় একই থাকায় এক মেলবন্ধন ঘটে। আর এই সঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়ার যে প্রতিবাদের জন্যেই একসময় নিউ ইয়র্কে গ্রুপ থিয়েটার নামক দলের সূচনা। পরে যা এদেশের সংস্কৃতিতে গ্রুপ থিয়েটার বলেই ব্যবহার হয়ে আসছে। শুধু তাইতেই তো থিয়েটার থামবে না, যদি সেই বিশেষ বিশেষ্য ব্যবহার করে থাকি, তবে প্রতিবাদহীন তার মূল্যায়ন থাকে কই … ? 

 _ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী…


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন