কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩

উপল মুখোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


কবিতা লিখুন খিস্তি দিয়ে, জাটেল্লির মতো

একজন কবি বাদশাহের সিক্কা নিয়ে ইয়ার্কি করেছিলেন। বাদশাহের কাছে খবর দিল। সবসময়ই বাদশাহদের কাছে খবর দেওয়ার লোক থাকে। এখনো খবর দেওয়ার লোকের অভাব আছে কি? খবর ঠিকই চলে যেতে থাকে বাদশাহদের কাছে। তাঁরা খবর পাওয়ার পর মোটেই উত্তেজিত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এই বাদশাহ জানতেন তিনি কিছুদিনের মধ্যেই মারা যাবেন। বাদশাহ দেখতে থাকেন তাঁকে প্রথমে অন্ধ করে দেওয়া হল। তিনি দু চোখে গরম কিছু ঢেলে দেওয়ার ফলে ছটফট করছেন। দিনের আলো দরবারের অপূর্ব কাঠের কাঠামোকে উজ্জ্বল করে তুলেছে, অপূর্ব সব গুল্মলতা খোদাই করা, চারদিক পরিষ্কার। বাদশাহ দেখতেও পাচ্ছেন সব অথচ তিনি এরূপ দেখেন কেন? এটাই ভাবার বিষয়, মনের চোখে ভবিষ্যত পরিণতি দেখতে পাওয়া। দরকার হল এর থেকে বেরিয়ে আসা। বেরিয়ে আসা চাইই। বাদশাহ বলতে থাকেন, ''কিছুতেই দেখব না!"

-- কী জাহাঁপনা?

-- ভবিষ্যত।

-- জি।

-- কিছুতেই না!

-- জি হুজুর।

-- কী বলবে বল?

-- জাফর জাটেল্লি হুজুর।

-- সেই কবি যে জবানে হিন্দভি খিস্তি জুড়ে দেয়!

-- সেই মীর জাফর জাটেল্লি হুজুর।

-- এবার কী কী করেছে?

-- বেশি কিছু নয়।

-- তবে জানাতে এসেছ! বেয়াদবি!

এই বলে বাদশাহ মুখ ফিরিয়ে নেবার ভান করলেন। এই ভান করতে গিয়ে তাঁর চোখ আবার ভবিষ্যতে চলে গেল। তিনি আতঙ্কে চিৎকার করতে গিয়েও চুপ করে যান আর চোখ বুজে আতরের খুশবু উপভোগ করতে থাকেন। ভাবেন এক সেনা অভিযানে যাবেন কিন্তু সে সাহস তাঁর নেই। বাদশাহের সাহসের খামতির কথা দরবারী জানে, তাই সে আবার খিস্তিবাজ কবির কথা বলে, জাটেল্লির কথা। যাঁর শক্তির কোন সীমা ছিল না, সেই বাদশাহ আলমগীরের ছেলে শাহাজাদা কাম বক্সের কাছে কাজ করতেন ওই  জাটেল্লি। কী একটা কারণে শাহাজাদা চটিয়ে ছিলেন কবিকে।

কবি লিখলেন :

জাহ শাহ ওলা গহের কাম বক্স

কা ঘাচি বুরকর্দ বা বক্স

ওয়েল ডান, ও প্রিন্স কাম বক্স

দ্য লিটিল ওপেনিং অফ দ্য গোট ইস রাপচার্ড ইনটু এ গ্যাপিং হোল।

শাবাশ শাহজাদা কাম বক্স

ছাগলের পেছন মেরে খাল করেছ।

ঔরঙ্গজেব আলমগীর হেসে শাহজাদাকে উত্তেজিত হতে বারণ করে করলেন। উল্টে পুরস্কার পেলেন জাটেল্লি। পুরষ্কার পেলেও ঔরঙ্গজেবকে ছাড়েননি।

কবি লিখলেন :

জাহে ধাক আওরং শাহ-ই ওয়ালি

দার ইকলেম দাখান পারি খালবালি

দারেন পির সালি ওয়া জোফ বদন

মাচায়ই ধামা-চৌকরি দার দাখান

কী কারবার! মহান আওরং শা পীর-ওয়ালি

যাঁর জন্য দাক্ষিণাত্যে যত খলবলি

এ বয়েসে যখন মুখের চামড়া গেছে ঝুলে

নাছোড় তিনি, দাক্ষিণাত্যে যত ক্যাঁচালের মূলে।

আবারো ঔরঙ্গজেব হেসে হেসে জাটেল্লিকে ছেড়ে দিলেন পুরস্কার দিয়ে। কারণ পুরস্কার না দিলে কবি ফার্সি  -হিন্দভি মিশিয়ে আবার খিস্তি করে কবিতা লিখবেন আর সে কবিত ছড়িয়ে যাবে লোকের মুখে মুখে।

এখনকার বাদশাহও ভাবেন জাটেল্লিকে পুরস্কার দেবেন। কিন্তু তিনি অনবরত ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছেন।দেখছেন তাঁকে অন্ধ করতে আসছে আর তারপর মেরে ফেলবে নিশ্চয়ই! তাই দরবারীকে জিজ্ঞেস করেন বাদশাহ, ''লোকের মুখে মুখে ফিরছে?"

-- কী জাহাঁপনা?

-- বোঝ না কবিতা, খিস্তির কবিতা!

-- জি হুজুর! খুবই ফিরছে!

-- কী  নিয়ে লিখেছে?

-- সিক্কা নিয়ে!

-- কোন সিক্কা?

-- হুজুরের নামে যে নতুন সিক্কা বেরিয়েছে।

বাদশাহ ফারুখ শিয়ার ঔরঙ্গজেবের নাতি হলে কী হবে, খুবই নড়বড় করছেন। না আছে দাদুর ক্ষমতা, না আছে ধৈর্য, সাহস। তিনি দেখলেন সিক্কাকে বেইজ্জত করেছে জাটেল্লি!

সিক্কায় লেখা আছে :

সিককে জাদ আজ-ফজল-ই হক, বার সিম ও জার

পাদশাহী বাহার-ও-বার, ফারুখ-শিয়ার

 খুদার অসীম করুণায়, সোনা রুপোর সিক্কা

আসমুদ্র হিমাচলের বাদশা ফারুখ শিয়ার।

 আর খিস্তিবাজ কবি সিক্কার প্যারডি লিখলেনঃ

সিককে জাদ বারগানদম বা মথ বা মটর

বাদশা হায় তাসমা কাশ ফারুখ শিয়ার

সিক্কা এটা তৈরি দিয়ে ডাল আর মটর

করছে খুন জুতোর ফিতেয় বাদশাহ ফারুখ শিয়ার।

বাদশাহ ভাবেন তাঁর এমনিতেই প্যান্টুলুন খোলা অবস্থা। তার ওপর ভবিষ্যত তাঁকে মাঝেমাঝেই দেখা দিয়ে আসন্ন অন্ধত্ব আর মৃত্যুর কথা জানিয়ে যায়। সেটা ভুলে তিনি কবিকে হত্যার ফরমান জারি করলেন যাতে ভবিষ্যত তাঁকে মনে রাখে। কেবল কি দুঃস্বপ্নই দেখাবে সে? এটা কিছুতেই মানেন না তিনি। ফারমান জারী করা হল। গলায় জুতোর ফিতে লাগিয়ে - তশমাকশ, দমবন্ধ করে মেরে মীর জাফর জাটেল্লির কবিতা লেখা আর বলা চিরতরে বন্ধ করলেন ফারুখ শিয়ার, ঔরঙ্গজেবের নাতি।

এর থেকে বোঝা গেল কেন, কবিতা সত্যি সত্যিই মৃত্যুর ভবিষ্যত বলে দিতে পারে হুবহু। তাই কবিতা লিখুন খিস্তি দিয়ে জাটেল্লির মতো!

 

 

মির জাফর জাটেল্লি:

সম্ভবত ঔরঙ্গজেবের আমলের একটু আগে ষোলোশো আটান্নতে জন্মে সতেরোশো তেরোর ফারুখ শিয়র পর্যন্ত ওনার আয়ুষ্কাল। উর্দু ব্যঙ্গ কবিতা ও গদ্যের  জনক বলা হয় মির জাফর জাটেল্লিকে (শাটেল্লি?)। আসল নাম মির মুহম্মদ জাফর। ললিত ফার্সি জবানে কাঁচা মুখের ভাষার - হিন্দভি সব শব্দ বসিয়ে - নতুন মিশ্র-রাখতা( উর্দুর আগের রূপ ) ভাষা তৈরিতে, যৌন ইঙ্গিতে সব শালীন ছক উল্টে দিয়ে সময়ের অনেক আগের এক আলোর বর্তিকা হলেন জাটেল্লি। ওই শৈলীকে বলত হুজ্জু বা সমাজদেহের নানা হিপোক্রেসি আর ক্ষমতার চামড়া ছাড়িয়ে  নেওয়া শুধু নয় সেই খালবোশ শরীরে রীতিমত ঝাল নুন ছিটোন ল্যাম্পুনিং করার শৈলী। ওনার অনন্য শৈলীর বৈশিষ্ট্য হল যৌনতাকে দেহের ললিত অনুষঙ্গ হিসেবে না ব্যবহার করে অন্তর্ঘাতের নানান উপাদান হিসেবে পেশ করা। প্রাচীন, মধ্য যুগীয় বা প্রাক আধুনিক ফার্সি কবিতায় যৌনতা কোন ট্যাবু ছিল না।  বাদশাহরাও ডিসিডেন্ট কবিদের কদরই করতেন।  মোঘল বা বিজাপুর সহ দাক্ষিণাত্যের  নানান কোর্ট ইরানি ডিসিডেন্ট কবিদের আশ্রয়স্থল ছিল। ঔরঙ্গজেব আলমগীরের বা তারপরও জাটেল্লিকে বাদশাহদের খিস্তি দিয়ে কবিতা লিখতে দেখা গেছে। আলমগীরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সূত্রে বাদশাহের অসহিষ্ণুতার বহুল প্রচারিত মিথ ভেঙে যায়। সমালোচনা করলেও ঔরঙ্গজেবকে সম্মানও দেখিয়েছেন কবি,  বাদশাহও কবির কদর করে এসেছেন। ফারুখ শিয়ারের ফরমানে জাটেল্লির মৃত্যুদণ্ড কবিতার জন্য তো বটেই, রাজনৈতিক শত্রুতার জন্যও হতে পারে যা সাধারণত করতেন না মোঘল বাদশাহরা।


4 কমেন্টস্:

  1. সময়টাকে খুব ভাল চর্চা করছেন। আমাদের লাভ।

    উত্তরমুছুন
  2. চমৎকার লিখেছেন। খিস্তি দিয়েও মুখের সামনে আয়না তুলে ধরা যায়। এখন তেমন কবি কই!

    উত্তরমুছুন
  3. মন্তব্যটি করলাম আমি প্রতিভা সরকার। নামহীনের বলে কেন প্রকাশিত হল, বুঝলাম না।

    উত্তরমুছুন
  4. বেশ অন্যদিকে গেছে@ সৌগত বালী

    উত্তরমুছুন