সমকালীন ছোটগল্প |
এরপর আর কী থাকতে পারে!
এরপর আর কী থাকতে পারে!
বোলতার মৃত্যুর খবর ছাড়া, বাকি
যা কিছু —
মৃত্যুর খবর পেয়ে সে যা করে, এবারও আগের মতই উন্মুখ হল — তার মধ্যে যা ছিল, তাকে সে কৌতূহল মনে করে না। নিজেকে, কৌতূহলী ভাবতে, সে মোটেই পছন্দ করে না — এটা এক ধরনের অভ্যাস, একটা প্রবণতা, যা তার স্বভাবে পরিণত হয়েছে — যে স্বভাব আগে ছিল না এবং সে জানে, এই সবই যদিও সাম্প্রতিক এবং তার বয়স ষাট পেরিয়ে বাষট্টি — ঠিক এই দুটো বছর এই সব — মানে, এই উন্মুখ হওয়ার অভ্যাস বা প্রবণতা, এবং তা অবশ্যই কোন মৃত্যুর খবরে, এমং সে তার নিকটজন হতেই পারে, অথবা দূরের কেউ — পরিচিত বা অপরিচিত — যেই হোক না কেন, সে মিলিয়ে নেয় তার জন্ম আর মৃত্যুর বছরের ফারাক — এভাবেই তার জানা যে কোন মৃত্যুকালীন বয়স হিসেব করার প্রক্রিয়া, তার ভিতরে চলতেই থাকে।
গত দু বছর এই সব — সে মনে মনে নিজেকেই শোনায়। এর মধ্যে, এই হিসেব করার মধ্যে, তৃপ্তি আছে— যা একটা সময়ে তাকে ক্লান্ত করে। ক্লান্তি দূর করার কোনো উপায় জানা না থাকায়, সে মেজাজ হারায়। খিটখিটে বুড়োদের মতই, তখন, তার সবকিছু। রাগ দেখানোর জন্য খুব অল্পই তার জায়গা, হাতে গোনা একটিই মানুষ, এবং সে অবশ্যই তার বউ শুভা — যে, তার থেকে তের বছরের ছোট এবং নিজেকে সে সাজাতে জানে — সাজলে চল্লিশ বছর মনে হয় — তার বউ!
বোলতার মৃত্যুর খবর আসতেই হিসাব মেলাতে গিয়ে তৃপ্তি বোধ না হওয়ার একটা কারণ ছিল। বোলতা তার বন্ধু — একসময়ের প্রাণের বন্ধু — অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ ছিল না, প্রথম প্রথম ফোনে যোগাযোগ যেটুকু, তাও বন্ধ বহুদিন — বন্ধু যখন, সমবয়সী হবেই তার নিশ্চয়তা নেই — তবু বোলতার জন্ম আর মৃত্যুর সাল ধরে হিসেব করে — না তৃপ্তি, না রাগ — বোলতা তার থেকে দু বছরের ছোট বুঝতে পেরে তার মনে হয়েছিল, এরপর আর কী থাকতে পারে!
বোলতা মাথার চুলে রং করত না অথচ তার চুল ছিল কুচকুচে কালো — দাঁতের ডাক্তারের কাছে কোনদিন যেতে হয়নি এবং তার একটা দাঁতও পড়েনি — আরো আছে, বোলতার সঙ্গে বোলতার বউয়ের বয়সের তফাৎ মাত্র দু বছরের, অথচ দেখে তার বউয়ের মতই চল্লিশ মনে হয়েছিল।
বোলতা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু — ছিল একসময়।
তখনও তার বা বোলতার বিয়ে হয়নি — এটা স্পষ্ট, — তখনও সে বা বোলতা কেউই চাকরি পায়নি —
এটাও স্পষ্ট, — কিন্ত এতদিন, হিসেব করে সে দেখছিল তা প্রায় চল্লিশ বছর দুজনের মধ্যে
দেখা হয়নি — তারপরেও এই মৃত্যুর খবরে কী এমন ছিল,
সে ভেবেই পেল না তার এই বিচলিত হওয়ার কারণ কী।
হিসেব করার পর মৃত্যুকালীন বয়সগুলো আশির কাছাকাছি হলে, সে, সেই মানুষটার মতই আয়ু লাভ করবে ভেবে — সামনের বছরগুলো কীভাবে কাটাবে ঠিক করে নিত। জীবনে অনেক না করা কাজ — যা সে করেনি বা করার কথা ভাবেনি, অনেক আকাঙ্ক্ষা — যার জন্য সে আজও লালায়িত, অনেক প্রতিশোধ — যার পিছনে আছে শুধুমাত্র নিজের নয়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষের লাঞ্ছনা-অপমান, ভালোবাসার মানুষের চোখের জল, যা দূর করার জন্য বিপ্লবের ডাক শুনলেই সে ঝাঁপাবে — এতদূর ভাবনা ওই আশির পরমায়ুর মধ্যবর্তী সময়ে — পৃথিবী কত সুন্দর, তার সব আমাদের জন্য, আমাদের গুছিয়ে উপভোগের জন্য — নিজের খুশিমত ঘোরাফেরা এদিকে সেদিকে, পাহাড়ে বা সমুদ্রে — ভালোমন্দ খাওয়া দাওয়া আর পছন্দের মানুষ খুঁজে গপ্পো করা — কিন্তু ওইটি হবার নয় — ওই পছন্দের মানুষ পাওয়া — একথা ঠিক যে, বাষট্টিতে যার হল না, শেষ ক’বছর, সে যতই বাষট্টি থেকে আশি — মানে মানে আঠারো বছর হোক না কেন, পছন্দের মানুষ হবে না জেনে ওই অংশটা হালকা করে পেন্সিল দিয়ে কেটে দিতে হবে।
বোলতার বউ মানসী! অবাক কান্ড। তো, সে আর কী করা যাবে, কিন্তু এটা বোলতা কী করল! কীভাবে করতে পারল!--- সে ভেবে সারা। শেষ পর্যন্ত মানসীকে! বোলতা জানত, হাজারবার জানত — মানসীর প্রতি তার দুর্বলতার কথা, যা সে নিজে বোলতাকে বলেছিল,সাহসে কুলোয়নি দয়িতাকে ডেকে সেকথা বলতে, কিন্তু বোলতাকে তো বলেছিল, তাকে সেই বয়সে প্রাণের বন্ধু জ্ঞানে সব কথা বলত।
কেমন ছিল সে ভালবাসা?
যত সব গাঁজাখুরি।
মানসী না, সে ছিল ইন্দ্রাণী। তার
জন্য বুক ধড়ফড়, পেট গুড়গুড়, মাথা ভনভন — হ্যাঁ, হয়েছিল বই কী — ওই বয়সে ওরকম কার হয়নি,
মানসী পিকচারেই ছিল না, অথচ দেখ,যখন বোলতার এই অকাল মৃত্যুতে তার সম্পর্কে শোক উথলে
ওঠার কথা, কোথা থেকে মানসী! ষাট বছরে চলে যাওয়া — এটা কি চলে যাবার বয়স! বেছে বেছে মৃত্যুর খবর সংগ্রহ আর বয়স
মেলানোর খেলা, হ্যাঁ – এটা অবশ্যই তার খেলা, তো সেই খেলায় হারজিতও আছে, আশি হলে জিত,
সত্তর হলে ড্র, ষাট হলে হার, ষাটের নিচে হলে তো গো হারা — আর হেরে গেলে, এই বয়সে মানুষ
পাগল হয়ে যায়, আার পাগলে কী না করে — সেদিক থেকে দেখতে গেলে তার প্রতি একটু করুণা
— হ্যাঁ, এভাবে ভাবলে, তার এই গোলমেলে ভাবনার থই খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
প্রাণের বন্ধু বোলতা — ওসব বাজে
কথা। কেউ কোনদিন তার প্রাণের দখল নিতে পারেনি। বলা ভালো দখল নিতে সে দেয়নি। হ্যাঁ,
ছোট বয়সে একসঙ্গে বড় বয়সের দিকে ছোটার পথে কিছুদিন, কিন্তু তাতে আঠা ছিল না। সে ভাবে
দেখতে গেলে ওরকম অনেক বোলতা ছিল — তাদের কেউ পল্টু বা বিল্টু — হাঁদা বা ভোঁদা— হাবুল বা গাবুল — লাট্টু
বা লেত্তি, কত আছে! তার কাছে তাদের খবর নেই — তারা আছে না চলে গেছে — থাকলে কোথায় আছে
— চলে গেলে কবে গেছে — কে জানে!
বোলতার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে মানসী কেন? হঠাৎ। অতর্কিতে। সকালের জলখাবার প্রায়
সারা, প্রমাণ সাইজের একটা মর্তমান কলায় সে সবে হামি দিয়েছে, ডোরবেল বেজেছিল।
দরজা খুলে শুভা যেভাবে মানসীকে
নিয়ে এসেছিল, যেন কতদিনের চেনা।
বোলতার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে মানসী
আসেনি।
সেসব নিয়ে কোনো কথাই বলেনি। শুভার
সঙ্গে পুরনো দিনের গল্প। তার কানে আসছিল। তখনও সে জানত না, মানসী বোলতার বউ। ওদের দুজনার
কথোপকথন থেকে বোঝাই যাচ্ছিল মানসী শুভার দূর সম্পর্কের আত্মীয়সম। তার এও মনে হয়েছিল,
সে মানসীকে চেনে। মানসীর ভাইকে প্রাইভেটে সে পড়াত। মানসী চা বিস্কুট — তার পড়ানোর সময়
— হাসিমুখে, সেই হাসিটা সেদিনও, একই রকম, আগের মতন—সে বোধহয় বলেও ছিল, হাসিটা একই রকম
আছে — মানসী লজ্জায় অপ্রস্তুত, তবু সে তার কথার পিঠে হেসেছিল, তবে সেই হাসিটা অন্য
রকম ছিল। কান্না মিশেছিল তার মধ্যে।
কান্নার কারণ অবশ্যই বোলতার চলে
যাওয়ার প্রসঙ্গ।
বোলতা! তার প্রাণের বন্ধু বোলতা!
আর মানসী! হাসিমুখে ঘরে ঢুকে — এই যে আপনার
চা — সেই মানসীকে বোলতা!
বোলতাকে আপনি চিনতেন?
আমি? হ্যাঁ।
আপনার বন্ধু? আপনার কথা খুব বলত।
আপনাকে ভালবাসত।
তখনই তার মনে হয়েছিল, এই মহিলা
তাকে চা বিস্কুট দিত না। এর কোন ভাই নেই। যার ভাই ছিল,তার নাম ইন্দ্রাণী। ইন্দ্রাণী
মানসীর মতই হাসত।
শুভা জিজ্ঞাসা করেছিল, বয়স কত?
তোর কত্তার বয়সী। ষাট।
সে তৎক্ষণাৎ বলে উঠেছিল, আমার তো
বাষট্টি।
ওই হল, ষাটও যা বাষট্টিও তা।
শুভা বলেছিল ,এটা কি মারা যাবার
বয়স?
ততক্ষণে তার সব হিসাব তালগোল পাকিয়ে গেছে। কোথায় আশি আর
কোথায় ষাট!
নড়াচড়ার জায়গা পর্যন্ত নেই। পেছনোর
গল্প সে কখনো রচনা করেনি। অবসর নিয়ে এই দু বছর তার শুধুমাত্র আশি-ছিয়াশির গল্প, সেই
গল্পে বাষট্টি থেকে দীর্ঘ সময় ধরে সে চরে বেড়াবে, জীবন উপভোগ করবে, আরো কত কিছু করার
পরিকল্পনা। শুভা এখনও সতেজ, এখনও তার প্রেমে সারা দেয়, সে এখনও বিছানায় সক্রিয়, প্রচুর
অর্থ সে উপার্জন করেছে…
গত দু বছরে দীর্ঘায়ু মৃত মানুষদের নাম তার ডায়েরিতে — এটা তার
দু বছরের নেশা। বোলতা নামে তার জীবনে কেউ ছিল না। তার ডায়েরিতে এই নাম কোনদিন জায়গা
পাবে না। মর্তমান কলার খোসা হাতে সে তাকিয়ে থাকল ডাইনিং টেবিলের উল্টোদিকে বসে থাকা
দুই নারীর দিকে।শুভা আর ইন্দ্রাণী।
ইন্দ্রাণী?
আমি মানসী।
সে হাসল। শুভাকে বলল, আর একটা কলা
খাব। তারপর একটা হাফ বয়েল। তুমি গল্প কর। আমি নিজেই করে নিচ্ছি।
অসাধারণ! এই বয়েসেও তপনদা কী আধুনিক!
উত্তরমুছুনআমি আইজাক
মুছুনপড়ে মনে হল এরপর অনেক কিছু থাকতে পারে। এক টুকরো জীবন নিয়ে যদি গল্প হয় তবে একঝাঁক কেন্দ্রাতিগ চিন্তা নিয়ে কেন হবে না ? ঢেউয়ের মতো এসব চিন্তারা একটার ওপর আর একটা চেপে বসেছে। গোটাটা মিলে এর তাৎপর্য খানিক বোঝা ও খানিক ভালো লাগা।
উত্তরমুছুন