কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


স্বরণ

রোলাঁ বার্থের 'মোর্নিং ডায়েরি'র কাছে বারেবারে ফিরে আসে দীপঙ্কর:

"...her voice, which I knew so well, and which is said to be the very texture of memory ('the dear inflection...'), I no longer hear. Like a localized deafness..."

মাতৃপ্রয়াণের দশ বছর পরে দীপঙ্করের আজকাল মাঝে মাঝে সংশয় হয়, মায়ের কণ্ঠস্বর মনে রাখতে পেরেছে কিনা। অনেকগুলো বছর তো কেটে গেল! একটা গোটা দশক চলে গেল মা নেই! ভাবা যায়? একসময় যে বকুনি ছাড়া একটা দিন কাটতো না, আজ এক দশক হল, দীপঙ্করের সে বকাবকি শোনা হয় না। তারও বয়স হয়েছে, আর কে না জানে, যত বয়স বাড়ে, তত কমতে থাকে বকুনি দেবার মত লোকজন! 

মা যখন ছিল তখন আজকালকার মতো অডিও বা ভিডিও রেকর্ডিংয়ের এত চল ছিল না! মায়ের কোন হোম ভিডিও বা ভয়েস মেসেজ নেই যেখানে তার গলা ধরা থাকবে চিরতরে! তার হাতের লেখা অবিশ্যি আছে দীপঙ্করের কাছে। কিন্তু হাতের লেখার থেকে স্বর আলাদা। লেখা থেকে কণ্ঠে যাওয়া যায় না, তা নয়,  কিন্তু সে কণ্ঠ কল্পনার নির্মাণ। তাকে ঠিক আসল মনে হয় না দীপঙ্করের। 

মা বেশ ভালো গান করতেন। শেখেননি কিন্তু দরাজ গলায় মন খুলে গাইতেন। গান শোনার অভ্যাস ছিল ভালো। একটা খাতায় সেই সব গান লেখা রয়েছে। মাঝে মাঝে গেয়ে উঠতেন আপন মনে। দীপঙ্কর প্রায়ই সেই খাতা খুলে গানগুলো পড়ে। মনে করার চেষ্টা করে কেমন কণ্ঠে গাইতেন মা:

"হায়গো ব্যথায় কথা

যায় ডুবে যায় যায় গো"

অথবা

"তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে

মলিন মর্ম মুছায়ে"

কখনো কখনো দীপঙ্কর নিজেও দু-এক কলি গেয়ে ওঠে। তবে তার গলাখান বেসুরো। তাই ঠিক সুবিধা করতে পারে না। গানের লিখন অন্য লিখনের থেকে আলাদা। সেখানে সুপ্ত থাকে স্বর! স্মৃতি তাই দিব্য মায়ের কণ্ঠস্বর উদ্ধার করে নেয় গানের লিখন থেকে অথচ ডায়েরির অন্যান্য ইতি উতি লেখা থেকে তার গলার আওয়াজ তৈরি হয় না।  

দীপঙ্কর ছোটবেলায় পড়াশোনা না করলে বা বেশি খেলা-সিনেমা-সিরিয়াল দেখলে মা প্রায়ই বলতেন: 'অয়েসা দিন নহি চলেগা', তার উত্তরে দীপঙ্কর মনে মনে মায়ের প্রিয় গানের একটা লাইন বলে উঠতো: 'এমনি করে যায় যদি দিন যাক না'! তবে মুখে বলেনি কোনোদিন, পাছে মা আরো বকে!

এ এক সচেতন এক্সারসাইজ ইন মেমরি! নানা স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে মাতৃকণ্ঠের নানান রকম চড়াই উতরাই। মনে করে ঝালিয়ে নেওয়া যায়! তবে ভাষা থেকে স্বর নিষ্কাশন যে সহজ নয় এ সত্য, স্মৃতি দীপঙ্করের থেকে ভালো বোঝে। অনেক সময় মনে করতে গিয়ে মা’র বলা একটা বাক্য নিজের স্বরে শুনতে  পায় দীপঙ্কর। তখন প্রথমে এক আশঙ্কা পেয়ে বসে। তবে কি তার কণ্ঠস্বর দখল করে নিচ্ছে মায়ের গলা? মুছে দিচ্ছে? হয়ত আস্তে আস্তে সে ভুলে যাচ্ছে মা’র গলা। যদি সে বধির হত কিম্বা তার মা যদি মূক হতেন তবে কি হতো এই স্বরণের? স্বর-স্মরণকে স্বরণ বলতে শুরু করেছে দীপঙ্কর।  

ভাষার এ উদ্ভাবনী শক্তি তাকে বিষণ্ণতার অন্য প্রান্তে নিয়ে গেছে, যেখানে মনে হয় তার কণ্ঠ মায়ের কণ্ঠকে মুছে দিচ্ছে না। এও এক ধরনের আত্তীকরণ যেখানে তার আর তার মায়ের গলা মিশে যাচ্ছে। মা’র গলার কিছুটা থাকছে, বাকিটা তার। এভাবেই তাদের স্বরণ চলছে। মায়ের গলা তার মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকছে এমনটা ভেবে শান্তি পেল বা নিজেকে প্রবোধ দিল দীপঙ্কর। 

এত কথা ভাবতে ভাবতে এটাই ভুলে গেল যে তার মা বোবা ছিলেন না বটে, তবে দীপঙ্কর কিন্তু ছোটবেলা  থেকে এক কানে শোনে না আর অন্যটায় কম শোনে! হিয়ারিং এইড ইউজ করছে প্রায় তিন দশক হল। তাই মায়ের গান বা চিৎকার কোনটাই সে খুব উচ্চ-ধ্বনিতে শোনেনি। যা শুনেছে, সবই হাল্কা, ফিসফাস! এমনকি অনেক সময় মাকে লিখে কথা বলতে হয়েছে কিছু একটা বোঝানোর জন্য। দীপঙ্করের কাছে তেমন এক খাতা রয়েছে মায়ের লেখার।

একদিন যখন দীপঙ্কর সম্পূর্ণ বধির হয়ে যাবে, ডাক্তার যার সম্ভাবনা আদৌ উড়িয়ে দেননি, প্রশ্ন হল, সেদিন কি সে তার মাকে স্বরণ করতে পারবে? 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন