কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩

প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

সাহিত্যিক সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক কলমে তিন বাঙালী আইকন

 


সৌরভ মুখোপাধ্যায়, যুক্তি তক্কো আর গদ্য

প্রকাশকঃ অন্তরীপ পাবলিকেশন, ২০২৩

‘কথামুখ’-এ লেখক বলে দিয়েছেন যে তাঁর ‘আগের বইটির’ (ফোনের ওপারে নীললোহিত এবং অন্যান্য গদ্য) – যেটি ছিল ‘ব্যক্তিগত বা আত্মকথামূলক’ – তুলনায় বর্তমান সংকলনের লেখাগুলি ‘নৈর্ব্যক্তিক, বিচার-বিশ্লেষণ আর অনুসন্ধান-পর্যবেক্ষণে ঠাসা, তথ্য-যুক্তি-তর্কে খচিত।’ ন’টি লেখার মধ্যে পাঁচটিরই বিষয় বাঙালীর তিন ‘আইকন’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায় এবং দেবব্রত বিশ্বাস। প্রথমে সেগুলি নিয়েই কথা হোক।

১ম পর্ব

বিষয় হেমন্ত

১। অন্তরীপ পত্রিকায় ১৪২৭ বঙ্গাব্দের শারদ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত ‘বন্ধু, বুঝো না ভুল’ উত্তম-হেমন্ত দ্বন্দ্ব’ নিয়ে কালিমাটি অনলাইন পত্রিকায় লিখেছিলাম। সেখানে এই দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ –‘দুই সফল পুরুষের সংঘাতের পিছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে-কারণটি অনিবার্য … নারী’ সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছিলেন সৌরভবাবু। সেই প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে আমি একটি ফরাসি প্রবাদ ব্যবহার করি, যেটি লেখক মূল লেখাটি পরিমার্জন করার সময় দেখছি গ্রহণ করেছেন। সৌরভবাবুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমার আলোচনাটি এখানে আবার তুলে দিলামঃ

কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬) ছবিতে উত্তমের সুরে হেমন্তকণ্ঠে ‘আমি যাই, চলে যাই’-এর উল্লেখ এবং নেপথ্য-কাহিনি দিয়ে শুরু হয়েছে এই প্রতিবেদন। তার পরেই এসেছে (নির্মম?) পরিসংখ্যান, যা লেখাটির বাড়তি শীর্ষক ‘উত্তম-হেমন্ত দ্বন্দ্ব’-কে বাস্তবের মাটিতে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৮০ অবধি মাত্র ১১টি ছবিতে উত্তম ‘প্রত্যক্ষভাবে লিপ দিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়নে, এবং সেই গানগুলির সংখ্যা বড়জোর ২৭/২৮!’ আর ১৯৬৬-র আগেঃ

১৯৫৫ সালে ‘শাপমোচন’ ছবিতে এই জুটির বিজয়-বৈজয়ন্তী ওড়ার পর থেকে (যদিও এর চার বছর আগে প্রথমবার ‘সহযাত্রী’ ছবিতে তরুণ গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দুটি গান ছিল নবাগত নায়কের লিপে, তেমন আলোচিত হয়নি তা) ওই ১৯৬৬ পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ১১ বছরেই প্রায় ১৮/১৯টি ছবিতে আমরা দেখছি উত্তম-হেমন্ত চিত্রায়নের মণিকাঞ্চন— এবং সংখ্যাটি? প্রায় ৫০! … অন্তত প্রথম ওই একটি স্বর্ণমণ্ডিত দশক, উত্তমের নেপথ্য কণ্ঠদানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন সব্বাইকার প্রথম পছন্দ— দর্শকের, প্রযোজকের, পরিচালকের, সঙ্গীতকারের। সম্ভবত, প্রথম দিকের অনেকটা সময়, নায়কের নিজেরও। এই সময়পর্বে হেমন্ত যা-ই গেয়েছেন উত্তমের জন্য … সব হিট। অদ্ভুত মিল ছিল গায়কের ও নায়কের কণ্ঠের টিম্বারে, এমনকি বাচনভঙ্গিতেও। গানের মধ্যে টুকরো সংলাপ বলেছেন হেমন্ত, একেবারে মিলে গেছে উত্তমের গলার সঙ্গে। ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’ কিংবা ‘মায়ামৃগ’ কিংবা ‘দুই ভাই’ ইত্যাদি অনেক ছবির গানে এমন নিদর্শন আছে।

১৯৬২ সালে হেমন্ত-প্রযোজিত প্রথম হিন্দী ছবি বিস সাল বাদ বম্বেতে নবাগত বিশ্বজিৎকে প্রভূত সাফল্য দেবার পরেই হেমন্ত স্থির করেন যে এর পরের ছবি শর্মিলা-র মাধ্যমে তিনি উত্তমকুমারকে হিন্দী ছবির জগতে প্রতিষ্ঠা দেবেন। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে, হেমন্তর প্রভূত আর্থিক ক্ষতি ঘটিয়ে উত্তম ছবি থেকে সরে দাঁড়ান। দুই ব্যক্তিত্বের দূরত্ব চরমে পৌঁছোয় ১৯৭০-এর পর। লেখক যথার্থই বলেছেনঃ

যে-জুটি একদা চার বছরে (’৫৮ থেকে ’৬১) মোট ১২টা ছবিতে ৩০টি গানে জুড়েছিলেন, ’৭১ থেকে ’৭৪ এই চার বছরে তাঁদের মিলন ঘটল মাত্র দুটি ছবির চারখানি গানে! তার মধ্যে প্রথম দু’বছরের স্কোর— শূন্য!

আর কাল তুমি আলেয়া-র বছর, ১৯৬৬-তেই শঙ্খবেলা ছবির মাধ্যমে দর্শকমানসে উত্তম প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁর বিকল্প নেপথ্য কণ্ঠকেঃ মান্না দে। লক্ষ্যণীয় যে কাল তুমি আলেয়া-তে হেমন্তের কণ্ঠ আছে বটে, কিন্তু গানটি কিন্তু কোন ভাবেই তাসের ঘর-এর ‘শূন্যে ডানা মেলে’, বা শুধু একটি বছর-এর ‘মোর মিলন-পিয়াসী মন’-এর মতো উত্তমের মনের কথা ব্যক্ত করছে না! গানের কথা সদ্য-প্রয়াতা এক নারীর (অভিনয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) বিদায়-গাথাঃ

তাই, ’৬৬ সালের ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবির ওই গানটি শুনলেই আজ কেমন অন্যরকম একটা মাত্রা যোগ হয় আমার অনুভবে। এই সেই ভাঙন-লগ্নের গান, যেন ভবিষ্যৎবাণীর ঘ্রাণ মেলে। গায়ক আর নায়কের ব্যক্তিগত সম্পর্কের যেটুকু সুরভি, তা শেষ হয়ে আসছে— কাঁটাগুলি এবার প্রকট হবে। আসন্ন বিচ্ছেদের কথা ফিরে ফিরে আসছে লিরিকে। ‘আমারে খুঁজোনা তুমি/ বন্ধু বুঝোনা ভুল/ কাল সে আলেয়া শুধু/ আমি সে আলোর ঝরা ফুল...’

এর পর লেখক পেশ করেছেন আগের চেয়েও নির্মম এক পরিসংখ্যানঃ

বোঝার সুবিধের জন্য রইল একটি চুম্বক-সার। কয়েকটি ছবির হদিশ মেলেনি, তাই approximate statistics.

# ১৯৬৬-পূর্ব গান: মান্না-উত্তম= ১ (ছবি ১), হেমন্ত-উত্তম= ৫৫+ (ছবি ১৮+)

# ১৯৬৬-পরবর্তী গান: মান্না-উত্তম= ৯০+ (ছবি ২৭+), হেমন্ত-উত্তম= ২৭+ (ছবি ১১+)

‘সিংহাসনচ্যুত’ কথাটা যে অত্যুক্তি নয় মোটেই, তা দেখাই যাচ্ছে।

সত্তরের দশকে এসেছে একাধিক ছবি যেখানে উত্তম-হেমন্ত যুগলেই উপস্থিত, কিন্তু উত্তমের কণ্ঠ মান্না দে, হেমন্ত গাইছেন অন্য শিল্পীর নেপথ্যে। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ স্ত্রী, যেখানে হেমন্ত গেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য। আবার সন্ন্যাসী রাজা-য় উত্তমের মুখে সমস্ত বাংলা গান মান্নার কণ্ঠে, শুধু ‘কা তব কান্তা’ স্তোত্রতে আমরা পেয়েছি হেমন্তকে, আর যে স্তোত্র উত্তম-অভিনীত চরিত্রের আগেই শোনা গেছে সেই সন্ন্যাসীদলের নেতার কণ্ঠে যারা সমুদ্রতীর থেকে অর্ধমৃত জমিদার (উত্তম)-কে উদ্ধার করছে। শোনা যায় যে শঙ্খবেলা-তে সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত নাকি ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’-তে চেয়েছিলেন হেমন্তর রোম্যান্টিক কণ্ঠ, আর মজলিসী গান ‘আমি আগন্তুক’-এ মান্না দেকে। তখন নাকি এই ছেঁদো যুক্তিতে হেমন্ত বাদ পড়েন যে এক অভিনেতার গলায় দু’জন ভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠ দর্শক নাকি নেবেন না! লেখকের কথায়ঃ

১৯৬৮-র ‘চৌরঙ্গী’ দিয়ে এর সূচনা, তারপর এক সময় যেন এটাই নিয়ম দাঁড়িয়ে গেল। উত্তমকুমার ছবিতে রয়েছেন, তবু ছবিতে হেমন্তর গান গেয়ে যাচ্ছেন অন্য অভিনেতারা! সাবরমতী, কমললতা, ধন্যি মেয়ে, স্ত্রী, অগ্নীশ্বর, ভোলা ময়রা...

উল্লেখিত ছবিগুলির মধ্যে নায়ক-গায়কের পরস্পর দূরত্ব, আমার কাছে, সবচেয়ে প্রকট সাবরমতী-তে। এখানে উত্তমের মুখে একটি গানে আমরা শুনছি কিশোরকুমারের কণ্ঠ! আর, সৌরভবাবুর ভাষায়ঃ

১৯৬৮র ছবি ‘সাবরমতী’, অনেকেই দেখে থাকবেন গোপেন মল্লিক সুরারোপিত অপূর্ব শ্রুতিমধুর সেই গানের চিত্রায়ন, ‘শোনো গো সজনী, পোহাল রজনী, দুখনিশি হল যে ভোর হে।’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রথম পংক্তিগুলি যখন এক মায়াময় ঊষার প্রাকৃতিক পটভূমিতে ফুটে উঠতে থাকে, তখনও অনিশ্চিত— কে লিপ্ দিচ্ছেন। কিন্তু কণ্ঠের এমনই জাদু, শুরু থেকেই আমাদের মনের মধ্যে বাজতে থাকে, আহা, উত্তম...!

কিন্তু, না! অচিরেই দেখা যায়, পর্দায় রয়েছেন কিন্তু লিপ্ দিচ্ছেননা উত্তমকুমার। এক বৃদ্ধ বৈষ্ণব গান গাইছেন, উত্তমকুমার দূরে দাঁড়িয়ে, সুপ্রিয়া দেবীর মুখোমুখি।ঘাড়টি ঘুরিয়ে নায়ক একবার-দু’বার দেখলেন, শুনলেন গানটি, তারপর মুখটি ফের ঘুরিয়ে নিলেন নায়িকার দিকে।

কেমন আশ্চর্য একটা বিষণ্ণতা উঁকি দেয় এই গানটি শুনতে শুনতে। সবে ১৯৬৮, এইতো আগের বছরেও ‘নায়িকা-সংবাদ’ ছবিতে ‘এই পূর্ণিমা রাত’ গানে উত্তম-হেমন্ত রসায়ন ম্যাজিক তৈরি করেছে! ’৬৬তে নায়কের কণ্ঠদানে মান্না দে সফল হয়েছেন ঠিকই— কিন্তু তাই বলে হেমন্ত ছবিতে অংশ নিচ্ছেন তবু সে-গান অন্য লোকের ঠোঁটে আরউত্তম নীরব দর্শক, একই ছবিতে গান গাইবেন অন্য গায়কের গলায়— এতটা প্রথম ধাক্কায় মানতে কষ্ট হয়নি কি দর্শকদের?

দু’জনের এই দ্বন্দ্বের মোট তিনটি কারণ লেখক উল্লেখ করেছেন। এক, হেমন্তর শর্মিলা ছিল নায়িকা-প্রধান, কম বাজেটের, ছোট ব্যানারের ছবি। দুই, ছবিটি সফল হলে বিশ্বজিতের মতো উত্তমকুমারকেও হিন্দী ছবিতে ‘প্রতিষ্ঠা’ দেবার কৃতিত্ব পাবেন হেমন্ত, উত্তম সেখানে গৌণ হয়ে যাবেন। এবং, আমার, এবং, আমার মনে হয়, সৌরভবাবুরও, মতে উত্তম যে চরম অসৌজন্যতা হেমন্তর প্রতি দেখিয়েছিলেন, তার পেছনে ছিল সেই ফরাসী প্রবচনঃ cherchez la femme, ‘নারীটির সন্ধান করুন’! এবং সে নারী সুপ্রিয়া দেবী, যাঁর বাড়ীতে হেমন্ত কলকাতার স্টুডিওর কাজ সেরে মধ্যাহ্নে বিশ্রাম নিতেন। লেখকের কথায়ঃ

সুপ্রিয়া দেবীকে নিয়ে প্রবল অধিকারবোধ ছিল উত্তমকুমারের। প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য থেকে নমুনা মেলে, তাঁর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে সুপ্রিয়া অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে সামান্যতম ঘনিষ্ঠতা এমনকী অধিক সৌজন্য পর্যন্ত দেখালে ছেলেমানুষের মতো ক্ষুণ্ণ হতেন মহানায়ক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও সম্ভবত জানতেন একথা, গুরুত্ব দেননি। ফলত তাঁকে ঘিরেও কি দূর গগনে কোনও মেঘ ঘনিয়েছিল? সুপ্রিয়া বলিউডে কাজ করতে যান, এ না-পসন্দ ছিল উত্তমের। সুপ্রিয়া কিছুটা তাঁকে অমান্য করেই হেমন্তর ডাকে বোম্বেতে গিয়েছিলেন। প্রিয় নারীর এহেন অবাধ্যতা, তাও আবার এমন পুরুষের প্ররোচনায়—যাঁর সঙ্গে ওই বোম্বের ছবি করা নিয়েই সদ্য মনোমালিন্য তৈরি হয়েছে নায়কের নিজের— এর পুরো ক্রোধটি কি গিয়ে পড়েছিল ধুতি-শার্ট পরা দীর্ঘকায় মানুষটির ওপরেই?

এই প্রসঙ্গ শেষ করছি আবার লেখকের, আমার বিচারে, নির্ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েঃ

ইতিহাস শুধু বলছে— এত কিছুর মধ্যেও যখনই উত্তমকুমারের জন্য গাইতে ডেকেছেন কোনও সঙ্গীত-পরিচালক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন আমন্ত্রণ। এমন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনার সাক্ষ্যও পাওয়া যায়না যেখানে অভিমান-ক্রোধ মনে রেখে— উত্তমের ছবিতে অন্য অভিনেতার কণ্ঠে, এমনকী খোদ উত্তমের হয়েও— নেপথ্য-কণ্ঠদানে ‘অসম্মত’ হয়েছেন গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এমনকী, উত্তম-অভিনীত ছবির সুরারোপ পর্যন্ত করেছেন, সে-সবের মধ্যে এমন ছবিও আছে যেখানে হেমন্তর নিজের গাওয়া গানে লিপ দিচ্ছেন অন্য অভিনেতা।

আমাদের মনে হয়, এই হল আদর্শ পেশাদারের মতো কাজ; সব আঘাত সব রক্তপাত জামার নীচে লুকিয়ে রেখে, শুধু কাজটুকুকেই চূড়ান্ত গুরুত্ব দেওয়া।

দুঃখের সঙ্গে আমরা মানতে বাধ্য, নায়ক সেই উদাহরণ রাখতে পারেননি সবসময়। ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে তেমনটাই উঠে এল।

এক হেমন্ত-পূজারী হিসেবে সৌরভবাবুকে কৃতজ্ঞতা জানাব, বাস্তবে যা হয়নি, কল্পনার জগতে তা’ ঘটানোর জন্য। তাঁর সোনালি মেঘ, রুপোলি ছায়া উপন্যাসে বয়স ও ব্যাধি-বিদ্ধস্ত অভিনেতা নীহার চট্টোপাধ্যায় লিখিত স্বীকারোক্তি রেখে যাচ্ছেন গায়ক মণিময়কে অন্যায়ভাবে সন্দেহ করে তাঁর সঙ্গে দূরত্ব তৈরির ব্যাপারেঃ “তখন সত্যিই আমার কবচকুণ্ডল … খুইয়েছি … মণিদাকে ছেঁটে ফেলেছি নিজেই …” (পৃঃ ১৪৬) ।

২। ‘বিবিধ গানে’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রবন্ধে (প্রহর ওয়েব পত্রিকা, ২০২০) রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলার কবি-গীতিকারের যেসব গান হেমন্ত গেয়েছেন, তাই নিয়ে আলোচনা আছে। ১৯৫৯-এ পরিচালক তপন সিংহ তাঁর ক্ষণিকের অতিথি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হেমন্তকে দিয়ে গাওয়ান অতুলপ্রসাদের ‘কে তুমি বসি’ নদীকূলে একেলা’। সৌরভবাবু এই গানটি নিয়ে বেশী কিছু বলেননি, কিন্তু আমার কাছে গানটির প্রয়োগ এবং গায়নভঙ্গী অসাধারণ। সাধারণত একটু দ্রুত লয়ে, গলা খেলিয়ে গানটি গাওয়া হয়। কিন্তু, ছবির এবং সঙ্গীতের পরিচালক দুজন মিলে গানটির মাধ্যমে সৃষ্টি করলেন উদাস করে দেওয়া, চাপা বিষণ্ণতায় ভরা এক অনবদ্য আবহ। কারণ গানটি তো গাইছে কোন আসরের ওস্তাদ গায়ক নয়, হাসপাতালের শয্যায় শায়িত একজন রোগী! দুর্ভাগ্যক্রমে, রেকর্ডে গানটির আস্থায়ী অসম্পূর্ণভাবে গাওয়া হয়েছে, ছায়াছবিতে ঠিক যেভাবে আছে। যেহেতু সে যুগে সরাসরি ছবির ‘সাউন্ড-ট্র্যাক’ থেকে গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরি করা হত না, গায়নভঙ্গী অপরিবর্তিত রেখে সম্পূর্ণ আস্থায়ীটি কি রেকর্ড করা যেত না?

সৌরভবাবুর শ্রবণ এবং মন কেড়েছে অপর পিঠে, ৭৮ গতির রেকর্ড করার উদ্দেশে গাওয়া, ‘জল বলে চল, মোর সাথে চল’ঃ ‘বিশেষত, দ্বিতীয় গানটির তিনটি সপ্তকেই [হেমন্তর] কণ্ঠ এত সুখকর বিচরণ করেছে – ঈষৎ দ্রুত লয়েই, কিন্তু অভিঘাতে মোক্ষম!’ এর পরেই লেখক দাবী করেছেন যে এ-গান হেমন্তর অন্য গানের মতো খুব জনপ্রিয় হয়নি বা তেমন বাজার পায়নি। ‘তাই, তখনও হেমন্তর সাঙ্গীতিক ভুবনে এই জঁর তেমন পাকাপোক্ত আসন পেল না।’ কিন্তু অন্যরকম তথ্য দিচ্ছে ১৯৮৩-র পরিবর্তন পত্রিকার ৬ষ্ঠ বর্ষের ২২শ সংখ্যা। ১৬ নং পৃষ্ঠায় আছে গ্রামোফোন কোম্পানির পি কে ব্যানারজির সৌজন্যে প্রাপ্ত হেমন্তর ‘কালজয়ী কিছু হিট রেকরডের তালিকা’। একুশটি রেকর্ডের এই তালিকায় ১৮ নম্বরে পাই ‘কে তুমি বসি’ নদীকূলে, [এবং] জল বলে চল’! সত্যিই তো, বাজার-সচেতন রেকর্ড কোম্পানি ছায়াছবির একটিমাত্র গান যদি সেভাবে জনপ্রিয় না হয়, তাহলে আরেকটি গান তার অপর পিঠে রেকর্ড করিয়ে সেটি বাজারে ছাড়বে কেন? স্মর্তব্য, ১৯৫১ সালে হেমন্ত-সুরারোপিত ছবি জিঘাংসা-র একটিমাত্র গান – সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘আমি আঁধার, আমি ছায়া’ – এতটাই জনপ্রিয় হয় যে হেমন্তকে দিয়ে তার অপর পিঠের জন্য সৃষ্টি করতে হয় একটি ‘বেসিক’ আধুনিক গান, ‘ভরা ঘট ছলছলি’! এই যুক্তি প্রমাণিত হয় সৌরভবাবুর নিজেরই পরের মন্তব্যেঃ

আরও পাঁচ বছর লেগে গেল পরের ধাপটি পেরোতে। ১৯৬৪ সালে ‘আরোহী’ ছবিতে গাইলেন দ্বিজেন্দ্রলালের গান – ‘তোমারেই ভালবেসেছি আমি’। খুব জনসমাদৃত হয়নি ছবি গান কোনোটিই, এবার আর নন-ফিল্মও কিছু হল না।

(প্রসঙ্গত, তপন সিংহ তাঁর প্রথম দিকের একাধিক ছবিতে হেমন্তকে শুধুই সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন তা নয়, দেখা যাচ্ছে যে হেমন্তকে তাঁর comfort zone-এর বাইরে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন রকমের গান গাইয়েছেন। উদাহরণ শুধু ক্ষণিকের অতিথি বা আরোহী নয়, হাঁসুলীবাঁকের উপকথা-ও! তরুণ মজুমদারও পলাতক থেকে শুরু করে এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজটি বারবার করবেন, হেমন্তর আপত্তি সত্ত্বেও – এবং তার সুফল ভোগ করেছি আমরা সবাই!)

দীর্ঘ ছ’ বছর পরে, ১৯৭০-এ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন-এ শোনা গেল তিনরকম ‘বিবিধ’ গানঃ রজনীকান্তের ‘আমি অকৃতী অধম’, দেশবন্ধুর স্বরচিত ‘নামিয়ে নাও এ জ্ঞানের বোঝা’-র আস্থায়ীটুকু, এবং সংলাপের নেপথ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’-এর অংশ (যা সম্পূর্ণরূপে হেমন্ত গেয়েছিলেন ১৯৫১ সালে হিন্দী আনন্দমঠ ছবিতে, এবং যা তিনি আবার এক বছরের মধ্যে আবার গাইবেন বাংলা মহাবিপ্লবী অরবিন্দ ছবিতে, দুবারই ভিন্ন-ভিন্ন সুরে) ।

১৯৭৩-এ রজনীকান্তের গানের একটি লং-প্লে সংকলনের জন্য কান্তকবির দৌহিত্র দিলীপকুমার রায়ের পরিচালনায় হেমন্ত গাইলেন ‘ওই বধির যবনিকা’ এবং তালবিহীনভাবে ‘আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে’। সৌরভবাবুকেই উদ্ধৃত করিঃ

সেই মধ্য-সাতের দশকে তাঁর গম্ভীর নিনাদী কণ্ঠ আর বয়সোচিত গভীর অভিব্যক্তি এই দুটি গানকে এক আশ্চর্য মাত্রা দিয়েছিল। বিশেষত ধীর লয়ে … গাওয়া ‘আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে’ গানটি স্মরণীয় হয়ে আছে। নিবিষ্ট রসিকরা খুবই আপ্লুত হয়েছিলেন।

দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে পরিচিতি থাকার সুবাদে তাঁর স্বীকারোক্তি শুনেছিলাম যে প্রশিক্ষণ দেবার সময় হেমন্তর গায়ন তাঁকে অপ্রত্যাশিতভাবে মুগ্ধ করেছিল। এই গানদুটি এতটাই জনসমাদর পায় যে ১৯৭৪ সালের ২৪শে নভেম্বর মাসে আকাশবাণীতে রাত ৮ঃ৪৫ মিনিটে হেমন্ত পরিবেষণ করেন তিনটি রজনীকান্তের গান। দ্বিতীয় গান ছিল ‘ওই বধির যবনিকা’ আর তৃতীয় গান পান্নালাল ভট্টাচার্যের কণ্ঠে বহুশ্রুত ‘তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে’। আসল চমক হেমন্ত দেন প্রথম গানটির নির্বাচনে। রজনীকান্ত ভক্তিমূলক গানের জন্যই বিখ্যাত। হেমন্ত বাছেন কান্তকবির অল্পসংখ্যক প্রেমের গানের একটিঃ ‘স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি’! এই রেকর্ডিংটি আজ অবধি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি – আমার মতো হেমন্ত-পূজারীদের পক্ষে চরম দুর্ভাগ্যের কথা, কারণ তিনি যা গেয়েছিলেন তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই!

১৯৭৬-এ আরেকটি লং-প্লে সংকলনের জন্য হেমন্ত গাইলেন সেই ১৯৭০-এ প্রথম গাওয়া ‘আমি অকৃতী অধম’ আর ‘দেখ দেখি মন নয়ন মুদে’। প্রথম গানটি আমি দিলীপকুমার রায়ের কণ্ঠে এর আগে শুনেছি, কিন্তু আমি সৌরভবাবুর সঙ্গে একমত যে হেমন্তর ‘আগে, সমসময়ে বা পরেও – এইসব গান এর চেয়ে অধিক মর্মস্পর্শী অভিব্যক্তিতে আর কেউ গাইতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।’ ইংরেজ সাহিত্যগুরু ডাঃ স্যামুয়েল জনসন কবি টমাস গ্রে-র Elegy Written in a Country Churchyard কবিতাটির প্রশংসা করতে গিয়ে যা বলেছিলেন, তা সামান্য পালটে নিয়ে আমার বলতে ইচ্ছে করেঃ If he often sung thus, it would be vain to blame and useless to praise him! তাঁর প্রতিবেদনের শেষে ‘আমি অকৃতী অধম’ নিয়ে সৌরভবাবুর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই মনোভাবের ওপরেই সীলমোহর দেয়।

রজনীকান্তের গান নিয়ে শেষ তথ্যঃ ১৯৭৭ সালে দিন আমাদের ছবিতে রঞ্জিত মল্লিকের নেপথ্য কণ্ঠ হিসেবে হেমন্ত আমাদের উপহার দেন আরেকটি ব্যতিক্রমী, এবার হাসির, গানঃ ‘যদি কুমড়োর মতো চালে ধরে র’তো’, যেখানে এক জায়গায় রঞ্জিত মল্লিক অভিনীত চরিত্রটির নামের জন্য ‘কান্ত আর খেতে পাবে না’-র বদলে হেমন্ত গেয়েছেন ‘তপু আর খেতে পাবে না’!

এর মধ্যে, ১৯৭৫ সালে অগ্নীশ্বর ছবিতে হেমন্ত, সঙ্গে সমবেত কণ্ঠ নিয়ে, অত্যন্ত সফলভাবে গাইলেন দ্বিজেন্দ্রগীতি ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’। সৌরভবাবু শুরুর শব্দতে ‘সামান্য ত্রুটি’-র কথা বলেছেন। আমি বড় হয়েছি কবিপুত্র দিলীপকুমার রায়ের কণ্ঠে গানটি শুনে; তিনিও গেয়েছেন ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’! সকলের সুবিধার্থে ইউটিউবে গানটির লিঙ্ক আর তার সঙ্গের মন্তব্য এখানে দিলামঃ

কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা গানটা “ধনধান্য পুষ্প ভরা” নাকি “ধনধান্যে পুষ্পে ভরা? কোনটা সঠিক? “ধনধান্যে পুষ্পে” কি গাওয়ার ভুল নাকি “ধনধান্য পুষ্প” ছাপার ভুল, যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। … তর্কের মীমাংসা হবে কিনা জানি না তবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সুযোগ্য পুত্র দিলীপ কুমার রায়ের কণ্ঠে গানটা শুনে নেওয়া যাক...https://www.youtube.com/watch?v=QuT0LrNeWu0

এরপরেই আমি সৌরভবাবুর সঙ্গে দ্বিমত হবো। তিনি সঠিকই লিখেছেন যে ১৯৭৮ সালে হেমন্ত প্রথম কোনও ছবিতে (বারবধূ) নজরুলগীতি গাইলেন। কিন্তু এর অনেক আগেই, ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে, তিনি বেতারে রাত ১০ঃ৫০ মিনিটে পরিবেষণ করেছিলেন দুটি নজরুলগীতি, যার মধ্যে প্রথমটির স্বরলিপিও, এখন জানা গেছে, তিনি নিজে করে রেখেছিলেনঃ ‘সেদিন বলেছিলে, সেই সে ফুলবনে,/ আবার হবে দেখা, ফাগুনে তব সনে।’ দ্বিতীয় গানটি ছিল গজল-ধর্মী ‘পথ চলিতে, যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরাণপ্রিয়’। গান নির্বাচন এবং গায়ন এককথায় নিখুঁত । আমার মনে হয়, ১৯৭৩-এ রজনীকান্তের গান রেকর্ড করে সাফল্য পাবার পর, এবং বিভিন্ন সময়ে রজনীকান্তের গান গাইবার অনুরোধ পাবার পর – আমি নিজে রবীন্দ্র সদনে এবং চন্দননগরের জ্যোতি সিনেমায় এই অনুরোধ করেছিলাম, তবে অনুষ্ঠানগুলি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছিল বলে হেমন্ত সে অনুরোধ রাখেন নি – তিনি ১৯৭৪-এর শেষ থেকে প্রথমে রজনীকান্ত এবং পরে নজরুল এবং – ১৯৫৯-এর পর এই প্রথম – অতুলপ্রসাদের গান গাইতে সচেষ্ট হন।

১৯৭৫ থেকে ১৯৭৬-এর মধ্যে বেতারে হেমন্ত রাত ৮ঃ৪৫-এ পরিবেষণ করেন যথাক্রমে দুটি অতুলপ্রসাদের গান এবং আরও দুটি নজরুলগীতি। চারটির একটি গানও, প্রবল প্রত্যাশা সত্ত্বেও, বর্তমান প্রতিবেদকের হৃদয়স্পর্শ করতে পারেনি। এবং চারটির ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে নজরুলগীতি দুটির, সৌরভবাবুর ব্যাখ্যা নির্ভুলঃ এক, হেমন্তর কণ্ঠে ধ্রুপদী রেওয়াজ বা তালিম-প্রাপ্ত গায়নশৈলীর অভাব, দুই, সত্তরের দশকের দ্বিতীয়ার্ধের আগেই তাঁর সমসাময়িক, এমনকি অনুজ, শিল্পীরাও নজরুলগীতিতে বিশেষ করে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন। সেখানে অপেক্ষাকৃত সরল ‘গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা’, ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার’, বা ‘আমার গানের মালা আমি করব কারে দান’-এর জায়গায় ‘বসিয়া বিজনে, কেন একা মনে’ বা ‘এ কী সুরে তুমি গান শোনালে’ নির্বাচন করা হেমন্তর বিবেচনার অভাবই প্রকট করে। মুক্তি-না-পাওয়া লায়লা-মজনু ছবির ‘লায়লি তোমার এসেছে ফিরিয়া’, যেমন সৌরভবাবু বলেছেন, তেমন আশাব্যঞ্জক কিছু নয়।

এই প্রসঙ্গে প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখে শোনা ঘটনার কথা বলি। প্রয়াত হেমন্ত-ভক্ত বরুণ বক্সীর বাড়িতে সান্ধ্য-ভোজে আমন্ত্রিত ছিলেন সুনীল। আলোচনা চলছিল হেমন্তর অপেক্ষাকৃত অল্পশ্রুত গান নিয়ে। সুনীল বলেন যে তিনি বারবধূ ছবির চিত্রনাট্য রচনা করার পর নির্মাতারা স্থির করেন যে যে দুটি নজরুলগীতি আছে, সেগুলি গাইবেন মান্না দে। কিন্তু ‘চোখ গেল, চোখ গেল’ গাইতে হবে শুনেই মান্না দে ‘শচীনকর্তার’ দোহাই দিয়ে অব্যাহতি চান! তখনই ভাবা হয় হেমন্তর কথা। দ্বিতীয় গানটি – ‘পথ চলিতে যদি চকিতে’ – কয়েক বছর আগেই হেমন্ত যথেষ্ট সফলভাবে বেতারে গেয়েছেন, আর ছবিতে গানের একটি স্তবক বাদও দেওয়া হয়। ‘চোখ গেল, চোখ গেল’ কি হেমন্ত ১৯৭৮ সালের এই ছবিটির প্রেক্ষিতে এক ধরণের ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে গ্রহণ করেন, গানটি তাঁর অন্যতম আদর্শ গায়ক-সুরকার শচীন দেববর্মনের গাওয়া বলে? ১৯৭৬-এ তো মহালয়ায় ‘দেবিং দুর্গতিহারিণীং’ আলেখ্যতে তিনি সুরারোপ করেন সম্ভবত আরেক ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবেই। এতদিনে প্রয়াত বিকাশ রায়ের কল্যাণে আমরা জানতে পেরেছিঃ

১৯৪৪ সালে হঠাৎ শোনা গেল পঙ্কজ মল্লিক সেবারের মহিষাসুর মর্দিনীর অনুষ্ঠান থেকে সরে যাচ্ছেন, রেডিও কর্তাদের সঙ্গে কোনও মতবিরোধের দরুণ। … বীরেনদা … বাণীকুমার, দক্ষিণামোহন ঠাকুর এরা সবাই আলোচনায় বসলেন। এমন কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে যিনি সব গানগুলি মোটামুটি জানেন। তিনজনেই স্থির করলেন হেমন্তবাবুর নাম … এই গুরুদায়িত্ব কিন্তু হেমন্ত যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে পঙ্কজবাবু ফিরেছিলেন কিন্তু কতগুলো গানে হেমন্তবাবুর করা সুরগুলোই রেখে দিয়েছিলেন, সেটা আজ আর কেউ জানে না।

‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ঃ শতবর্ষে শতস্মৃতি’, সম্পাদনা জয়দীপ চক্রবর্তী (কলকাতাঃ আজকাল, ২০১৯) পৃঃ ৬১

সৌরভবাবু মত দিয়েছেন যে ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫, যখন হেমন্তর কণ্ঠমাধুরী, দম ও সপ্তকবিহারের সাবলীলতা ছিল শীর্ষে, সেই সময় উচিৎ ছিল ‘তাঁর মীড় ও স্পর্শস্বর-সমৃদ্ধ সতেজ কণ্ঠের চলনের সঙ্গে মানানসই’ কিছু নজরুলগীতি রেকর্ড করানো। এইরকম সময়েই কি মহাজাতি সদনে ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র হেমন্তকণ্ঠে শুনেছিলেন ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারী’, যে কথা তিনি বলেছিলেন সম্ভবত আনন্দলোক পত্রিকায়? ১৯৬২-তে দাদাঠাকুর ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার পর নাকি কোন এক অনুষ্ঠানে শোনা গিয়েছিল হেমন্তকণ্ঠে ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু’ (ছবিতে গানটি আছে সুলতা চৌধুরীর মুখে, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যান্যদের কণ্ঠে) । আর শঙ্করলাল ভট্টাচার্যকে সাক্ষাৎকারে হেমন্ত বলেছিলেন বেতারে ‘মেঘলা নিশিভোরে’ গাওয়ার কথা।

বেতারে পরিবেষিত অতুলপ্রসাদের গান দুখানিও মন ছুঁতে পারে নিঃ ‘কেন এলে মোর ঘরে আগে নাহি বলিয়া’ আর ‘তব অন্তর এত মন্থর’। অথচ, মনে করুন, সেই ১৯৫৯-এ মন পাগল-করা ‘কে তুমি বসি’ নদীকূলে একেলা’! বছর ছয়েক পরে, ১৯৮২-তে, তরুণ মজুমদার তাঁর খেলার পুতুল ছবিতে রাখলেন নেপথ্যে হেমন্তকণ্ঠে ‘ক্রন্দসী পথচারিণী’-র আস্থায়ী ও অন্তরা। রেকর্ড/ক্যাসেটে পাওয়া গেল গানের আভোগও, সঞ্চারী সম্পূর্ণ বাদ! সৌরভবাবুর সঙ্গে একেবারে সহমতঃ ‘গলায় বার্ধক্য থাবা বসিয়েছে, কিন্তু ধীরলয়ের গানটিতে অতি অপরূপ দরদী অভিব্যক্তি – যা একান্তভাবে তাঁর স্বকীয় গুণ।’ পরের বছর আবার অতুলপ্রসাদের ‘আমায় রাখতে যদি আপন ঘরে’চেনা অচেনা ছবিতে। প্রথমে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-অভিনীত চরিত্রের অপেক্ষাকৃত কম বয়সে গানটির আস্থায়ী শোনা গেছে দ্রুত লয়ে, উৎফুল্ল গায়কীতে। সম্পূর্ণ গানটি আসবে ছবির দ্বিতীয়ার্ধে, চরিত্রটি যখন পরিণত-বয়স্ক। সৌরভবাবুর মূল্যায়ন নির্ভুলঃ ‘বাচনভঙ্গি পর্যন্ত কিঞ্চিৎ জরাগ্রস্ত শোনায় এখানে, শ্বাসের সংকট, তবু এমন অননুকরণীয় ভাব-প্রকাশ, সামান্য ডিলে-অনুরণন সমেত এক আশ্চর্য বিষণ্ণ-মধুর কণ্ঠস্বর – সব দুর্বলতা ছাপিয়ে স্তব্ধ করে রাখে শ্রোতাদের।’ ১৯৮৫ সালে অজান্তে ছবিতে অরুন্ধতী হোম চৌধুরীর সঙ্গে ‘কেন এলে মোর ঘরে’ সেই সত্তরের দশকে একক কণ্ঠে পরিবেষণার চেয়েও, আমার কাছে, হতাশাব্যঞ্জক। গলায় সপ্তকের সব পর্দাগুলি লাগছে না। এমতাবস্থায় ছবির অন্য গানগুলি যেহেতু ব্যঙ্গাত্মক (‘ওই ঝান্ডাটা নামিয়ে, গলাবাজি থামিয়ে’ বা ‘আমার ল্যাজও নেই শিঙও নেই’) এই ত্রুটি সেগুলিতে তেমন কাণে লাগেনি) কিন্তু অতুলপ্রসাদের গানে, বিশেষ যেখানে সহশিল্পীর গলায় প্রতিটি সুর সঠিক লাগছে, হেমন্তর গায়ন বেশ দায়সারা লেগেছে। সৌরভবাবুর সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।??

এই চার কবির বাইরেও হেমন্তকণ্ঠে আমরা পেয়েছি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অন্তরতর অন্তরতম তিনি যে’, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দু’খানি গান, প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের ‘শুভ আশীর্বাদ দানে’, গিরিশচন্দ্র ঘোষের গান, সুরারোপ করে গাওয়া সজনীকান্ত দাস, কুমুদরঞ্জন মল্লিক এবং কালিদাস রায়ের কবিতা, জয়দেব ও বিদ্যাপতির গান, কালিদাসের শ্লোক, স্বামী সত্যানন্দের গান – তালিকা সম্পূর্ণ করা প্রতিবেদকের সাধ্যের বাইরে।

এখন ইউটিউবে ‘আনন্দধারা’ নামক চ্যানেলের সৌজন্যে হেমন্তর বহুমুখী সঙ্গীতচর্চার নিদর্শন, অনেক ক্ষেত্রে মূল্যবান ধারা-বিবরণী সম্বলিত, সহজলভ্য হয়েছে।

সবার শেষে উল্লেখ করতেই হবে ১৯৭৮ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন এবং অপর্ণা দেবীর কয়েকটি কবিতা হেমন্তকে দিয়ে সুরারোপ করিয়ে বিভিন্ন শিল্পীকে দিয়ে গাওয়ানোর প্রচেষ্টার। হেমন্ত একক কণ্ঠে গেয়েছেন সেই ‘নামিয়ে নাও জ্ঞানের বোঝা’ – ১৯৭০-এর ছায়াছবির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা সুরে ও লয়ে। দ্বিতীয় একক গানটি যে একটি চতুর্দশপদী কবিতা বা ‘সনেট’-এর সুরারোপিত রূপ, সৌরভবাবু না দেখিয়ে দিলে প্রতিবেদকের মাথায় কখনোই আসত না। তাঁর সঙ্গে আমি পূর্ণ সহমত যে ‘মন্দ্র-গম্ভীর সপ্তকে বাঁধা ‘আমার এ প্রেম’ গানটি শুনলে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকতে হবে।’ এককালে, যখন কণ্ঠে সুর ছিল, বিভিন্ন বন্ধু-পরিচিতদের সমাবেশে এই গান গেয়ে অনেককেই চমৎকৃত করেছি!

তবে, হেমন্তর বিবিধ গান সম্পর্কে শেষ – এবং মোক্ষম – কথা অবশ্যই সৌরভবাবুর বলা। তা এতই ব্যক্তিগত এবং মর্মস্পর্শী যে প্রতিবেদক তাঁর বিরুদ্ধে ‘ইমোশনাল অত্যাচার’-এর অভিযোগ এনে এই প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা শেষ করছে।

৩। ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত ভাল হয়নি?’ (যুগ, বইমেলা সংখ্য, ২০২০)

এই ভুয়ো-উন্নাসিকতার যা ক্ষুরধার বিশ্লেষণ সৌরভবাবু করেছেন তা নিয়ে পূর্ণ সহমত পোষণ করা ছাড়া খুব বেশি কিছু করার থাকে না। রবীন্দ্রসঙ্গীত সিংহভাগ বাঙালীকে কারা ভালবাসতে শিখিয়েছেন প্রশ্ন করলেই সবার আগে উঠে আসবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম – এবং তারপর, এই প্রতিবেদকের মতে, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় ও সাগর সেনের। যে সব বিচিত্র জীবেরা ‘হেমন্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত ঠিক পিওর রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়নি, আধুনিক গান হয়ে গেছে’ বলে, সৌরভবাবুর ভাষায় ‘স্নব ঠোঁটদু’টি’ বাঁকান, তাদের মধ্যে কিন্তু আছে কিছু নমস্য ব্যক্তিত্বের নাম! ঠিক এই কথা আমি শুনেছি পন্ডিচেরীর শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমে রবীন্দ্র-সাহচর্য এবং আশীর্বাদ-ধন্যা সাহানা দেবীর মুখেঃ “গলা ভাল, আধুনিক গাইলেই পারে!” এবং এই মতের সমর্থনে বলা হয় যে হেমন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘সঠিক সুরে’ গান নি! সত্তরের দশকে, এক ২৩শে জানুয়ারি, রবীন্দ্র সদনে হেমন্ত গাইছেন ‘আগুনের পরশমণি’। সঞ্চারীতে এসে ‘আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব’ লাইনটিতে ‘পরশ তব’ হঠাৎ একটু অন্যভাবে গেয়েছিলেন। স্বরলিপি কঠোর ভাবে মেনে ‘গগনে গগনে আপনার মনে’ গাইতেন না বলে দীর্ঘকাল ঐ গানটি রেকর্ড করার অনুমোদন বিশ্বভারতী তাঁকে দেয়নি।



সৌরভবাবু আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে স্বরলিপি-বিচ্যুতি পাওয়া যাবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের বৃদ্ধ বয়সের রেকর্ডিঙে, এবং তার সমর্থনে ‘স্রষ্টা নিজে যা খুশি করুন গে’ একটা গা-জোয়ারি কুযুক্তি ছাড়া কিছু নয়। আসলে হেমন্তর বিরুদ্ধে যে সরলীকরণের অভিযোগ তোলা হয় সেটাই তাঁর রবীন্দ্র-গানে সফলতার চাবিকাঠি। সৌরভবাবুর ভাষায়, ‘স্বরলিপির যান্ত্রিক নিক্তি-মাপা শুদ্ধতার চেয়ে অভিব্যক্তির প্রাণময়তার ওপরেই বেশি মনোযোগ দিয়েছেন, কী সৌভাগ্য যে তিনি অমন দৈব কণ্ঠের দরদ-মীড়-স্পর্শস্বরের ওপর চালাননি প্রাতিষ্ঠানিক যান্ত্রিকতার স্টিমরোলার!’ আর ঠিক এই কারণেই প্রতিষ্ঠানের যে সব স্বনিযুক্ত অভিভাবকেরা রবীন্দ্রনাথের গানকে বাঙালীর দৈনন্দিন সম্পদ করে তোলায় হেমন্তর সাফল্যের সিকিভাগও অর্জন করতে পারেননি, তাঁদের একমাত্র আত্মশ্লাঘার উপায় হয়েছে ‘সমবেতভাবে হেমন্তকে ব্রাত্য মন্ত্রহীন পথভ্রষ্ট ঘোষণার … রাজনীতি।’

প্রায় ষাট বছর বয়সে তরুণ মজুমদারের নির্বাচনে এক কিশোর-যুব চরিত্রের কণ্ঠ হয়ে যখন হেমন্ত গাইলেন ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে’, তখন প্রেক্ষাগৃহে বসে যে অনির্বচনীয় ভাবাবেগের অভিজ্ঞতা এই প্রতিবেদকের হয়েছিল, তার নির্ভুল বর্ণনা সাধারণভাবে দিয়েছেন সৌরভবাবুঃ ‘ফুলের মালা দীপের আলো ধূপের ধোঁয়া দিয়ে আড়াল করতে যাননি বলেই [হেমন্ত] একেবারে অ-প্রথাগত, স্বচ্ছ-সহজ ভঙ্গিতে চরণ ছুঁয়ে ফেলেছেন!’

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন