কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২১


ট্রেডমিল

আমরা রোজ হাঁটি। আমি আর সুচিত্রা। দুজনে হাঁত ধরে হেঁটে চলি, হাঁটতেই থাকি। আমাদের আবাসনের চৌহদ্দির গেট পেরিয়ে যাই। হাঁটতেই থাকি। ফেরার সময় হাঁপ ধরে। তখন ভ্যানরিক্সা কিম্বা টোটোর সন্ধান করি। রাজারহাটের এদিকটা এখনও তত শহুরে হয়ে ওঠেনি। অনেক সবুজ অনেক গ্রাম অনেক সরস। এই আবাসনে কাটল প্রায় সাতবছর। আগে থাকতাম কলকাতার অতিব্যস্ত এক জায়গায়। সে ফ্ল্যাট বেচে দিয়েছি। তখন শুধু দৌড় আর দৌড়। ছেলে-মেয়ের জন্য, নিজেদের জন্য। এখন অবশ্য তারা ব্যস্ততর ট্রেডমিলে দৌড়চ্ছে।

আমাদের এখন হাঁটা।

উড়ে আসে আকাশ মাটি জলের ভেজা গন্ধ, ভালোই লাগে। দেখি মাছধরা জাল, ছিপ ফেলে বসে-থাকা মাছশিকারী। আমি বারকয়েক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছি। আমার ওরকম ধৈর্য নেই।

সুচিত্রা আমার চেয়ে ছ-বছরের ছোট। সম্বন্ধ করে বিয়ে। কলেজে প্রণতিকে ভালোবাসতাম, দেখতে খুব সুন্দর ছিল। গলার স্বর নরম। প্রণতি ওর বাড়িতে জানিয়েছিল, মত দেয়নি কেউ। মিটে গেছে। বিয়ের পরে প্রণতি কোথায় আছে, কেমন আছে, জানি না। জানার আগ্রহ হয়নি। ভাবতে ভাবতে আমি সুচিত্রার হাতের পাতা আরও জোরে চেপে ধরি। ও চমকে গিয়ে আমার দিকে তাকায়,

“কী হল?”

ঘাড় নাড়ি, কিছু না।

কাবুল হেঁটে আসছে এদিকে। লোকটা একটু পাগলাটে। কাঁধে গোটানো মাছধরা জাল, হাতে থলে। বলে,

“নেবেন নাকি বাবু? ভালো কাতলা ধরছি!”

“কত ওজন?” জিজ্ঞেস করতেই সুচিত্রা মাথা নাড়ে,

“কালই মাত্র বাজার এসেছে। ফ্রিজ ঠাসা!”

কাবুল চলে যায়। আমরা হাঁটি।

আমি খুব লম্বা, ভীষণ রোগা আর ফর্সা। সুচিত্রা বেঁটে, কালো, গোলগাল, বড়ো চোখ। গলার স্বর ফ্যাশফ্যাশে। বাহান্ন বছর ধরে আমরা বিবাহিত। আমি ছিলাম নামী সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সুচিত্রা রাজ্যসরকারে মাঝারি কর্মী।

“প্রদীপ!”

ওর ডাক শুনে চমকে তাকাই। এতবছরে কোনওদিনও সে আমাকে নাম ধরে ডাকেনি। আমিও বলিনি, শুনতেও চাইনি। আমার গলা কেঁপে যায়,

“অ্যাঁ? কী হল?”

“কিছুই না। তোমার বাইপাস সার্জারি হয়েছে। নিউরোলজিক্যাল প্রব্লেম আছে। আমার থাইরয়েড গ্ল্যাণ্ডে অস্ত্রোপচার হয়েছে। নী-রিপ্লেসমেণ্টও। দুজনেরই ক্যাটারাক্ট অপারেশন, দুজনেরই রক্তে চিনি বেশী। আর কত চাই?”

সুচিত্রা মুখ তুলে হাসতে থাকে। ওর পিঠে সরু লম্বা বেণী। সামনের চুল উঠে কপাল চওড়া। ছেড়ে-যাওয়া হাত মিলিটারি কায়দায় বাড়িয়ে ধরে,

“এসো কমরেড! যাই বলো এই অরেঞ্জ টী-শার্টে তোমার বয়স কিন্তু অর্ধেক হয়ে গেছে।”

আমি লজ্জা পাই। শার্টটা আমাদের ছেলের। গতবার এসে ফেলে গিয়েছিল।

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন