কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩

অদিতি সেন চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প

ভুত বলে কিছু নেই

'ভুত বলে কিচ্ছু নেই! যত্তসব উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা মাথায় জট পাকিয়ে গেলে মানুষ হ্যালুসিনেট করে — এই অব্দি সত্য।'

সতীশমামা খুব রেগে রেগে বলছিলেন আর মাসীমা তাঁর কথায় আপত্তি জানিয়ে মাথা নাড়ছিলেন। মাসীমা ভুতে ঘোর বিশ্বাসী। সন্ধ্যে হবার আগেই চুলে খোঁপা করে নেন, নইলে ভুতে ধরতে পারে তাঁকে। এঁটোকাঁটা মানামানি নিয়ে বাড়িশুদ্ধ লোককে জ্বালিয়ে মারেন। মাছখাওয়া শাড়ি ছেড়ে কেচে রাখেন, নইলে মাছখেকো পেত্নী ধরতে পারে। এহেন মাসীমার প্রেমে পড়েছেন মেজোমামার বন্ধু, চরম সাহসী আমাদের সতীশমামা। সন্ধ্যে সাতটা বাজলেই অফিস ফেরতা সতীশমামা এসে হাজির হন। একগামলা মুড়ি মাখা হয় আদা, পেঁয়াজ, চানাচুর দিয়ে। হ্যারিকেনের আলোয় কখনো চাইনিজ চেকার, কখনো বাগাডুলি, কখনো  ক্যারমবোর্ড নামানো হয়। বাড়ির যে যখন সময় পায়, এসে খেলে যায় একদান। সতীশমামার কলকাতার অফিস থেকে ফেরার ট্রেন কোনো কোনোদিন খুব লেট করে। মাসীমা তখন ঘরবার করেন দুশ্চিন্তায় আর মেজোমামা টিপ্পনি কাটেন - 'এতবার উঠোনে যাস না! বেলগাছের বেহ্মদত্যি নেমে আসবেন।' মাসীমা রেগে উঠতে গিয়েও ফিক করে মিষ্টি হেসে ফেলেন। সতীশমামা সাড়ে আটটা নাগাদ মামাদের পাশের পাড়ায় তাঁর পৈতৃক বাড়িতে তাঁর দাদা-বৌদির সংসারে ফিরে যান। এই গ্রামে এই আটের দশকেও ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। তাই হ্যারিকেনটি হাতে নিয়েই সতীশমামাকে উঠোনটা পার করে দিয়ে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকি আমি আর মাসীমা, যতক্ষণ না সতীশমামা বাঁকের আড়ালে তাঁর তিন ব্যাটারির টর্চ জ্বেলে অদৃশ্য হয়ে যান। তারপর আমরা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া গাছে ঢাকা উঠোনটা 'রাম রাম' করতে করতে আবার পেরিয়ে আসি। 

সেদিন ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছিল বিকেল থেকেই। সতীশমামা সাড়ে সাতটায় এসে হাজির হলেন। মেজোমামা হাঁকলেন — 'সতীশ! ট্রেন লেট করলো বুঝি? আজ কিন্তু বেগুনি আর পাঁপরভাজা দিয়ে মুড়ি খাওয়া হবে! ক্যারমবোর্ড নামাই আজ?' সতীশমামা কিছু না বলে চুপচাপ নিজের রোজকার বসার চেয়ারটায় গিয়ে বসে পড়লেন। আমরা হইহই করে ক্যারমবোর্ড পাতলাম। মুড়ি, বেগুনি, পাঁপরভাজা এলো। আজ একটু স্পেশাল আদা-চাও এলো। কিন্তু সতীশমামা বড্ড চুপচাপ থাকলেন আজ। মাসীমা জিজ্ঞাসা করলেন, - 'বৃষ্টিতে ভিজেছেন না কি? মাথা ধরেছে?' উনি মাথা নেড়ে 'না' বললেন। ঠিক সাড়ে আটটায় উঠে পড়লেন। আমি আর মাসীমা সদর দরজা অব্দি ছাড়তে গেলুম। উনি পাঞ্জাবির পকেট হাতরে একটু অবাক হয়ে বললেন - 'টর্চটা নেই তো!' মাসীমা বললেন — 'হ্যারিকেনটা নিয়ে চলে যান'। কিন্তু উনি সে কথায় কানও দিলেন না। যেমন যান রোজ, সেভাবেই চলে গেলেন। মাসীমা দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বলে উঠলেন 'দুগগা! দুগগা!'

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল কান্নাকাটি আর কী একটা গোলযোগের আওয়াজে। বিছানা ছেড়ে উঠে দেখি, সতীশমামার দাদা এবং আরো কয়েকজন পরিচিত মানুষজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন বাড়ির দাওয়ায়। মাসীমা অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন বারবার। টুকরো টুকরো কথায় যা বুঝলাম, গতকাল ট্রেন থেকে নামার সময় কীভাবে যেন সতীশমামা পড়ে যান। তখন তো আর প্ল্যাটফর্ম বলে কিছু ছিল না এই গাঁ গঞ্জে। তিনটে লোহার সিঁড়ি ভেঙে ট্রেন থেকে নামতে হতো। ঝুপঝুপে বৃষ্টির মধ্যে বেকায়দায় ট্রেনের চাকার তলায় পা ঢুকে যায় সতীশমামার এবং ট্রেন চলে যায় তার ওপর দিয়ে। বৃষ্টির জন্য সেখানে লোকজন কম ছিল। বেশ খানিকক্ষণ ওইভাবে পড়েছিলেন। হসপিটালে তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য পুলিশের গাড়ি এসে পৌঁছায় সাড়ে সাতটা নাগাদ।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন