বৃত্ত পেরিয়ে
মেঘ অদিতি
বিন্দু, বহুদূরে কালো হয়ে আসা একটা বিন্দুর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছি। চৈত্রের ঝাঁঝালো দুপুর। দু’চোখ পুড়ে যাচ্ছে তবু তাকিয়ে আছি। গ্রামের স্কুলগুলো কেমন যেন ফাঁকা মাঠের ওপর একলা দাঁড়িয়ে থাকে। ধারে কাছে কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু দূরে দূরে ঘন সবুজেরা এ ওর হাত ধরে আছে, আর কিছু ঘরবাড়ি। মনে হয় আজন্ম একা থাকার জন্যই স্কুলগুলো যেন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে অথচ যতক্ষণ ক্লাস চলে ততক্ষণ এমনটা লাগে না। কেবল ছুটির পর কলরোল থেমে গেলে হঠাৎ এই নীরবতায় মনে হয়, স্কুলবাড়ি আর আমি দুজনেই যেন সমবয়সী, দুজনেরই যে না বলা কত কথা জমে আছে!
মাইলখানেক হাঁটাপথ পেরিয়ে তবে আমার আবাসন, স্কুল থেকে বেরোবার আগে রোজই রোদে চোখ সয়ে নিতে জানালার ধারটায় চেয়ার টেনে কিছুক্ষণ বসি। চুপচাপ তাকিয়ে থাকি শূন্য মাঠটার দিকে। আজও বসেছি কিন্তু দূরের সেই বিন্দু আমাকে কী যেন বলতে চাইছে, আর কী আশ্চর্য, কোথা থেকে একটানা ভেসে আসছে একটাই শব্দ - টুসু।
কোথা থেকে! টুসু নামের কাউকে কি আমি চিনি!
- কথা বলবে না?
বুকের খাঁচা সামান্য দুলে উঠে খুব ডানা ঝাপটে দিল সে অচিন পাখি। মোটেই আমি জেদি বা রাগি নই। কারো সাথে রাগ ধরে রাখার মতো ক্ষমতা বা কাউকে ধমকে দেবার সাহসও মোটে আমার নেই, তবু এখন পাখিটাকে জোর ধমকে দিলাম। খাঁচাটাও দোলা বন্ধ করে আবার একলা হয়ে গেল।
- টুসুউউউ...
বিপদসংকেতের মতো আবার ভেসে এল ডাক। কে ডাকে! টুসু কে? সে এক কিশোরীকে চিনতাম, এমন চৈত্রের দুপুরে বুকে বই নিয়ে আকাশের নীলে ভেসে যেত, সেই টুসু? সে তো কবেই হারিয়ে গেছে। আমি টুসু নই, তবে কেন চারপাশ মুখর হয়ে উঠছে একটাই নামে - টুসুউউউ! এ ডাকে চুপ করে থাকা অসম্ভব অথচ ওই খাঁচাটা, ওকে চেপেচুপে বন্ধ করে গহীন দেশে পাঠাতে গিয়ে ওই ডাকের উত্তরে কী বলা উচিত, ভাবতে পারছি না। ভেতরে অস্থির লাগে, তবু স্থির কন্ঠে বলে উঠি, কে ডাকছ টুসু বলে!
- মৌ!
আমার পাশ থেকে একটা ছায়া হঠাৎ সামান্য দুলে যায়। দূরের বিন্দুটা কখন যেন মিলিয়ে গেছে। পাশ থেকে একটা ছায়া সামান্য দুলে এবার ফেরাতে চাইছে তার দিকে। মিলিয়ে যাওয়া বিন্দু থেকে জ্বালা ধরা চোখ সরিয়ে ঘাড় ফেরাই। ছায়ার মতো তবে ঠিক ছায়া নয়, মানুষেরই আদল তবে ঠিক মানুষও সে না। রাহাত এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। ঘুরে তাকাতেই স্পষ্ট হয় দীর্ঘদিনের অদেখা রাহাত আর তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বিব্রত হাসি। টুসু নয়, মৌকে ডাকছে সে। কিন্তু রাহাত এখানে কী করে এল?
আপাতত কোনো পাণ্ডুলিপি নেই আমার কাছে অথবা কথা চালাবার মতো কোনো নিয়মবদ্ধ রূপরেখাও নেই, তবে একটা স্থির সিদ্ধান্ত আছে। তাতে ভর করে বললাম, রাহাত! ভালো আছ? অনেকদিন আগের এলোমেলো মৌ অথবা তারও অনেক অনেক দিন আগে রূপকথার বইতে যেমন ছবি থাকে সেরকম টুসু যাকে সে কুড়ি বছর আগে ঘরে এনে ক্রমাগত টুসুকে ভেঙে মৌমিতার আদল দিতে গিয়ে তাকে ভেঙেচুরে ফেলেছিল, সে দুজনের কাউকেই দেখতে পেল না রাহাত। ওর ঠোঁট থেকে হাসিটা মুছে কেমন একটা অসহায়ত্ব ফুটে উঠল।
- এদিকে কোনো কাজে এসেছিলে?
- না, তেমন কিছু নয়।
তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, কিছু খাবে? যদিও স্কুল তো ছুটি হয়ে গেছে।
রাহাত রুমাল বের করে আনল পকেট থেকে, পথের ক্লান্তি মুখ থেকে মুছতে মুছতে বলল, ঠিক আছে। কিছু দরকার নেই।
চারপাশটা আবার নীরব হয়ে উঠল। কিছুটা বাতাস যেন উবে গেল ঘর থেকে। দূরের যে বিন্দুটা মিলিয়ে গিয়েছিল সেখানে দেখা গেল দুই বেণী করা টুসুকে দাঁড়িয়ে থাকতে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে মৌমিতা। রাতভর কেঁদে ফুলে ওঠা চোখ নিয়ে বাসন মাজবে বলে সে ছাই তুলে নিচ্ছে হাতে। সব কাজ শেষ করে যে কলেজে যাবে আর ফিরে এসে মুখ বুজে কাজের ফাঁকে বইয়ের পাতা ওল্টাবে। টুসু মৌমিতাকে দুলে দুলে কোনো একটা গান শোনাচ্ছে আর মৌ ছাই হাতে টুসুকে আদর করছে। হঠাৎ কোথা থেকে যেন খুব মেঘ হলো, টুসু তখন নেই। একলা মৌমিতা তার উসকোখুসকো চুল সামলে রান্নার ফাঁকে খাতা খুলেছে। রাহাতকে তখনই হঠাৎ দেখা গেল মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে আর আর্তনাদে ভরে উঠল চারপাশ। চুলোর জ্বলন্ত কাঠ চেপে ধরেছে রাহাত মৌমিতার ডান হাতে...
বুকের ভেতর পাখিটা আবার ডানা ঝাপ্টে উঠছে। দূরের টুসু আর মৌ-এর বদলে দূরে আবার সেই বিন্দুটা। নিজের কাছে সরে আসতে আসতে জানতে চাইলাম, তবে কি আমার কাছেই এসেছে রাহাত? এতগুলো বছর পর এসে দাঁড়িয়েছে কি শুধু আমাকে একবার দেখে যেতে? দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের কু ঝিকঝিক আমাকে মাঝপথে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে দিল। যেন ওয়েটিং রুমের অপেক্ষায় ছিলাম, কখন ট্রেন আসবে। অপেক্ষার সে সময়টুকু জুড়ে চলছিল যেন কোনো সাদাকালো ছবি। রাহাতের দিকে ফিরে বললাম, আমাকে বেরোতে হবে। পিছনের ক্যানভাস জুড়ে নিখাদ কালো মেঘে মেঘে খোদাই করা রাহাতের হতভম্ব মুখ, বাইরে গনগনে রোদ। অচিন পাখিটা বুকের ভেতর তখন একটানা ডাকছে, টুসু... টুসু... টুসু...
বিন্দু, বহুদূরে কালো হয়ে আসা একটা বিন্দুর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছি। চৈত্রের ঝাঁঝালো দুপুর। দু’চোখ পুড়ে যাচ্ছে তবু তাকিয়ে আছি। গ্রামের স্কুলগুলো কেমন যেন ফাঁকা মাঠের ওপর একলা দাঁড়িয়ে থাকে। ধারে কাছে কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু দূরে দূরে ঘন সবুজেরা এ ওর হাত ধরে আছে, আর কিছু ঘরবাড়ি। মনে হয় আজন্ম একা থাকার জন্যই স্কুলগুলো যেন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে অথচ যতক্ষণ ক্লাস চলে ততক্ষণ এমনটা লাগে না। কেবল ছুটির পর কলরোল থেমে গেলে হঠাৎ এই নীরবতায় মনে হয়, স্কুলবাড়ি আর আমি দুজনেই যেন সমবয়সী, দুজনেরই যে না বলা কত কথা জমে আছে!
মাইলখানেক হাঁটাপথ পেরিয়ে তবে আমার আবাসন, স্কুল থেকে বেরোবার আগে রোজই রোদে চোখ সয়ে নিতে জানালার ধারটায় চেয়ার টেনে কিছুক্ষণ বসি। চুপচাপ তাকিয়ে থাকি শূন্য মাঠটার দিকে। আজও বসেছি কিন্তু দূরের সেই বিন্দু আমাকে কী যেন বলতে চাইছে, আর কী আশ্চর্য, কোথা থেকে একটানা ভেসে আসছে একটাই শব্দ - টুসু।
কোথা থেকে! টুসু নামের কাউকে কি আমি চিনি!
- কথা বলবে না?
বুকের খাঁচা সামান্য দুলে উঠে খুব ডানা ঝাপটে দিল সে অচিন পাখি। মোটেই আমি জেদি বা রাগি নই। কারো সাথে রাগ ধরে রাখার মতো ক্ষমতা বা কাউকে ধমকে দেবার সাহসও মোটে আমার নেই, তবু এখন পাখিটাকে জোর ধমকে দিলাম। খাঁচাটাও দোলা বন্ধ করে আবার একলা হয়ে গেল।
- টুসুউউউ...
বিপদসংকেতের মতো আবার ভেসে এল ডাক। কে ডাকে! টুসু কে? সে এক কিশোরীকে চিনতাম, এমন চৈত্রের দুপুরে বুকে বই নিয়ে আকাশের নীলে ভেসে যেত, সেই টুসু? সে তো কবেই হারিয়ে গেছে। আমি টুসু নই, তবে কেন চারপাশ মুখর হয়ে উঠছে একটাই নামে - টুসুউউউ! এ ডাকে চুপ করে থাকা অসম্ভব অথচ ওই খাঁচাটা, ওকে চেপেচুপে বন্ধ করে গহীন দেশে পাঠাতে গিয়ে ওই ডাকের উত্তরে কী বলা উচিত, ভাবতে পারছি না। ভেতরে অস্থির লাগে, তবু স্থির কন্ঠে বলে উঠি, কে ডাকছ টুসু বলে!
- মৌ!
আমার পাশ থেকে একটা ছায়া হঠাৎ সামান্য দুলে যায়। দূরের বিন্দুটা কখন যেন মিলিয়ে গেছে। পাশ থেকে একটা ছায়া সামান্য দুলে এবার ফেরাতে চাইছে তার দিকে। মিলিয়ে যাওয়া বিন্দু থেকে জ্বালা ধরা চোখ সরিয়ে ঘাড় ফেরাই। ছায়ার মতো তবে ঠিক ছায়া নয়, মানুষেরই আদল তবে ঠিক মানুষও সে না। রাহাত এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। ঘুরে তাকাতেই স্পষ্ট হয় দীর্ঘদিনের অদেখা রাহাত আর তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বিব্রত হাসি। টুসু নয়, মৌকে ডাকছে সে। কিন্তু রাহাত এখানে কী করে এল?
আপাতত কোনো পাণ্ডুলিপি নেই আমার কাছে অথবা কথা চালাবার মতো কোনো নিয়মবদ্ধ রূপরেখাও নেই, তবে একটা স্থির সিদ্ধান্ত আছে। তাতে ভর করে বললাম, রাহাত! ভালো আছ? অনেকদিন আগের এলোমেলো মৌ অথবা তারও অনেক অনেক দিন আগে রূপকথার বইতে যেমন ছবি থাকে সেরকম টুসু যাকে সে কুড়ি বছর আগে ঘরে এনে ক্রমাগত টুসুকে ভেঙে মৌমিতার আদল দিতে গিয়ে তাকে ভেঙেচুরে ফেলেছিল, সে দুজনের কাউকেই দেখতে পেল না রাহাত। ওর ঠোঁট থেকে হাসিটা মুছে কেমন একটা অসহায়ত্ব ফুটে উঠল।
- এদিকে কোনো কাজে এসেছিলে?
- না, তেমন কিছু নয়।
তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, কিছু খাবে? যদিও স্কুল তো ছুটি হয়ে গেছে।
রাহাত রুমাল বের করে আনল পকেট থেকে, পথের ক্লান্তি মুখ থেকে মুছতে মুছতে বলল, ঠিক আছে। কিছু দরকার নেই।
চারপাশটা আবার নীরব হয়ে উঠল। কিছুটা বাতাস যেন উবে গেল ঘর থেকে। দূরের যে বিন্দুটা মিলিয়ে গিয়েছিল সেখানে দেখা গেল দুই বেণী করা টুসুকে দাঁড়িয়ে থাকতে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে মৌমিতা। রাতভর কেঁদে ফুলে ওঠা চোখ নিয়ে বাসন মাজবে বলে সে ছাই তুলে নিচ্ছে হাতে। সব কাজ শেষ করে যে কলেজে যাবে আর ফিরে এসে মুখ বুজে কাজের ফাঁকে বইয়ের পাতা ওল্টাবে। টুসু মৌমিতাকে দুলে দুলে কোনো একটা গান শোনাচ্ছে আর মৌ ছাই হাতে টুসুকে আদর করছে। হঠাৎ কোথা থেকে যেন খুব মেঘ হলো, টুসু তখন নেই। একলা মৌমিতা তার উসকোখুসকো চুল সামলে রান্নার ফাঁকে খাতা খুলেছে। রাহাতকে তখনই হঠাৎ দেখা গেল মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে আর আর্তনাদে ভরে উঠল চারপাশ। চুলোর জ্বলন্ত কাঠ চেপে ধরেছে রাহাত মৌমিতার ডান হাতে...
বুকের ভেতর পাখিটা আবার ডানা ঝাপ্টে উঠছে। দূরের টুসু আর মৌ-এর বদলে দূরে আবার সেই বিন্দুটা। নিজের কাছে সরে আসতে আসতে জানতে চাইলাম, তবে কি আমার কাছেই এসেছে রাহাত? এতগুলো বছর পর এসে দাঁড়িয়েছে কি শুধু আমাকে একবার দেখে যেতে? দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের কু ঝিকঝিক আমাকে মাঝপথে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে দিল। যেন ওয়েটিং রুমের অপেক্ষায় ছিলাম, কখন ট্রেন আসবে। অপেক্ষার সে সময়টুকু জুড়ে চলছিল যেন কোনো সাদাকালো ছবি। রাহাতের দিকে ফিরে বললাম, আমাকে বেরোতে হবে। পিছনের ক্যানভাস জুড়ে নিখাদ কালো মেঘে মেঘে খোদাই করা রাহাতের হতভম্ব মুখ, বাইরে গনগনে রোদ। অচিন পাখিটা বুকের ভেতর তখন একটানা ডাকছে, টুসু... টুসু... টুসু...
ভাল লেগেছে
উত্তরমুছুননাইস। খুব ভালো লাগেছে। আরও গল্প পড়ার আশা রাখছি।
উত্তরমুছুন