কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৩

পম্পা বিশ্বাস

পাশের বাড়ির মাসিমা
পম্পা বিশ্বাস



পাশের বাড়ির মাসিমা ঠিক যেন মানুষ নন, মানুষের মতো কোনো এক প্রাণী! এই ভাবনাটা আমাকে বেশ কিছুদিন ধরেই জ্বালাচ্ছে। তাই তাঁকে আমি গোপনে খুবই নজর করি। একটু টানও যে তাঁর প্রতি অনুভব করি না, তা নয়। এই যেমন সেদিন ওঁকে কালিঘাটে নিয়ে যেতে হলো। উনি পুজো দেবেন। ফেরার পথে একটা বাসে উঠলাম। প্রচন্ড ভিড় বাসে। ভিড়ে আর গরমে মাসিমা ঘামছিলেন দরদর করে। ওনার ঘামে আমার পরনের জামা ভিজে যাচ্ছিল। বাড়ি ফিরে দেখলাম, মাসিমার ঘামে ভেজা আমার সাদা জামার জায়গাগুলো হালকা বাদামী হয়ে গেছে। বুঝলাম, মাসিমার ঘামের রঙ বাদামী। অনেক ধুয়েও সেই দাগ আমি তাড়াতে পারিনি।

এই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরে, একগোছা নিমপাতা নিয়ে আমি ঢুকছিলাম মাসিমার বাড়ি। ঘরে এক-পা রেখেছি, হঠাৎ বাজ পড়ার মতো গর্জন। সেইসঙ্গে ঠকাস্‌ করে কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলার আওয়াজ। দেখি, মেসোমশাই ক্রুদ্ধ বাঘের মতো গজরাচ্ছেন। একটা পেপারওয়েট ছিটকে পড়েছে মাটিতে। মাসিমা কপালে হাত দিয়ে স্লো-মোশানে পড়ে যাচ্ছেন। ওঁর কপাল থেকে ছিটকে লাল রক্ত বেরোচ্ছে। তাহলে নিশ্চয়ই মাসিমা মানুষ!... কিন্তু কী আশ্চর্য, মাসিমার গলা থেকে একটা শব্দও বেরোচ্ছে না! ছুটে গেলাম আমি। তাঁকে তুলে কপালে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলাম। তিনি সস্নেহে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে আমার থুতনি উঁচু করে ধরে একটু হাসলেন। ঠিক করলাম, মাসিমা মানুষ কি মানুষ-নন, এই দ্বন্দ্ব দূর না হলে আমি আর ও বাড়ি যাব না।

তারপর অনেক দিন যাইনি আমি মাসিমার বাড়ি। কিন্তু একদিন মাসিমার ছেলেমেয়েরা আমাকে ডেকে পাঠালো। শুনলাম, এ-গলির যে ল্যাজনাড়া ঘেয়োটাকে উনি রোজ খেতে দিতেন, সেটা দু’দিন আগে বেপাড়ায় মারা গেছে। তারপর থেকে

উনি কিছুই খাচ্ছেন না। শুধুই কাঁদছেন। ভারি আশ্চর্য ব্যাপার! মাসিমাকে তো কোনোদিন কাঁদতে দেখিনি! গিয়ে দেখি, মাসিমার চোখ থেকে ছাইরঙা জলের স্রোত নেমে বুকের কাপড় ভিজিয়ে দিচ্ছে। চোখের জলের এমন রঙ আগে কখনও দেখিনি। মাসিমার চোখ মোছাতে গিয়ে আমার হাতেও ছাই-ছাই তরল লেগে গেল। অনেক ধুয়েও সেই রঙ আমি তাড়াতে পারিনি।

তাহলে কি আমার ভাবনাই ঠিক, মাসিমা ঠিক যেন মানুষ নন, মানুষেরই মতো কোনো এক প্রাণী!

1 কমেন্টস্: