কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৩

অর্পণ চক্রবর্তী

হাফ-মার্ডার
অর্পণ চক্রবর্তী


ঝোপঝাড়ের ভিতরে বডিটা পড়েছিল। শুধু পা দুটো বাইরে। দেখে বোঝার উপায় ছিল না লোকটার জান এখনো লেগে আছে বডিতে। ক্যানিং অঞ্চলের গ্রামের রাজনীতি আর জমিজমার ভাগাভাগি নিয়ে এরকমটা হামেশাই হয়। খবর পেয়ে ছেলে প্রদীপ ফিরল কলকাতার নামকরা কলেজের হস্টেল থেকে পড়াশুনো মাথায় তুলে, হাতে একটা রামদা আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে এই গাঁ ঐ গাঁ ঘুরণপাক মারল। যারা হাফ-মার্ডার করেছিল বাবাকে, তারা ধাঁ। বাবার জমিজিরেত আছে, পাশের গাঁয়ের সেকেন্ডারি স্কুলের প্রাক্তন হেডমাস্টার, পার্টির লিডারও বটে। প্রদীপ থানায় ডায়েরি করল একটা, আততায়ীদের নামে কেস শুরু হলো। কলকাতার নার্সিংহোমে বাবাকে ভর্তি করে চিকিৎসা চলল অনেকদিন। ফলে কলকাতার কাছেই সোনারপুরে বাড়ি ভাড়া করে মা’কে নিয়ে থাকতে শুরু করল প্রদীপ। বাবা সেরেও উঠলেন, কিন্তু ততদিনে মা আর ছেলে মিলে সোনারপুরেই কয়েক কাঠা জমি কেনার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে বায়নাও দিয়ে রেখেছে। নার্সিংহোম থেকে ফিরে প্রদীপের বাবার প্রথম কাজ হলো জমির দাম মেটানো। দীর্ঘদিন চিকিৎসার খরচ, তার সঙ্গে এই জমি কেনার খরচ -- ভদ্রলোক একটু বেশি মাত্রায় খিটখিটেই হয়ে উঠলেন। ছেলেকে বললেন -- '' দেখো বাপু, টাকাপয়সা আর আমার নেই। বাড়ি তৈরির খরচ আমি দিতে পারব না। সে ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে, এইটা ভালো করে বুঝে যাও।'' অতঃপর তাঁর কাজ হলো সপ্তায় দু’তিনদিন ট্রেনে করে গাঁয়ের বাড়িতে গিয়ে জমিজিরেত চাষবাস সামলে আসা। আর ফেরার সময় স্টেশন থেকে হেঁটে সদ্যকেনা জমিটার সামনে বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা। মাঝে মাঝে ওখানেই ছেলের সঙ্গেও দেখা হয়ে যায় তাঁর। সেও কলেজফেরতা ওখানে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। সন্ধের আবছায়া একটা একতলা বাড়ির আকার নিতে থাকলে বাপ-ছেলে ভাড়া বাড়ির পথে পা বাড়ায়। এই পথটুকু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। এইভাবে বাবা আর ছেলের নিশ্চুপ হয়ে পাশাপাশি হাঁটাটা একটা অভ্যেসে রূপ নেওয়ার মাস ছয়েক পর একদিন এর প্রথম ব্যত্যয় ঘটল।

সেদিনটাও অন্যদিনের মতোই জমির দেখভাল করে ক্যানিং থেকে ট্রেন ধরে সোনারপুর ফিরছিলেন প্রদীপের বাবা। ছুটির দিন ছিল বলে ট্রেনটা মোটামুটি ফাঁকা। হঠাৎই কয়েকটা স্টেশন পর তিনজন লোক নিজেদের মধ্যে উত্তেজিত ভাবে কথা বলতে বলতে বাবার সামনের সিটে এসে বসে পড়েই বাবাকে দেখে চুপ করে গেলো। বাবাও চুপ। তারা হাঁ করে দেখছে বাবাকে, আর বাবা তাদেরকে। এদের দেখে এখন কল্পনা করাও অসম্ভব, এরাই সেদিন শাবল-টাঙ্গি-হেঁসো-দা নিয়ে মেরে ফেলে রেখে এসেছিলো তাঁকে। বাবা মারাত্মক ভয় পেয়ে চুপ করে গেলেন, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না তাঁর। মনে হচ্ছিল সেদিনের আধা কাজটা আজ পুরো করার প্রস্তুতি নিয়েই এরা এসেছে। মুহূর্তের মধ্যে তিনি ভেবে নিলেন, এদের যে তিনি আদৌ চিনেছেন সেটাই বুঝতে দেবেন না । এটাই একমাত্র বাঁচার রাস্তা, নইলে আজ ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েই মার্ডার করবে এরা। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টায় তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেন। টেনশনে বিড়িও ধরিয়ে ফেললেন একটা। আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলেন, ম্যাচিস জ্বালাতে গিয়ে একটুও হাত কাঁপল না তাঁর। বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকেই তিনি বুঝতে পারছিলেন, একটা হাত এসে তাঁর হাঁটুর ওপর আলতো করে ছুঁয়েছে। না-তাকিয়েই তিনি বুঝতে পারছিলেন, এটা সেই হাত যে-হাতের শাবলের প্রচণ্ড বাড়িটা মাথার ওপর নিয়েই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। মেরুদণ্ডের শিরশিরে অনুভূতির বদলে একটা অবাক হওয়ার ভাব তাঁকে ছেয়ে ফেলায় তিনি যখন এদের দিকে ফিরে তাকালেন, আলাদা করে অপরিচিতের অভিনয় করতে হলো না। তাঁর সারা শরীরে তখন একটা অপরিচয়ের জিজ্ঞাসা ফুটে বেরোচ্ছে। তিনি দেখলেন, একজন তাঁর হাঁটুর কাছটা চেপে ধরে আছে খুব অনুনয়ের সঙ্গ্‌ আর অন্যরা দু’হাত জোড় করে করুণ মুখে তাকিয়ে আছে।

যে লোকটি শাবল চালিয়েছিল, সে আমতা আমতা করে বলল -- ''দাদা এখন সুস্থ তো? ব্যথা কি আছে এখনো?''

যে লোকটি দা চালিয়ে দিয়েছিল পিঠে, সেও খুব লজ্জার সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করল -- ''আসলে আমরা সেদিন আপনাকে ঐভাবে ফেলে চলে এসেছিলাম... সেটা ঠিক হয় নি কিনা... মানে আপনি যে বেঁচে আছেন সেটাই বুঝতে পারিনি...''

বাবা উত্তরোত্তর অবাক হচ্ছিলেন। তৃতীয় লোকটি, যে টাঙ্গি দিয়ে চিরতে এসেছিলো, সে এবার ধমকে থামাল দ্বিতীয়জনকে... তার হাত তখনো জোড় করা। সে খুব বিনীত ভাবে বলল -- ''কিছু মনে করো না চিনুকাকা... যা হবার তা' তো হয়েই গেছে... তোমারও কপালে দুর্ভোগ ছিল, আমাদেরও। তোমার ফাঁড়াটা তো কাটল, কিন্তু আমাদের ভোগান্তির কি শেষ আছে কিছু? এই দেখো না, পুলিশের ভয়ে বাড়ির পানে যেতেই পারি না। চাষবাস তো লাটে উঠেছে... বাচ্চাটার মুখটাও কদ্দিন দেখি না। মাঝে শুনলাম জ্বর হয়েছিল, তাও যেতে পারলাম না। ওদের অবস্থাও হরে দরে একইরকম। এখন কী করবো তুমিই বল কাকা!''

বাবা ততক্ষণে গাম্ভীর্য ফিরে পেয়েছেন... সেটা মুখে যথাযথ বসাতে বসাতে জিজ্ঞেস করলেন -- ''এখন থাকছ কোথায়?''

- ''কাকা, তুমি আবার পুলিশে খবর দেবে বলে জিজ্ঞেস করছ না তো?''

বাবা এবার উঠে দাঁড়ালেন -- ''থাক, বোলো না... সোনারপুর এসে গেলো... আমি চললাম।'' নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তিনজনেই লাফ মেরে উঠে পড়লো -- ''না কাকা , আমরাও নামব... তুমিও সোনারপুরে থাকো? আমরাও তো এখানেই ঠেক গেড়েছি...''



খানিকক্ষণ পরে বাবার সঙ্গে ঐ তিনটি লোককেই দেখা গেলো সেই ফাঁকা জমিটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে... তারা অপেক্ষা করছিলো কখন প্রদীপ আসবে। এদের ক্ষমা করা যাবে কিনা, সেটা প্রদীপের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন বাবা। প্রদীপ এলো, যেমনটা আসে। বিস্ময় রাগ ভয় আতঙ্ক প্রতিশোধস্পৃহা -- সবই পরপর খেলা করে গেলো তার মুখে চোখে শরীরে... তারপর বাবাকে বলল '' তুমি বাড়ি যাও, আমি এদের সঙ্গে কথা বলে পরে আসছি।'' বাবা একটু ভয়ে ভয়েই ফিরলেন... প্রদীপের জন্যে চিন্তা নিয়ে। খুব বেশি সময় গেলো না... মিনিট কুড়ির মধ্যেই চলে এল ছেলে... মুখে পরিতৃপ্তি আর অবসাদ একই সঙ্গে। ঠাণ্ডা এক গ্লাস জল চোঁ চোঁ করে খেয়ে বলল -- ''কেসটা তুলে নেওয়ার জন্যে হাতে-পায়ে ধরছিল। পাঁচ চেয়েছিলাম, তিনে রাজি হলো... যাক্‌ একতলাটা উঠে যাবে, কি বল বাবা! আরও কিছু লাগলে তুমি তো আছই!''



ছেলের শেষ কথাটার মানে আজও ভালো করে বুঝে উঠতে পারলেন না চিন্তামণিবাবু।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন