কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১

মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম: প্রাণের মানুষ




 

(১)

অনেকদিন হল লেখালেখি বন্ধ। আসলে লেখা শুরু করেছিলাম মা’কে গল্প শোনাবো  বলে। শীতকালের তিনটে মাস জাহাজে ঘুরে বেড়াতাম ক্যারিব সাগরের দ্বীপ দ্বীপান্তরে। মা কলকাতায় বসে উদগ্রীব হয়ে থাকতো আমার ভেসে বেড়ানোর গল্প শুনবে বলে। যা দেখতাম, যা শুনতাম, যা অনুভব করতাম তা লিখে ফেলতাম ঝটপট। জাহাজ বন্দরে ভিড়লেই সেগুলি মা’কে পাঠিয়ে দিতাম ই-মেল্ মারফত।  মা আমার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজে ভেসে ভেসে চলে যেত বার্বাডোস, সান হুয়ান,  কুরাসাও। ক্যারিব সাগরের মত ময়ূরকন্ঠী রঙ পৃথিবীর আর কোনো সমুদ্রে নেই।   রোদ্দুরের আলোয় মহাসমুদ্রের ছলকে ওঠা রঙমাখা চিঠি লিখতাম মাকে। মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার বন্ধুরাও মায়ের চিঠি পড়ত। তারাও ভেসে যেত আমার সঙ্গে। তারপর মায়ের অসুখ… মায়ের কষ্ট… গত বছর মায়ের চলে যাওয়া। আমার প্রাণের মানুষের চলে যাওয়া। তার চলে যাওয়ার চেয়ে  চলে যাওয়ার সুদীর্ঘ প্রস্তুতি আমাকে ঝাঁঝরা করেছিল অনেক বেশি।  কীবোর্ডে আর আঙ্গুল সরে না । মননে সুদীর্ঘ  মন্বন্তর।

ধীরে ধীরে দিন যায়। বছর গড়ায়। আমি যেহেতু অনেক দূরে থাকি তাই মায়ের ব্যবহার করা জিনিসপত্র, মায়ের ফাঁকা ঘর, মায়ের বিছানা… এসব কিছুই আমি দেখি না... মা আমার বাগানে ফুল হয়ে ফোটে… পাখি হয়ে গান শোনায়… কাঠবিড়ালী হয়ে বাদাম খায়...

আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে

তাই হেরি তায় সকল খানে

আছে সে নয়নতারায়

আলোকধারায়

তাই না হারায়

ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়

তাকাই আমি যে দিক-পানে,

প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে

তাই হেরি তায় সকল খানে।

তা এই নিয়ে পর পর তিনবার কলকাতা যাবার টিকিট পেছোতে হলো। অতিমারীর উপর্যুপরি ঢেউয়ে বেসামাল জগৎ সংসার। নতুন পদ্ধতিতে গৃহবন্দী অবস্থায় ক্লাস পড়ানো রপ্ত  করলাম। স্পর্শহীন, শুচিবায়ুগ্রস্ত মোক্ষদা পিসিমা মার্কা দিনযাপন।  ছাত্রদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা নেই, কথা নেই, আলোচনা নেই। প্রাণ উচাটন মন উচাটন। এর মধ্যে পটাপট অতিমারীরোধক দুটো ইঞ্জেকশনের রক্ষাকবচ।  ঠিক করলাম কলেজ বন্ধ হলে একটা লম্বা সফরে বেরিয়ে এই দেশটা এক্কেবারে  অতলান্তিক থেকে শুরু করে প্রশান্ত  মহাসাগর  পর্য্যন্ত দেখে আসব। কিন্তু আমার মধ্যে অতীশ দীপঙ্কর ভাব কম। প্রেমভাব বেশি। সারাক্ষণ মাথার মধ্যে বিজবিজ করে আজগুবি সব পরিস্থিতি। এই বেশ সুদূর মন্টানায় আমার গাড়ি খারাপ হয়ে যাবে, সন্ধ্যে নামবে  হাইওয়ে-তে। ১৮ চাকার ট্রাকগুলি সাই সাই করে পাশ দিয়ে বিদ্যুৎবেগে ছুটে যাবে।... আর তখন... আর তখন...

মাথার মধ্যে ইলা বসু আনতাবরি গুনগুন করেই চলেছেন...

"কত রাজপথ জনপথ ঘুরেছি

মরুভূমি সাগরের সীমানায়

সাতটি সে পৃথিবীর বিস্ময়

তুমি তারও চেয়ে বেশি মনে হয়।"

গত বছর নানারকম হিবিজিবি জিনিসের মধ্যে যেটা দারুণ ভাল হলো সেটা হল পামেলা আমার সঙ্গে থাকতে শুরু করল। আমার একতলার একটা ঘর ফাঁকাই পরে থাকত। পামেলা সেই ঘরটি ভাড়া নিলো। কিছুদিনের মধ্যে ওর একটা বাড়ি কেনার প্ল্যান। তাই ও আর এপার্টমেন্টের কন্ট্রাক্টের ভেতরে ঢুকতে চাইছিলো না। পামেলা আমার প্রিয় বন্ধু এবং বড় মেয়ে, এই দুটি ভূমিকার মাঝে খুব স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করে। পামেলা আমার সঙ্গে থাকাতে ঋজুও খানিকটা স্বস্তিতে। নইলে আমার কাণ্ডকারখানার প্ৰায়েই ওর পিলে চমকায়। পামেলা ঋজুর চেয়ে দশ বছরের বড়। তবে ঋজুর ভক্তিপূর্ণ পামেলা মাসি ডাকে আঁৎকে উঠে বলেছিলো... 'Please call me Pam'.

তা ঠিক হলো আমি আর পামেলা এই আমেরিকা ভ্রমণে বেরোবো জুলাই মাসের গোড়ার দিকে। পামেলার অবশ্য আমার মতো লম্বা গরমের ছুটির আয়েশ নেই। তাই জুলাই ৪এর ছুটিটা, শনি রবিবার আর দু একটা জমানো ছুটি যোগ করে খুব কারিকুরি করে একটা প্ল্যান বানানো হলো। রিমোট কাজ করার সুবিধে হলো রিমোট ব্যাপারটা বোস্টনও হতে পারে আবার শিকাগোও হতে পারে। ঠিক হলো একটা SUV গাড়ি ভাড়া করা হবে। পামেলার  SUV গাড়ি চালানো অভ্যেস আছে। বেশ শক্তপোক্ত গাড়ি। ধাক্কাধাক্কি হলে কম লাগবে। আমরা পুরোটা পথ গাড়িতে আর কিছুটা ট্রেনে করে যাবো। দেশ দেখার এইটেই সবচেয়ে ভালো উপায়। এইসব প্ল্যান ট্যান করে আমরা ট্রেনের টিকিট কাটলাম, হোটেল ভাড়া করলাম, SUV গাড়ি বুক করলাম। প্রাণের মধ্যে যাকে বলে  ঝিং চ্যাক বাজনা বাজছে...

কলকাতা থেকে খবর এলো... পামেলার মা খুব অসুস্থ। সত্বর একটা জটিল অপারেশন করতে হবে। পামেলাকে তক্ষুনি চলে যেতে হবে কলকাতা।

 

(২)

পামেলার সঙ্গে আমার একটা বিশাল প্রজন্মগত তফাৎ আছে। এই যেমন আমি রাজেশ খান্না হলে ও রাজকুমার রাও... আমি আন্দ্রে আগাসি হলেও রাফায়েল নাদাল... আমি ন্যাট কিং কোল হলেও এনরিকে ইগলেসিয়াস। (নাদাল এবং  এনরিকেকে পছন্দের পেছনে আরও একটি গূঢ়  কারণ আছে... তবে সেটি এখানে উহ্য থাক)। তাই অতলান্ত-প্রশান্ত সফরে আমি ট্রিপল এ হলে ও গুগল ম্যাপ। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি ট্রিপল-এ হলো AAEIএর মার্কিন সংস্করণ। যুক্তরাষ্ট্রের পেট চেরা সফরে যেতে হবে... এ কি কম কথা? কোন কোন প্রদেশে কি কি দ্রষ্টব্য আছে, কোথায় রেস্তোরাঁ ভালো, রাস্তায় গাড়ি খারাপ হলে ইলা বসুর গান থামিয়ে সত্যি সত্যি কে সামলাবে? এই সব জটিল প্রশ্নের সমাধান করতে আমার মতে ট্রিপল-এ ছাড়া গতি নেই।

যে কথা সেই কাজ । প্লিমাউথের ট্রিপল-এ আপিসে গিয়ে আমি বিশাল বিশাল  ম্যাপ জোগাড় করলাম, ট্যুরবুক গুছিয়ে নিলাম খান দশেক, কাউন্টারের ভদ্রলোককে প্রশ্ন করে করে মাথার ঘিলু ছিবড়ে করে বীরবিক্রমে বাড়ি। স্টাডি টেবিলের ওপরে নানারকম ম্যাপ আর ট্যুরবুক ছড়িয়ে সফরের পরিকল্পনা। নাওয়া  নেই খাওয়া নেই  ঘুম নেই বিশ্রাম নেই। চেহারা দেখলে মনে হবে সদ্য কঠিন রোগ থেকে উঠেছি। আমার ধরনটা একটু গোলমেলে। যতক্ষণ না সব কিছু ঠিক ঠিক  খাপে খাপ হচ্ছে ততক্ষণ একটানা লেগে থাকবো। দেখলে মনে হবে রায় ও মার্টিনের বিজ্ঞাপক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। পামেলা মাঝে মাঝে আপিসের মিটিংয়ের ফাঁকে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে যায়। একবার চোখ গোল গোল করে চিন্তিত মুখে বলল:

'তোমার কি জ্বর এসেছে নাকি?'

স্টাডি টেবিলের ওপরে নানারকম প্রাগৈতিহাসিক ম্যাপ আর ট্যুরবুক ছড়ানো দেখে হয়তো মনে মনে আমাকে ব্রন্টোসরাসের ছোটোপিসি ভাবে। তা সে যা ভাবুক গে  যাক। ...আমার কর্ম আমি করি মা।

তা এইরকম টানা কয়েকদিন এঁটুলির মত সেঁটে থাকার পর সফরের গতিপথ সাব্যস্ত হল। প্রথমে বোস্টন থেকে শিকাগো যাব ট্রেনে চেপে। লেক-শোর লিমিটেড বলে নাকি এক চমৎকার ট্রেন আছে। আমি তো নাম শুনেই কৃষ্ণপ্রেমে আত্মহারা। খোঁজ নিয়ে জানলাম যে এই ট্ট্রেন লেক মিশিগান, মোহক নদী, এরি ক্যানাল ধরে ধরে এগোবে আর রেলের কামরায় বসেই যাকে বলে নানান মনোরম  দৃশ্য দেখতে পাবো। মাথার মধ্যে কবিতার পায়চারি...

'পিছনে, সামনে এবং ডাইনে-বাঁয়ে

ছড়ানো মস্ত শহর, শহরতলি;

চলেছে হাজার মানুষ ব্যস্ত পায়ে,

সারাদিন পালটে যাচ্ছে দৃশ্যাবলী।

আমি সেই দৃশ্যাবলী দেখে বেড়াই,

দু’ চোখে হাজার দৃশ্য কুড়িয়ে যাই,

তবুও তোমায় বলি জনান্তিকে:

জনতার মিছিল কিংবা বৃক্ষ, পাখি—

যে-দিকে যখন আমার চক্ষু রাখি,

তখনও লক্ষ্য থাকে তোমার দিকে।'

ঠিক হল শিকাগো শহরে পৌঁছে, যথাসম্ভব সস্তায় গন্ডায় একটা SUV গাড়ি ভাড়া করে, এক্কেবারে ২০০০ মাইল চালিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের কুল বরাবর গিয়ে থামব। পামেলার SUV গাড়ির ওপরে প্রচুর কনফিডেন্স। আমি যদিও তেমন গাড়ি কখনো চালাইনি তবু ভেতরে ভেতরে একটা মূর্খের সাহস রয়েছে। 'ও আর এমন কি আলাদা হবে। ও ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে' গোছের ভাব। Nissan Rogue বলে একটা SUV বুক হলো বটে তবে তেমন সস্তায় গন্ডায় হলো না। গরমকালে সকলেই নানা জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছে। তাই চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য নেই।

পামেলা চিন্তিত মুখে বলল: 'Banz তুমি বরং আমার SUV চালিয়ে একটু হাত পাকিয়ে নিও।' প্রসঙ্গতঃ জানিয়ে রাখি, পামেলার একটু নাম সংক্ষেপ করার অভ্যেস আছে। নামের শেষ ও একটা হসন্ত যুক্ত স বা z যোগ করে। ওর ডাকে রাকেশ হয়  ব়্যক্স, রিতিকা হয় রিতস ইত্যাদি প্রভৃতি। তাই আমার দাদুর দেওয়া সাধের নাম মধুবনী হলো Banz। শুনলে মনে হবে একজন ঢাকাই বাঙাল ব্যাঞ্জো উচ্চারণ করতে গিয়ে শেষের 'ও' টা  বলতে ভুলে গ্যাছে। তা সে যাই হোক আমি হুঁ হুঁ  করলাম বটে কিন্তু মনে ভাবখানা হলো 'ও আমি স্টেজেই মেরে দেব... রিহার্সালের দরকার নেই।' ওই যে বললাম... মূর্খের সাহস।

প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে মজাদার শহর সিয়াটল। ঠিক হলো, সেখানে গাড়ি ফেরত দিয়ে আবার একটা ট্রেন ধরবো। সেই ট্রেনের নাম কোস্ট স্টারলাইট। আমি তো নাম শুনেই কৃষ্ণপ্রেমে আত্মহারা। খোঁজ নিয়ে জানলাম যে এই ট্ট্রেন থেকে  নাকি আশ্চর্য্য সব দৃশ্য দেখা যায়। ক্যাসকেড পর্বতাবলী, বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর, ঘন জঙ্গল এবং দিগবলয়  ছুঁয়ে থাকা প্রশান্ত মহাসাগ। সব সব দেখা যাবে।

'কখনো ঊর্ধ্বাকাশে চক্ষু রাখি,

কখনো উদ্যানে, আর কখনও-বা

বাজারে রাস্তাঘাটে ভিড়ের শোভা

ঢেকে দেয় ক্যালেন্ডারের মুখখানিকে

দেখে যাই হাজার ছবি সারাটা দিন,

তবুও লক্ষ্য থাকে তোমার দিকে।'

সেই ট্রেনে চেপে পৌঁছে যাবো ক্যালিফোর্নিয়া। গাড়িতে ২০০০ মাইল যেতে অথবা ট্রেনে... যেখানে যেখানে ইন্টারনেটের সুবিধে থাকবে সেখানেই পামেলা আপিস করবে। খুব হিসেবে করে সেই টেবিল ক্লথের মতো বিশাল ম্যাপ ঘেঁটে ঠিক হলো যাত্রাপথ। মাসের শেষে গৃহস্থের বাজেটের মতো পামেলার ছুটির সংস্থান। খুব সন্তর্পণে টিপে টিপে খরচ করতে হয়। রাজেশ খান্না ও রাজকুমার রাওযের প্রজন্মগত তফাৎ ছাড়াও এই ছুটি সংক্রান্ত একটা বিশাল ফারাক রয়েছে আমাদের। সে হরিপদ কেরানি আর আমি আকবর বাদশা। কলেজ খুলবে সেই সেপ্টেম্বর মাসে।

হঠাৎ কলকাতা থেকে খবর এলো, পামেলার সব ছুটির অঙ্ক ভণ্ডুল, আমাদের পরিপাটি সফরসূচি ভোঁ কাট্টা হয়ে গাছের মাথায়  দুলতে লাগলো, ব্যাক গিয়ারে  SUV  Nissan Rogue!

পামেলার মুখ চুন:

'Banz এবার কী হবে? কী করবে?'

'একা যাব।'

 

(ক্রমশ)


7 কমেন্টস্:

  1. প্রিয় লেখকের একটা প্রচণ্ড ভাল লেখার পহেলা কিস্তি প্রম্প্টলি প্রকাশিত হয়েছে.... প্রভূত আনন্দ পেলাম, প্রচুর পরিমাণে অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা!

    উত্তরমুছুন
  2. ধন্যবাদ জানবেন। আপনাদের ভালো লাগলে লিখতে ইচ্ছে করে।

    উত্তরমুছুন
  3. Madhubani, আপনার এমত শুভ-সংকল্প বলবতী ও ফলবতী হৌক! 😊

    উত্তরমুছুন
  4. Excellent ranconteur, Madhubani. Packs ih humour, humanity, realism and art, the way an ideal travelogue should be.
    The shifts from the personal to the looming impersonal, are so engaging. The personal journey, its manifold ups and downs, twists and turns that lead to that climactic moment of decision and understanding: " I must make this trip!". And ofcourse, Pamela has her very vital role to play!
    The AAA bit was so hilarious as was the brushing aside of the challenge of the SUV.
    Train names were like a dream.
    Epic journey for an epic heroine!

    উত্তরমুছুন