ঋত্বিকের
নিজস্ব মুদ্রাগুলি - ২
একটা কথা ঋত্বিক বারবার বলতেন। "Content প্রথমে আসে। রবীন্দ্রনাথ একটা কথা বলে গিয়েছিলেন যে, আগে সত্যনিষ্ঠ হতে হয়, তারপর সৌন্দর্যনিষ্ঠ। কথাগুলোর মানে আপনারা ভালোভাবে বুঝে দেখবেন। Form-টা কিছু না, ওটা আকার মাত্র।"
সবচেয়ে অধিক
নিষ্ঠায় এই শর্তটির অনুপালন করা হয় এপিক শিল্পে। 'এপিক' শব্দটি ঋত্বিকের লেখায় বহুবার
এসেছে। আমাদের দেশে যাবতীয় সৃজনশীল সৃষ্টির মূল উৎস দুটি। রামায়ণ ও মহাভারত। 'মেলোড্রামা'
নামক শব্দটি সৃষ্ট হবার বহু হাজার বছর আগেই আমাদের শিল্প ও নন্দনশাস্ত্রে এই তথাকথিত
'মেলোড্রামা'র লক্ষণগুলি খুবই প্রকট। যে কোনও 'এপিক' শিল্পে আমরা এই 'অতি'বাদের প্রতি
নির্ভরতা প্রকটভাবে পাই। 'অতি'বাদের লক্ষণগুলি আগে লিখেছি। সত্যনিষ্ঠাকে সবার উপরে
স্থান দিতে গেলে নৈতিকতার দৃঢ় মাটিই হবে যাবতীয় শিল্পনির্মাণের ভিত্তি। শিল্পকে 'লোকশিক্ষে'র
প্রধান বাহন করতেই এপিকের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই য়ুরোপে
গ্রিকযুগ থেকে রেনেশাঁস যুগের শেষ পর্যন্ত
এবং আমাদের দেশে পুরাণযুগ থেকে ইংরেজ আসা পর্যন্ত, যে কোনও শিল্প সৃষ্টির অন্তসলিল
উদ্দেশ্য ছিলো, রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাষায় 'লোকশিক্ষে'। শুধু 'শিল্প' সৃষ্টির জন্যেই
শিল্প সৃষ্টি, আমাদের দেশে এই ধারণাটিকে কখনও মূলস্রোতে আসতে দেওয়া হয়নি। Art for art's sake আমাদের দেশে চিরকালই অজানা ব্যাপার। যে কোনও শিল্পপ্রচেষ্টার
প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য থেকেছে বৃহত্তর মানবসমাজের কাছে কোনও কল্যাণকর বার্তা পৌঁছে দেওয়া।
এ জন্যই আমাদের দেশে ব্যক্তির জীবনে সমষ্টির
ভূমিকা এতো প্রকট। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ নামক ধারণাটি আমাদের কাছে স্বার্থপর অসামাজিকতার
নামান্তর ছিলো। ঋত্বিকের পূর্ববঙ্গীয় শিকড় ও বামপন্থার জল তাঁকে এপিক ভারতীয়ত্ব, অর্থাৎ
ব্যক্তিমানসের রূপায়ণে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মিথস্ক্রিয়ার অমোঘ ভূমিকার প্রতি চিরকাল বিশ্বস্ত
রেখেছে। ফ্রয়েড সাহেবের সরলরৈখিক, ব্যক্তিভিত্তিক,
একমুখী বিশ্লেষণের মাপে ভারতশিল্পের সামগ্রিক মূল্যায়ণ করা একটু বিপজ্জনক। ইয়ুংসাহেবের
ব্যাখ্যা আমাদের এপিক মূল্যবোধের অনেক কাছাকাছি এবং ঋত্বিকের কাজে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাই। শুধু চরিত্র
রূপায়ণের ক্ষেত্রেই নয়, যাবতীয় অন্যতর ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রেও ঋত্বিক হয়তো য়ুরোপিয়
ও মার্কিন মানদণ্ডের বিচারে উচ্চকিত ছিলেন। অন্যদিকে সত্যজিৎ য়ুরোপিয় সিদ্ধান্তগুলির
প্রতি চিরকাল বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছেন। 'অপুর সংসার' শেষ করার সময় তিনি বিভূতিভূষণের
'ভারতীয় পাঁচালি'র মতে সমে ফিরে আসার প্রক্রিয়াটিকে গ্রহণ করেননি। তাকে য়ুরোপিয় যুক্তিপরম্পরায়
সরলরেখায় অগ্রসর পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন। এই নিয়ে ঋত্বিকের আপত্তি স্বাভাবিক।
আইজেনস্টাইনের
শিষ্য হিসেবে ঋত্বিক alienation from the
narratives-এ আস্থা রাখেন। তাঁর নীতিবোধ, যা কেতাবি শিল্পবোধের থেকে অনেক প্রখর, সেখানে
তিনি আপোসে বিশ্বাস করেন না। তাঁর মতে, "আমি শিল্পী হিসেবে involvement'এ বিশ্বাস
করি। আমি বিশ্বাস করি যে চারপাশের মানুষের জীবনের সাথে নাড়ির যোগ রেখে ছবি করতে হয়।
তা না-হলে ছবি করার কোন মানে হয় না... তাই আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি শিল্পীর কর্তব্য
এবং প্রয়োজন এই involvement। সেই সাথে audience-কে alienate করব। ...আমি প্রতি মূহূর্তে আপনাকে ধাক্কা
দিয়ে বোঝাবো it is not an imaginary
story, বা আমি আপনাকে শস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মূহূর্তে আপনাকে hammer করে বোঝাবো
যে যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা, কিন্তু
এর মধ্যে দিয়ে যেটা বোঝাতে চাইছি আমার সেই thesis-টা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি। সেটার
প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর জন্যই আমি আপনাকে alienate করব প্রতি মূহূর্তে।"
যখন শিল্পী
বলছেন যে তিনি দর্শককে 'ধাক্কা' দিতে চাইছেন বা hammer করতে চাইছেন, তার মানে তিনি
তাদের আখ্যানের আরামদায়ী গৃহকোণ থেকে বার করে রোদ-জল-বৃষ্টি-ঝড়ের নিষ্ঠুর নিসর্গের
মধ্যে ফেলে দিতে চাইছেন। তিনি এটা বোঝাতে চাইছেন এই বিপর্যয় বা বিড়ম্বনা একটি গল্পের
চরিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না । এ তোমার পাপ, এ আমার পাপ। তুমি সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেকে এই দায়িত্ব থেকে
মুক্ত করতে পারো না। আমাদের দেশের যে নীতিশাস্ত্র, সেখানে এই তাড়নাটিকে শাশ্বত স্বীকৃতি
দেওয়া হয়েছে। এমন কি এক জীবনে এই পাপ থেকে মুক্ত হতে না পারলে 'পরজন্মে' তোমাকে এটা
বহন করে বেড়াতে হবে। অঙ্ক মেলাবার জন্য 'পরজন্ম' বা 'জন্মান্তর' নামক এক্স ফ্যাক্টরকে
প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই পাপ আসলে
কী? একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে তুমি যখন এক জন্মে তোমার প্রতি সমাজসংসারের প্রত্যাশা
পূরণ করতে পারছো না, তখন তোমাকে আরও জন্ম নিতে হবে এই প্রত্যাশা পূরণের জন্য। বুদ্ধজাতকের
গল্পের কথা ভাবুন, পরে যেটাকে সনাতন ধর্মেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে গীতা, ভাগবতে। সেখানে
আমরা দেখি সমাপতনের কী চূড়ান্ত ঘনঘটা। কেউ যদি অন্যায়ভাবে একটি মৃগবধ করে তবে 'পরজন্মে'
তাকে মৃগ হয়ে জন্মগ্রহণ করে নিহত হতে হবে। এই চক্রবৎ পরিবর্তন্তে বা সেই বিমল মিত্রের
উপমায় 'যমুনাকি তীর' বারবার ফিরে ফিরে আসবে এটাই ভারতীয় নীতিশাস্ত্রের ঐতিহ্য। ভারতীয়
নন্দনশাস্ত্র তৈরিই হয়েছিলো এই নীতিশাস্ত্রকে 'ধাক্কা' মেরে বা hammer করে মানুষের মনে স্থাপন করার জন্য। এই ধাক্কা মেরে
ইম্প্যাক্ট তৈরি করাই তো 'মেলোড্রামা'র উদ্দেশ্য, যা আমরা বারম্বার বিভিন্ন এপিকের
মধ্যে পাই। ঋত্বিক তো সেই কাজই করেছেন। ব্যক্তির ক্ষয়রোগ ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকছে
না, তা সমগ্র সমাজের ক্ষয়রোগের অংশ। দর্শকও তার থেকে অব্যাহতি পাবে না। নীতিশাস্ত্র
তো এই কথাই বলে। এই রোগের জীবাণু দ্যাবাপৃথিবীতে একভাবে প্রভাবী হয়ে রয়েছে।
তাঁর সঙ্গে
ছবি করার ক্র্যাফট বা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তিনি বলেন, "পদ্ধতি-টদ্ধতি বুঝি না মশাই, আমার কাছে আজও
প্রমথেশ বড়ুয়া ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ চিত্রপরিচালক।" এই উক্তির যাথার্থ্য প্রমাণ
করতে তিনি অবশ্যই অনেক উদাহরণ দেবেন। এই জায়গাটিতেই ঋত্বিক তাঁর সমকালীন আরেক প্রত্যক্ষভাবে
চিহ্নিত 'রাজনীতি সচেতন' স্রষ্টার থেকে আলাদা হয়ে যান। মৃণাল সেন কখনও এভাবে তাঁর মুগ্ধতা
জানানোর প্রয়াস করবেন না।
শিল্প ও রাজনীতির,
পড়ুন সমাজতন্ত্রের, পারস্পরিক টানাপড়েন বিষয়ে তাঁর মতামত চিরকালই পি সি জোশির লাইন
মেনে চলেছে। তাই নির্দ্বিধায় তিনি বলে ফেলেন, "রাজনীতি সম্পর্কিত হওয়া মানে, শিল্পী-টিল্পি
নয়, যে-কোন মানুষকে এই সমাজে, এই শ্রেণীসমাজে, রাজনীতি সম্বন্ধে সম্পৃক্ত হয়ে থাকতে
হয়। এটা শিল্পী শুধু নয়, সব্বায়েরই হওয়া উচিত। তবে তাই বলে slogan mongering শিল্পীর
কাজ নয়। এই cheap slogan দিয়ে শিল্পী হয় না, শিল্পীকে কাজ করতে হয় মানুষের গভীরে। রাজনীতিকরা
কাজ করে ওপরতলায় - মানে চেঁচামেচি, হট্টগোল, cheap slogan, একটা short slogan, এই সব।
শিল্পী এইগুলো করলে, আমি মনে করি, সেটা শিল্প আর থাকে না।"
ইশকুলের পড়ার
বইয়ে আমাদের শেখানো হয়, মানুষ সামাজিক প্রাণী। এই 'সমাজ'টা যে প্রকৃতপক্ষে কী, সে বিষয়ে
কিন্তু বিশদ কিছু ব্যাখ্যা সে পর্যায়ে অধরাই থেকে যায়। এই ‘তোতা’পর্বের সীমানা পেরোলেই
মানুষ নিয়ত নিজস্ব রাজনৈতিক অস্তির রক্তক্ষরণের বেদনা অনুভব করতে শুরু করে। একজন বিবেকী
মানুষ এ অবস্থায় কোনভাবেই 'আমি পলিটিকস করি না' গোছের শান্তিকল্যাণে আশ্রয় নিতে পারে
না। সাধারণ মানুষই যা পারে না, শিল্পী কী করে পারবে? তার অনুভূতি, সংবেদনা, বিস্ময়বোধ অনেক বেশি প্রখর।
স্বাভাবিকভাবেই স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান না থাকলে সে অসহায়। এমনিতেই সে সৃষ্টিশীলতার
দোলাচলে পর্যুদস্ত, তার উপর যদি বাস্তব মাটির খুঁটিটাও নড়বড়ে হয়ে যায়, তবে তো সূর্যাস্তের
অপেক্ষা করা ছাড়া তার আর কোনো গতি নেই। সঠিকভাবে পারিপার্শ্বিক ও সমাজসংসারের রাজনৈতিক
বিশ্লেষণ করতে পারলেই শিল্পী তার টার্গেট গ্রাহক সঙ্ঘটিকে খুঁজে নিতে পারে। ঋত্বিকের
সৃজনশীলতার শিকড় তাঁর সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে ছিলো। এই সময়ের
ধর্ম ও তাঁর শিল্পের চরিত্রকে ব্যাখ্যা করা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, "এখন আমরা
কীসের মধ্যে দিয়ে pass করছি? Neo-colonialism, absolutely neo-colonialism. এটা আমি
ছবিতে বলিনি। এ কথাগুলো বলতে গেলে আমার ছবি রাজনীতি হয়ে দাঁড়াত, ছবি হত না। আমি in
human terms ব্যাপারটা ছবিতে বলার চেষ্টা করেছি।"
'তিতাস' করার সময় তাই তাঁর কাছে অদ্বৈত মল্লবর্মণকে অধিক গ্রহণীয় মনে হয়েছিলো। যদিও
প্রথম থেকেই তাঁর মনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনার ভিত্তিতে ছবি করার আকাঙ্ক্ষা ছিলো
প্রখরভাবে। কিন্তু মানিক'কে তাঁর খুব 'তীক্ষ্ণ' মনে হতো। সেলুলয়েডে ধরার পক্ষে বড্ডো
জটিল।
শিল্পীদের সময়ের
প্রহরী বলা হয়। তাঁরা ভবিষ্যত সময়ের রূপরেখা বহু আগেই অনুভব করতে পারেন। শিল্পীর ইনসটিংক্ট
তাঁকে নিজের সময়ের আগে এগিয়ে দেয়। ঋত্বিকের অনুভবে বেশ কয়েক দশক আগেই তাঁর স্বদেশভূমির
রাজনৈতিক অবস্থার ভবিষ্যদ্বাণী আমাদের চমকে দেয়। অবহেলিত, বহুনিন্দিত এই ধীমান মাতাল
এবং 'পাগল' যে কথাগুলি বলে গিয়েছেন, যেন ডেলফির দৈববাণীর মতো তা আজ আমাদের কাছে বাস্তব
হয়ে দাঁড়িয়েছে।
"...এখন
আমার নিজের ধারণা দুটো রাস্তা পরিষ্কার - হয় straight Fascism, আর নইলে Leninist পথে কোন কিছু। তোমরা যদি ১৯২৯
থেকে '৩৩ সালের জার্মানির দিকে তাকিয়ে দেখো তো দেখবে যে, এই যে এখানে ১৫-১৬ বছর থেকে
২০-২৫ বছরের ছেলেরা বাঁদরামি করে বেড়াচ্ছে, এটা যেন তারই প্রতিরূপ। এরাই SS, এরাই
Gestapo এই lumpen-দের থেকেই তৈরি হচ্ছে ভীষণভাবে। গোটা সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে চুরমার
হয়ে-দুটো পথ খোলা - হয় Leninist পদ্ধতিতে নিয়ে যাবার একটা ব্যাপার আছে, নইলে clean
Fascism হবে। এবং আমার ধারণা within 3, 4 or 5 years এটা হবে - হয় এদিকে, নয় ও-দিকে।
এ চলতে পারে না। ছবিতে এ বলার অবকাশ নেই, কেননা আমি জানি এ দেশে leadership বলে কোন
পদার্থ নেই।" ঋত্বিকের এই মন্তব্য করার পরে চল্লিশ বছর কেটে গেছে। এখন বিপর্যয়
আরও অনেক সর্বনাশী অনুপাতে ক্রমশ পৌঁছে যাচ্ছে আমাদের কুঁড়েঘরে। এই দূরদর্শিতাই শেষপর্যন্ত
ঋত্বিকের মুদ্রা। তাঁর শিল্পের অচ্যুত লক্ষণ।
শেষ দৃশ্যে
ক্যামেরা আর কীই বা করতে পারে? প্যান করে পৃথিবী থেকে আকাশের দিকে চলে যায়। জানা নেই
সেখানেও কোনও দাঁড়াবার জায়গা বাকি আছে কি না।
চমৎকার এক নান্দনিক বিশ্লেষণ। মুগ্ধ হয়ে পড়ছি।
উত্তরমুছুন