কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১

রাহুল দাশগুপ্ত

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 

 


(১২)  

 

কেস স্টাডি ২

The infinite stupidity of the masses makes me tolerant towards individuality.

Gustave Flaubert

 

অনির্বেদের সঙ্গে হৃদয়ের আলাপ হয়েছিল একটি পুতুলের মেলায়। মাটির পুতুল তৈরি করেছিল সে। আর সেটা দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছিল হৃদয়। তারপর জানতে চেয়েছিল, এগুলো কী ফুল?

এগুলো গভীর জঙ্গলে পাওয়া যায়। বন্য ফুল।

আপনি কি ফুল ভালোবাসেন?

খুব।

হৃদয়পুরে একবছর হলো কোনও ফুল জন্মায় না।

আমাদের দ্বীপে পাওয়া যায়। তবে জঙ্গলের একটু ভিতরে ঢুকতে হবে। সবই বন্য ফুল। ওখানে কেউ ঢোকে না।

ফুল নিয়ে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে?

হয়তো। তাদের মধ্যে আমি পড়ি না।

এরপরেই ওদের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। অনির্বেদ ফুলের বাগান তৈরির কাজে হৃদয়ের সঙ্গে যোগ দেয়। দারিদ্র্য কী, দরিদ্র কাকে বলে, সেই প্রথম নিজের চোখে দেখে সে। একটা ভাঙাচোরা ইটের বাড়িতে থাকে ওরা। বেশ বড়ো বাড়ি। কিন্তু দারিদ্র্য ও অভাবের ছাপ সর্বত্র। অনির্বেদের বাবা একটি প্রাইভেট কম্পানিতে বেয়ারার চাকরি করতেন। সেই অফিসেরই একজন কর্তাব্যক্তির নাম ছিল অনির্বেদ। নামটা খুব পছন্দ হয়ে যায় তাঁর। ছেলে হওয়ার পর মানে না বুঝেই তিনি ছেলের নাম দিয়ে দেন, অনির্বেদ।

একটু ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন তিনি। আচমকা একদিন চাকরিটা চলে যায়। তারপর থেকে তিনি শুধু পারিবারিক ব্যবসা নিয়েই আছেন। কিন্তু ব্যবসায়ী স্বভাবের তিনি মোটেই নন। তিনি আসলে একজন শিল্পী। পয়সা-কড়ি সামান্যই আয় হয়। খুবই কষ্টে সংসার চলে। অল্পবয়স থেকেই অনির্বেদকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। সে বাবার সঙ্গে মাটির পুতুল গড়ে। পাশাপাশি প্রচুর টিউশুনি করে। অদম্য জেদে সে পড়াশোনো করে চলেছে। মনের  জোর বাড়াতে সে নিয়মিত স্বামী বিবেকানন্দ পড়ে। গীতা পড়ে। আর নিজের সংবেদনশীল মনটাকে আরাম দিতে তার ভরসা জীবনানন্দ দাশের কবিতা।

প্রথম থেকেই অনির্বেদ একটু সঙ্কোচ নিয়েই মেশে হৃদয়ের সঙ্গে। মন খুলে কথা বলে না। নিজেকে গুটিয়ে রাখে। শুধু মাঝে মাঝে গভীর জঙ্গলে নিজের একা একা ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা যখন জানায়, নতুন নতুন বন্য ফুল আবিষ্কারের কথা বলে, নিজের লেখা চিঠির কিছু কিছু কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে শোনায়, একমাত্র তখনই তাকে স্বতস্ফূর্ত লাগে। অনির্বেদ খুব চিঠি লিখতে ভালোবাসে। প্রচুর চিঠি লেখে সে। ডায়েরিভর্তি চিঠি। সেই চিঠি কোথাও পাঠাবার নেই। কাকে পাঠাবে, তাও সে জানে না। শুধু নিজের খেয়ালেই সে চিঠি লিখে যায়। অনির্বেদের মুখটাও ওর বাড়ির মতোই ভাঙাচোরা, অভাব ও দারিদ্র্যের ছাপ সেখানে স্থায়ী হয়ে আছে। হৃদয় ওকে ঠিক পছন্দ করতে পারে না। আবার অপছন্দ করারও কোনও প্রশ্ন ওঠে না।

ফুলের বাগানে আসার পরই নির্মাল্যর সঙ্গে একটা অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে ওঠে অনির্বেদের। ওরা দু-জন একই দ্বীপে থাকে। ওদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। দু-জনে দিনের অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটায়। কখনও কখনও জঙ্গলের ভেতরে যায়। নৌকায় চেপে ভেসে বেড়ায়। নির্মাল্য বহির্মুখী, ছটফটে স্বভাবের, মন খুলে মানুষের সঙ্গে মেশে। অন্যদিকে অনির্বেদ অন্তর্মুখী, চাপা স্বভাবের, নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই পছন্দ করে। ওদের দু-জনের স্বভাব এতো পরস্পরবিরোধী বলেই বোধহয় ওদের বন্ধুত্ব খুব তাড়াতাড়ি জমে  ওঠে।

নির্মাল্যের মধ্যে যেন একটা চুম্বক ছিল। সবাইকে সে নিজের দিকে অপ্রতিরোধ্যভাবে আকর্ষণ করতে পারত। যে কোনও নতুন গান সে অনায়াসে নিজের গলায় তুলে নিতে পারত। তারপর গভীর দরদে নির্ভুলভাবে সেটা গেয়ে শ্রোতার মন জয় করে নিত। আবার নরম স্বভাবের হলেও সে ছিল ক্যারাটেতে অতি দক্ষ। ক্যারাটের নানা মারপ্যাঁচ দেখিয়েও সে দর্শকদের মুগ্ধ করে দিতে পারত। স্বভাবের দিক থেকে সে ছিল মিশুকে প্রকৃতির, কথার জাদুতে, কৌতুকে ও রঙ্গরস মিশিয়ে শ্রোতাকে সে অনায়াসে সম্মোহিত করে দিত। নির্মাল্যর বাড়িতে মাঝেমাঝেই আড্ডার আসর বসত। হৃদয়, অনির্বেদ, আগ্নেয়, বিশ্রুত ছাড়াও বেশ কিছু ছেলে-মেয়ে সেখানে হাজির থাকত। কিন্তু নির্মাল্যই ছিল সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্রে। কথা আর সুরের জাদুতে সে তখন সবাইকে সম্মোহিত করে দিত। মেহুলীকে সে এভাবেই সম্মোহিত করেছিল।

এই নির্মাল্যকে নিয়েই প্রথম হৃদয় আর অনির্বেদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হল।

বিশ্রুত পরে বলেছিল, প্রথমদিকে তাহলে কোনও সমস্যাই ছিল না? তিনজনে একসঙ্গে ভালোই থাকতি, গল্পগুজব করতি, ঘুরে বেড়াতি?

হ্যাঁ ঠিক তাই, হৃদয় বলেছিল।

তাহলে সমস্যাটা শুরু হল কখন?

একটু একটু করে। নির্মাল্যর আকর্ষণ ক্রমেই আমার কাছে বাড়ছিল। অসম্ভব ভালো সময় কাটত ওর সঙ্গে। সত্যিই, সময়কে যেন সময় বলে মনেই হত না। একটা আনন্দের, সুখের স্রোতের মধ্য দিয়েই যেন ভেসে যেতাম। একমাত্র প্রেমের অনুভূতির সঙ্গেই বোধহয় এর তুলনা চলে। নির্মাল্যর প্রেমেই পড়েছিলাম আমি। আর যতো ওর প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়ছিল, ততোই যেন অনির্বেদের প্রতি টান কমে যাচ্ছিল। অনির্বেদের উপস্থিতি ক্রমেই অবাঞ্ছিত মনে হতে শুরু করেছিল আমার কাছে। মনে হতো, ও না থাকলেই ভালো হয়। আমি আর নির্মাল্য বেশ আছি। আমাদের দু-জনের সম্পর্কের মধ্যে ওর কোনও জায়গা নেই।

ও একটা বাড়তি ব্যাপার, যাকে অকারণে টেনে নিয়ে চলেছি। কিন্তু যেহেতু ওদের বাড়ি ছিল একই দ্বীপে, নির্মাল্যর সঙ্গে দেখা করতে গেলে অনির্বেদ জুটে যেতই। আর আমার কাছে সে ছিল এক বিড়ম্বনা।

অনির্বেদের ভেতরেও বোধহয় একই ব্যাপার চলছিল। আমরা একে অপরকে এড়িয়ে যেতে চাইতাম। আর শুরুও করেছিলাম এড়িয়ে যেতে। প্রথমটায় ঠিক বুঝতাম না। কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছিলাম। নির্মাল্যর উপস্থিতিতে আমরা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারতাম না। একে অপরের অনুপস্থিতিতেই স্বস্তিবোধ করতাম। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলেও মনে মনে বিরক্ত হতাম, নিজেদের সুখের পথে বাধা বলেই মনে করতাম এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একে অপরের কাছ থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইতাম। নির্মাল্যের সাহচর্যের ব্যাপারে কোনও অংশীদারিত্ব আমাদের দু-জনের কারোরই পছন্দ ছিল না...

তোদের মধ্যে নির্মাল্য কার সঙ্গ বেশী পছন্দ করত?

 

(ক্রমশঃ)   


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন